কলম্বাস থেকে রবার্ট ক্লাইভ: ইতিহাস কখন যে কাকে পথে নামায়

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।।

আমেরিকার সাম্প্রতিক বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন যেন ক্রমশই হয়ে উঠছে ইতিহাস খুঁড়ে সত্য তুলে আনার এক অভিনব প্রতিবাদযজ্ঞ। এ প্রতিবাদী আন্দোলন এখন কেবলই কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই, আমেরিকার ভেতরে পুষতে থাকা নানামুখী বর্ণবাদ, জাত-পাত এবং বৈষম্যের খেরোখাতা উঠে আসছে সত্যের সমুখে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আমেরিকাজুড়ে ‘বিতর্কিত’ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের মূর্তি বা ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার মাধ্যমে।

ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা যে অনিঃশেষ ঘৃণা আর শোষণ শত বছর ধরে মিথ্যা অহমিকার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই ঘৃণার বুদ্বুদ ক্রমশই স্ফুলিঙ্গ হয়ে আমেরিকার মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। দাসব্যবসার ঘৃণ্য ইতিহাস তো আছেই, আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য দখল, মেক্সিকোর প্রতি দমন-পীড়ন, দক্ষিণ আমেরিকার মানুষদের প্রতি শোষণ-নির্যাতন, অভিবাসীদের সঙ্গে পশুসুলভ আচরণ—সব ইতিহাস উগড়ে দিচ্ছে এক এক করে।

শুরুটা হয়েছিল ১৭শ শতাব্দীর এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তি ভাঙা দিয়ে। এরপর আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য বিস্তারের মূল হোতা পর্তুগিজ নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে ধরা হয়, আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ভাঙা হয় কথিত এই আমেরিকা আবিষ্কারকের মূর্তি।

বাদ যায়নি উনবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিবিদ জেফারসন ডেভিস। যিনি ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকার দক্ষিণ অংশের বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্য দখল করে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসেন। এই রাজ্যগুলো মধ্যে অন্যতম রাজ্য হলো ভার্জিনিয়া। ভার্জিনিয়াতেই সবচে জোরদার হচ্ছে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন এবং ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড শহর থেকে গত (১০ জুন ২০২০) রাত ১১টায় ভেঙে ফেলা হয় জেফারসন ডেভিসের মূর্তি। এরপর মূর্তির মুখে কালি মেখে ফেলে দেয়া হয় রাস্তার পাশে।

আমেরিকার প্রতিটি শহরের গভর্নরগণ এখন রাতারাতি তাদের শহর থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন বিতর্কিত ব্যক্তির মূর্তি ও ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলছেন। ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে যারা মানুষের ওপর জুলুম ও বৈষম্যের বিষোদ্গার উগড়ে দিয়েছিলেন, তাদের সবার ওপরই যেন নেমে আসছে শুদ্ধির খড়গ। শুধু যে বর্ণবাদ এখন ইস্যু তা কিন্তু নয়, এখন আমেরিকাজুড়ে আওয়াজ উঠেছে সকল প্রকার বৈষম্য ও ঘৃণার বিরুদ্ধে। দিন দিন এই বৈষম্যের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে এবং টান মেরে ছিড়ে ফেলা হচ্ছে ইতিহাসে ঘৃণিত আস্তিন।

দুই

এদিকে বিশ্ববিখ্যাত পণ্য পরিবহন ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘অ্যামাজন’ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাদের বিতর্কিত ‘ফেস রিকগনিশন’ (চেহারা শনাক্তকরণ) সফটওয়্যার আগামী এক বছর আমেরিকার পুলিশকে ব্যবহার করতে দেবে না। তারা বলছে, এই ফেস রিকগনিশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে পুলিশ খুব সহজেই আন্দোলনে যোগ দেয়া প্রতিবাদকারীদের চেহারা শনাক্ত করতে পারত। যেসব প্রতিবাদকারী আমেরিকাজুড়ে নানা স্থানে শান্ত ও অশান্তভাবে আন্দোলন করেছেন, নানা মাধ্যমে তাদের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই আধুনিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেসব ছবি ও ভিডিও থেকে আন্দোলনকারীদের চেহারা শনাক্তকরণ সম্ভব হবে।

এর আগে অপরাধী শনাক্ত করতে আমেরিকার পুলিশ অ্যামজনের এ সফটওয়্যারটি ব্যবহার করতো। কিন্তু এই আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ যাতে আন্দোলনকারীদের চেহারা শনাক্ত করে কোনোভাবে তাদের গ্রেফতার বা অবদমিত করতে না পারে, সে কারণেই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে অ্যামাজন। অবশ্য এ ধরনের ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি টেক জায়ান্ট গুগল এবং ফেসবুকেরও রয়েছে। তারা ‍গুগল এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর চেহারা শনাক্তে এই প্রযুক্তি হরহামেশা ব্যবহার করে থাকে।

অ্যামাজন বর্তমান পৃথিবীর সবচে প্রভাবশালী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জেফ বেজস পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন। তিনি যদি আমেরিকার সরকারের বিরোধিতা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন তবে এটি একটি আশাব্যঞ্জক সংবাদ আবার দুশ্চিন্তারও কারণ বটে।

রাস্তার আন্দোলন সাধারণত নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরে পরিচালিত হয়। সেখানে উচ্চবিত্ত তখনই নাক গলায় যখন তারা কোনো দূরদর্শী মুনাফার সন্ধান পায়। এখানে রাজনীতিও অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। হতে পারে জেফ বেজস আমেরিকার দূরদর্শী কোনো অন্তর্গত রাজনীতির সংকেত পাওয়ার পরই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাছাড়া অ্যামাজনের বিশাল ভোক্তাশ্রেণিকে সন্তুষ্ট রাখাও অন্যতম কর্তব্য, যারা এই মুহূর্তে আমেরিকার রাস্তায় নেমে এসেছে।

তবে অ্যামাজনের এমন সিদ্ধান্তের ফলে এই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন যে শিগগিরই ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে, সেটি ধারণা করা যায়।

তিন

এ কথা আরেকবার প্রমাণ হলো, ইতিহাস কখনোই কাউকে ক্ষমা করে না। হয়তো সময়ের আবর্তে কিছু দিন, কয়েক বছর, নিদেনপক্ষে দু-এক শতাব্দী হয়তো পার হয়ে যায় মিথ্যার মোড়কে, কিন্তু সত্য যখন প্রকট হয়ে প্রকাশ পায় তখন সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে নিয়ে যায়।

আজকের ক্লিনটন, বুশ, ওবামা, ট্রাম্প হয়তো কিছুদিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বরিত হবেন আমেরিকার মানুষের কাছে। কিন্তু একদিন তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাদের ব্রোঞ্জ ও পলেস্তরায় গড়া মূর্তিও ভেঙে রাস্তার ধুলোয় মিশে থাকবে। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর শোষণের পর আজ আমেরিকাজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ওপর কৃত অমানুষিক আচরণের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে সকল শ্রেণি-ধর্মের মানুষ। ইতিহাসের পাতাজুড়ে যারা তাদের ওপর এমন অমানবিক আচরণের কারণে অপরাধী কিন্তু আমেরিকার কাছে প্রবাদতুল্য, তাদের মূর্তি রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, নালা আর ডোবায় ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে। একদিন আমেরিকার ইতিহাসের বই থেকেও তাদের নাম মুছে ফেলা হবে হয়তো। লেখা হবে নতুন ইতিহাস। যে হিরো তাকে হিরো বলা হবে, আর যে ভিলেন তাকে ভিলেন হিসেবেই চিত্রিত করা হবে।

ভবিষ্যতে এমনও দিন হয়তো আসবে যেদিন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ভিয়েতনামের মানুষেরা আমেরিকার ভেতরে আচমকা জেগে ওঠবে। তাদের প্রতি বছরের পর বছর ধরে যে হত্যা ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তার বিচার চাইবে বিশ্ববাসীর কাছে। এমনও হতে পারে, তারা নিজেরাই হয়তো বিচারের দাড়িপাল্লা নিজেদের হাতে তুলে নেবে। হতে পারে আমেরিকার ইতিহাস তখন আরেকবার লেখা হবে নতুন করে, নতুন আঙ্গিকে। কে জানে, ইতিহাস কবে কার হাতে লেখা হয়, সে তো কেবল ইতিহাসই বলতে পারে।

চার

আমেরিকার পর ব্রিটেনে শুরু হওয়া বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জেরে এরই মধ্যে দাসব্যবসায়ীদের অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়েছে। তাই নয়, অতীত ঘেঁটে তুলে আনা হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল—এমন সব ব্যক্তিদের কীর্তিকলাপ। সম্মানের আসন থেকে তাদের ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে রাস্তার ধুলোয়।

জানি না, দুই শ বছর ভারতবর্ষ শোষণ করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট-এর কুখ্যাত লর্ডদের নাম সেই তালিকায় উঠে আসবে কি-না। লর্ড রবার্ট ক্লাইভ, চার্লস ক্যানিং, নাথানিয়েল কার্জন, চার্লস হার্ডিঞ্জ এবং ইংরেজ সরকারের রক্তচোষা অসংখ্য সেনা অফিসার, যাদের হাতে লেগে আছে ভারতবর্ষের শত-সহস্র মানুষের রক্তের দাগ; তাদের মূর্তি আর কীর্তিও কি ইংল্যান্ডের রাস্তার ধুলোয় নামিয়ে আনা হবে? নাকি অসম্মান করে তাদের রাস্তায় নামিয়ে আনলে ইংল্যান্ডের পুরো ইতিহাসই দুমড়ে মুচড়ে তাসের ঘরের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে? কেননা আজকের ‘সুসভ্য’ ইংল্যান্ড তো এই দাসব্যবসা আর রক্তে গড়া স্তম্ভের উপরই দাঁড়িয়ে আছে।

আরো পড়ুন: আমেরিকার বর্ণবাদ: সভ্যতা এবং অসভ্যতার ইশতেহার

পূর্ববর্তি সংবাদকরোনায় আক্রান্ত বান্দরবানের জেলা প্রশাসক
পরবর্তি সংবাদলাদাখে ভারী অস্ত্রসহ বাড়তি সেনা মোতায়েন করেছে চীন