আমেরিকার বর্ণবাদ: সভ্যতা এবং অসভ্যতার ইশতেহার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর।।

২০১৮ সালের শুরুতে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে সংঘটিত ‘কিশোর আন্দোলনের’ কিছুদিন পরের কথা। আমি বাসে করে গাবতলী হয়ে টেকনিক্যাল পাড় হচ্ছিলাম। হঠাৎ টেকনিক্যাল মোড়ে এসে বাসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে দুই-তিন জন স্কুল শিক্ষার্থীর বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়। দেখতে দেখতে তারা বাস থামিয়ে কন্ডাক্টরের শার্টের কলার ধরে নিচে নামিয়ে ফেলে এবং তার নাকে-মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। কন্ডাক্টর বেচারা স্কুলের শিক্ষার্থী বলে কেবল মুখে কিছু একটা বলে প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি পাল্টা আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকেন। বেশকিছু কিল-ঘুষি হজম করেও তিনি তাদের ওপর হাত না তুলে বাসে ফিরে আসেন। যদিও একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বুঝতে পারলাম, এখানে কন্ডাক্টরের দোষ সামান্যই। সেই সামান্য দোষের কারণে স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের হাতে এভাবে অপমানজনক আক্রমণের শিকার হওয়াটা একেবারেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।

এই দৃশ্য দেখে খানিকটা ব্যথিত হলাম। কিছুদিন আগে সংঘটিত ‘কিশোর আন্দোলন’ আমার মতো অনেককেই আশান্বিত করেছিল। তাদের নিয়মতান্ত্রিক এবং দরদি আন্দোলন আমাদের বুঝিয়েছিল, আমাদের আগামী প্রজন্ম এখনও ইন্টারনেট আর গেম সংস্কৃতির আড়ালে একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। কিন্তু সেই আশান্বিত আন্দোলনের মন্দ প্রভাবে ঘটেছিল এমনতর অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য।

প্রতিটি আন্দোলন বা বিপ্লব চলাকালীন কিছু মন্দ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে। এগুলো নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য যদিও, তবে এসবকে পুরোপুরি এড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পুলিশের নির্মম আক্রমণে জর্জ ফ্লয়েড নামে একজন সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুর পর মে মাসের শেষ থেকে আমেরিকায় শুরু হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে অভূতপূর্ব আন্দোলন। এ আন্দোলনে শুধু কৃষ্ণাঙ্গরা নয়, যোগ দিয়েছেন মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার সকল বর্ণের সকল ধর্মের মানুষেরা। আমেরিকার মানবতাবাদী শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়াজ তুলছেন ‘Black Lives Matter’।

আমেরিকার এই বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলন কেবল আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেটি ছড়িয়ে পড়েছে কানাডাসহ দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশে। এমনকি ইউরোপেও ঢেউ লেগেছে বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদের। ব্রিটেনে ঘটেছে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। সে দেশের প্রতিবাদকারীরা ব্রিস্টল শহরে স্থাপিত এডওয়ার্ড কলস্টন নামে একজন ‘ঐতিহাসিক’ ব্যক্তিত্বের ১৯ ফুট উঁচু একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি ভেঙে ফেলেছে। কারণ, এই কলস্টন ছিলেন ১৭শ শতাব্দীর একজন দাস ব্যবসায়ী। যিনি আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বন্দী করে ইউরোপ ও আমেরিকায় এনে দাস হিসেবে বিক্রি করতেন। তার ছিল বিরাট দাসব্যবসা। তখনকার ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় চলত তার এ ব্যবসা। ধনী ব্যবসায়ী এবং নাবিক হিসেবে পরবর্তীতে তিনি ব্রিটেনে সমাদৃত হয়ে আসছিলেন। সেই স্বীকৃতি হিসেবে ১৮৯৫ সালে ব্রিস্টলে তার বিরাটাকার মূর্তিটি স্থাপন করা হয়। বিগত ৭ জুন ২০২০ তারিখে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা মূর্তির গলায় দড়ি বেঁধে সেটি মাটিতে ফেলে দেন এবং পরে সেটি পাশের নদীতে ছুড়ে ফেলেন।

তবে আমেরিকায় এই আন্দোলনের সুযোগে দেশজুড়ে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে। যেমন, বিভিন্ন স্থাপনায় আক্রমণ, ভাঙচুর, দোকানপাট ভাঙচুর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটতরাজ, যানবাহন এবং বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে চলেছে। আমরা আগেই বলেছি, প্রতিটি আন্দোলনেরই কিছু মন্দ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। আমেরিকার মতো  ‘সুসভ্য’ দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে কথা হলো, যারা পৃথিবীব্যাপী মানুষকে সভ্যতা শেখাতে দেশ আক্রমণ থেকে শুরু করে নানাধর্মী কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়, তাদের দেশে এমন লুটতরাজ এবং মানুষের অসংযত আচরণ তাদের সভ্যতা শেখানোর তন্ত্র মন্ত্রকে কি প্রশ্নবিদ্ধ করে না?

২০০৮ সালে যখন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, বেশ অবাক হয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে, অভিভূতও হয়েছিলাম। যে আমেরিকায় থেকে ৪০-৫০ বছর আগেও কৃষ্ণাঙ্গদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার ছিল না, তারা শেতাঙ্গদের স্কুলে পড়তে পারত না, শেতাঙ্গদের রেস্তোরাঁয় তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না, তাদের জন্য আলাদা খাবার ও পানীয়র দোকান হতো, এমনকি কালো মানুষের ভোটাধিকার পর্যন্ত ছিল না। সেই আমেরিকা একজন কৃষ্ণাঙ্গকে তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে, এটি অভিভূত হওয়ার মতো খবরই ছিল বটে।

কিন্তু আমেরিকার সাদা মানুষের মানসিকতা কি সত্যি বদলেছে? কিংবা বদল হলে কতটা বদলেছে? সকল শেতাঙ্গ কি কৃষ্ণাঙ্গদের সত্যিকারের মানুষ মনে করে? নাকি হিন্দুধর্মের মতো তারাও বর্ণভেদে মানুষের উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ করে? বাস্তবতা কিন্তু সেটাই বলছে।  আজ থেকে ৫০ বছর আগের যে পরিবেশ ছিল, আমেরিকায় এখন হয়তো কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে ততটা ছুঁৎমার্গ নেই। আমেরিকার সমাজের সর্বস্তরেই এখন কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার আছে বৈকি, সেটা সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ মানুষের মনের সংবিধানে কি কৃষ্ণাঙ্গ বা এশীয় বা অন্যান্য বাদামি ও কালো চামড়ার মানুষের ব্যাপারে সমান অধিকার বিকশিত হয়েছে?

প্রত্যেকজন মানুষের জন্য যদি সমান অধিকার নিশ্চিত করা না যায় তবে আমেরিকাকে আর পৃথিবীব্যাপী সভ্যতা শেখানোর ঠিকাদারি নিতে হবে না, আগে নিজের দেশের মানুষকে সভ্যতা শেখান। নইলে আপনার সাধের আমেরিকা একদিন অসভ্যতার দায়ভার গলায় নিয়ে ইতিহাসের তলানিতে গিয়ে আশ্রয় নেবে। আমরা ১৪শ বছর আগে থেকেই সুসভ্য। কৃষ্ণাঙ্গ দাস বেলালকে (রা.) দিয়ে ১৪শ বছর আগে আমরা মসজিদে নববির মিনারে আজান উচ্চারণ করে সেই সভ্যতার ইশতেহার ঘোষণা করেছিলাম।

আরো পড়ুন: করোনার সময়ে সম্মানজনক আয়ের সন্ধান

পূর্ববর্তি সংবাদবাজেটে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা
পরবর্তি সংবাদসর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্তের দিনে দেশে ৭০ হাজার ছাড়াল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা