প্রথম তারাবি: সাহায্য চাইব কেবল তাঁরই কাছে

মাওলানা রাশেদুর রহমান।।

আজ বাংলাদেশের আকাশে রমজানের চাঁদ দেখা গেলে আজ তারাবি পড়া হবে। সে হিসেবে আজকের তারাবিতে পবিত্র কোরআনের প্রথম পারা পুরোটা এবং দ্বিতীয় পারার অর্ধেক তেলাওয়াত করা হবে।

এ অংশে রয়েছে সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারার প্রথম ২০৩ আয়াত।

১. সূরা ফাতিহা (মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত ৭, রুকু ১) ফাতিহা অর্থ ভূমিকা। কোরআনের মূল আলোচ্য বিষয় তিনটি : তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাত। ভূমিকার মতো ছোট্ট এ সূরাটিতে উল্লেখিত তিনটি বিষয়েই আলোচনা রয়েছে।

সূরা ফাতিহা বলে, আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে, সাহায্য শুধু তাঁরই কাছে চাইতে হবে এবং হেদায়েতের প্রার্থনাও কেবল তাঁরই দরবারে করতে হবে। সূরাটিতে নবী-রাসুল এবং ওলি-বুজুর্গদের পথ অনুসরণের নির্দেশনা রয়েছে, অনুরূপভাবে সেসব গোত্র-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনুগমনের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে, যারা নিজেদের জ্ঞানপাপ ও বদ আমলের কারণে আল্লাহর আজাব, গজব ও ক্রোধের পাত্র হয়েছিল এবং সরল পথ থেকে চিরতরে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল। তাফসিরে তাদের পরিচয় ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়।

২. সূরা বাকারা (মদিনায় অবতীর্ণ, আয়াত ২৮৬, রুকু ৪০) আজ সূরাটির ২০৩নং আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে।

‘বাকারা’ অর্থ গাভী। সূরায় মাঝখানে ‘বাকারা’ শব্দের উল্লেখ থাকায় এবং গাভী জবাইসংক্রান্ত একটি ঘটনার বিবরণ থাকায় সূরাটিকে সূরা বাকারা বলা হয়।

সূরার প্রথম অক্ষরগুলো হলো ‘আলিফ লাম মিম’ যা ‘হুরুফে মুকাত্তাআত’ তথা বিচ্ছিন্ন অক্ষরমালার অন্তর্ভুক্ত। সূরার শুরুতেই রাসূল (সা.) এর চিরন্তন মোজেজা ‘কোরআন কারিমের’ আলোচনা রয়েছে। এরপর মোমিন, কাফের ও মোনাফেকদের চরিত্র সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে, যেন ঈমানদার ব্যক্তি কাফের ও মোনাফেকদের দোষগুলো বর্জন করে ঈমানি চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে। (৪-২০) সূরার তৃতীয় রুকুতে মহান আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ রয়েছে। নির্দেশ পালনকারীদের জান্নাতের সুসংবাদ এবং অমান্যকারীদের জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এরপর আদম (আ.) এর সৃষ্টি এবং তাকে জমিনে খলিফা হিসেবে মনোনীত করার সময় ফেরেশতাদের সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার কথোপকথনের প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে।

আরো পড়ুন: দ্বিতীয় তারাবি: কোরআন পূর্ববর্তী গ্রন্থের সত্যয়নকারী, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী

কোরআনের বহু জায়গায় বনি ইসরাইলের আলোচনা আছে। তবে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এ সূরাতেই রয়েছে। বনি ইসরাইলকে বহু নেয়ামত দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেনি। ফলে তাদের অন্তর শক্ত হয়ে যায়। এ কারণে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর নবুয়তের মতো সত্য ও বাস্তব বিষয় তারা অস্বীকার করে বসে; আল্লাহকে না দেখলে নবী মুসা (আ.) এর প্রতি ঈমান না আনার স্পর্ধা দেখায়। গরুর বাছুরকে উপাস্যের রূপ দেয়। নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। আল্লাহর বাণীতে তারা শব্দগত ও অর্থগত বিকৃতি ঘটায়। শরিয়তের কিছু বিষয়ে ঈমান আনে আর কিছু অস্বীকার করে বসে। হিংসা-বিদ্বেষের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে। জাদু-টোনায় মেতে ওঠে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। বদ আমল সত্ত্বেও নিজেদের তারা জান্নাতের স্বতন্ত্র এবং একমাত্র ঠিকাদার মনে করতে থাকে।

সূরাটিতে নবী ইবরাহিম যেসব পরীক্ষা ও বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন সে বিবরণও রয়েছে। আল্লাহর খলিল প্রতিটি পরীক্ষায় সফল হন এবং ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধি লাভ করেন। মক্কা নির্মাণের পর তাঁর বিখ্যাত দোয়ার কথাও আলোচিত হয়েছে সূরায়। ইবরাহিম খলিলের অমর কীর্তি বর্ণনার পর আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ইবরাহিমের ধর্ম ও মতাদর্শ থেকে সে-ই বিমুখ হতে পারে যে দুর্ভাগা, নির্বোধ এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও নফসের পূজারি। মূলত ইসলামই আল্লাহর কাছে মনোনীত একমাত্র ধর্ম।

এরপর শুরু হয়েছে ২য় পারা। পারাটির সূচনা হয়েছে কেবলা পরিবর্তনের আলোচনা দিয়ে। মদিনায় হিজরতের পর মুসলমানরা প্রায় ষোল মাস বায়তুল মাকদিস অভিমুখী হয়ে নামাজ পড়তে থাকেন। কিন্তু নবীজির দিলের তামান্না ছিল, যেন কাবা শরিফকে মুসলমানদের কেবলা নির্ধারণ করা হয়। কেবলা পরিবর্তনের হুকুমের মাধ্যমে নবীজির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই আকাংখা পূর্ণতা পায়।

আরো পড়ুন: এবারের রমজান মুসলমানদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ: মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

প্রসঙ্গক্রমে সূরার ১৭৭নং আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য শুধু চেহারার মোড় পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, বরং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সমগ্র জীবনের মোড় পরিবর্তন করতে হবে।

সূরাটিতে কিছু বিধি-বিধান আলোচিত হয়েছে; যেমনঃ- আল্লাহর রাস্তায় যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের মৃত বলা যাবে না মর্মে নির্দেশ (১৫৪), বিপদে করণীয় (১৫৫-১৫৭), হজ ও ওমরার সময় সাফা-মারওয়ার সাঈ প্রসঙ্গ (১৫৮), হালাল-হারাম নির্ধারণের অধিকার এবং অনোন্যপায় অবস্থায় হারাম জিনিস ভক্ষণের নীতিমালা (১৭৩), ইসলামের বিচারিক বিধান কিসাস প্রসঙ্গ (১৭৮-১৭৯), মৃত্যুর আগে অসিয়ত করার বৈধতা (১৮০-১৮২), রমজানের রোজা ও ইতিকাফের বিধান এবং রোজার মাধ্যমে তাকওয়া লাভের পন্থা (১৮৩-১৮৭)। সূরার ১৮৮নং আয়াতে অন্যায় ও অবৈধ পন্থায় সম্পদ কামাই করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আরো পড়ুন: দ্বিতীয় তারাবি: কোরআন পূর্ববর্তী গ্রন্থের সত্যয়নকারী, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী

চান্দ্র তারিখের ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে এবং চাঁদের মূল উপকারিতা ও কার্যকারিতা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে (১৮৯)। হক ও বাতিল যতদিন থাকবে ততদিন জিহাদ ও কিতালের ধারা অব্যাহত থাকবে মর্মে সূরায় আলোচনা রয়েছে (১৯০-১৯৫)। এরপর হজ ও ওমরার (১৯৬-২০৩) বিধান বর্ণনার মাধ্যমে আজকের তারাবি সমাপ্ত হবে।

লেখক: পেশ ইমাম ও খতীব , কেন্দ্রীয় মসজিদ বুয়েট

পূর্ববর্তি সংবাদরাজশাহীতে সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে ফেনসিডিল, গ্রেফতার ৪
পরবর্তি সংবাদকরোনা: ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেল