কুয়াশার সাদা চাদর ভেদ করে মায়াবী পর্দা দুলে উঠছে

 ওলিউর রহমান ।।

ফজরের নামায শেষে মাদরাসার আবাসিক ভবন থেকে বাইরে হাঁটতে বের হয়েছিলাম নিছক কৌতুহলবশত। সকালে শীত কেমন লাগে তা অনুভব করতে। মাত্র বিশ মিনিট সময় বাইরে হেঁটে আমি অতিশয় অভিভূত এবং আনন্দিত। সামান্য এই সময়ে অন্তত পঞ্চাশজন ফুলকলির মধুর কণ্ঠের “আসসালামু আলাইকুমে”র জবাব আমাকে নিতে হয়েছে। ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার এই সকাল, শীতের প্রকোপের কারণে যখন মানুষ ঠোঁট নাড়তেও হিসেব করে, সেখানে আমি প্রত্যেককেই শুদ্ধ উচ্চ স্বরে “ওআলাইকুমুস সালাম” বলেছি।

মায়ের হাত ধরে মাদরাসা কিন্ডারগার্টেনে আসছে শিশুরা

মুরুব্বীদের মুখে শোনা, এক সময় বাংলাদেশের অতি সাধারণ একটি চিত্র ছিল সকালে দল বেধে শিশুদের মক্তবে পড়তে যাওয়া। আমাদের বাবা-চাচা এবং মা-খালারা সকালে মক্তবে পড়তে গিয়েই কুরআন পাঠের প্রথম সবক নিয়েছেন বলে জানি। সেকালে মক্তবে পড়তে আসাদের মাঝে ধনী-গরিব পরিচয় তেমন বড় ছিল না। সকলকে মক্তবে পড়তে আসার মধ্য দিয়েই শিক্ষার হাতেখড়ি নিতে হত। আমারও মনে আছে, ছোট বেলায় দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি বেড়াতে গেলে অন্যদের সাথে পরম মমতায় দুই হাতে বুকে কায়দা মুড়িয়ে মসজিদের মক্তবে হুজুরের কাছে পড়তে যেতাম। বড় ওড়নায় ঢাকা কিছুটা বয়স্ক মেয়েদের মক্তবের এক কোণে সুর করে টেনে টেনে কুরআন পাঠের কসরত আজও কানে বাজে। মক্তবে দেখতাম মেয়েরা সাধারণত ছেলেদের থেকে এগিয়ে থাকত।

মায়ের হাত ধরে মাদরাসা কিন্ডারগার্টেনে আসছে শিশুরা

কিন্তু ক্রমশ স্রোতের বেগে পরিবর্তিত ফোর দশমিক ফাইভ জি গতির বিশ্ব ব্যবস্থায় সময়ের অতি বেশি মূল্যায়ন করতে গিয়ে ‘মক্তব সংস্কৃতি’ হুমকির মুখে। দুরুদ পাঠের পর আলিফ, মীম, তোয়া, যোয়া পড়ে এক সময় যে শিশুর সকাল শুরু হত এখন ঘুম থেকে উঠেই চোঁখ কচলে, হেলতে-দুলতে সে শিশু মায়ের হাত ধরে স্কুলে পড়তে যায়। মায়েরা সময় এবং বয়সের থেকে সন্তানকে একটু এগিয়ে রাখতে জন্মের পর থেকেই যেন শিশুকে A B C D পড়ানো শুরু করে দেন। সচেতন কিছু অভিভাবক আলাদা শিক্ষক রেখে সন্তানকে আরবি-কায়দা পড়াতে চান অবশ্য। তবে প্লে, নার্সারিতেই সকালে সাত আটটা ক্লাস করে আসা ছয় সাত বছরের একটা কোমল শিশু ক্লান্ত দুপুরে একাকী পড়ার প্রতি আগ্রহ, ইচ্ছা বা উদ্যম কোনোটাই রাখে না। ফলে চলমান চর্চিত তরিকায় বাসায় শিক্ষক রেখে আরবি পড়ানো হলেও উপকার পুরোপুরি শিশু গ্রহণ করতে পারে না।

করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার এক বছর হতে চলল। দীর্ঘদিন সব কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিক্ষার সকল মাধ্যমেই কী অপরিসীম এবং কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা আন্দায করা কঠিন। শিক্ষার্থীর জীবন এবং ভবিষ্যত নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন এবং চরম হতাশ। তবে আল্লাহর শোকর যে, কোনোরকম বিপর্যয় ছাড়াই দেশের কওমি মাদরাসাগুলো ছয় মাসাধিককাল ধরে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। চাহিদা বিবেচনায় অনাবাসিক ডে কেয়ার সিস্টেমের কিন্ডারগার্টেন শাখাও সংযোজন করা হয়েছে অনেক মাদরাসায়। আজ সকালে যাদের সালাম দেওয়া আমাকে প্রীত এবং অভিভূত করেছে, মায়ের হাত ধরে মাদরাসা কিন্ডারগার্টেনে আসতে থাকা শিশুরাই ছিল তারা।

মায়ের হাত ধরে মাদরাসা কিন্ডারগার্টেনে আসছে শিশুরা

উত্তরা আজমপুরে আমি যেখানে থাকি, আধা কিলো জায়গার মধ্যে দু’টি স্বতন্ত্র ইসলামি কিন্ডারগার্টেনে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ছাত্র খরা থাকলেও বর্তমানে সেখানে শিশু-কিশোরদের বিপুল উপস্থিতি।

সকালের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে বাবার বাইকের পেছনে কিংবা মায়ের আঙ্গুল ধরা টুপি বা স্কার্প মাথায় সালাম দিতে দিতে পথচলা এসব সোনামনিদের দেখলে নিশ্চিত আপনি স্বর্গীয় সুখ পাবেন।

আজকের এই মোহনীয় দৃশ্য দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, কুয়াশার শাদা চাদর ভেদ করে যেন মায়াবী কোনো পর্দা দুলে দুলে উঠেছে।

-এনটি

পূর্ববর্তি সংবাদদ্রুত ক্লাসে ফিরতে চান ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, স্কুল খোলার পক্ষে ৭৬% অভিভাবক
পরবর্তি সংবাদপার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জের: ভারতে ভ্যাকসিন নিতে আসেনি এক তৃতীয়াংশ মানুষ