বিজয়ের মাসে ভারতের কাছ থেকে লাশের শুভেচ্ছা আমরা চাই না

সাজ্জাদ আকবর।।

১৬ ডিসেম্বর বুধবারের খবর—লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে বাংলাদেশী নাগরিককে। খবরটা বেদনাদায়ক হলেও নতুন নয়। তবু অনেক বেশি আহত করল জাতীয় দিবসে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সারাদিন বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাতে এমন ঘটনায় সবকিছুকে মাটি মনে হয়। সীমান্তে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কারণে দেশের মানুষ সত্যি জানতে চায়, ভারত বাংলাদেশকে বন্ধু দূরের কথা, আদৌ মানুষ মনে করে কিনা! ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে গত ১০ বছরে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের তিনশোর বেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। অথচ পৃথিবীর যে কোন রাষ্ট্রের সীমান্তে একজন নাগরিকের হত্যাও বিশাল বড় শিরোনাম হয়। এমনকি একজন নাগরিকের মৃত্যুর কারণে পুরো কূটনৈতিক সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন করা হয়।

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক : আস্থা যেভাবে ছাইয়ে পরিণত হচ্ছে

যেকোনো প্রতিবেশী দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। এ আস্থা হঠাৎ এক দিনে বা আপনা–আপনি গড়ে ওঠে না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্যের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রতি একরকম আস্থা তৈরী হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তা ধাক্কা খেয়েছিল। তারপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভ এবং এর পরপরই গঙ্গার পানি চুক্তি, এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠে নতুনভাবে আস্থা ও প্রত্যাশার আবহ তৈরি করেছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিগত ১২ বছরে চোখ বন্ধ করে ভারতকে নানামুখী সহযোগিতার বিনিময়ে ভারতের উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিদানই দৃশ্যমান হয়নি। সবকিছুর উপরে আছে কদিন পরপরই বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা। আর ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকদের এসব নির্বিচার হত্যার নির্লজ্জ সাফাই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ সালে ২৪ জন, ২০১২ সালে ২৪ জন, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন ও ২০১৯ সালে ৩৪ জন বাংলাদেশী নাগরিককে ভারতীয় বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে।

এসবের কারণে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক যতটুকুই থাকুক, জনগণের সাথে সম্পর্ক ঠেকেছে তলানিতে। এর পাশাপাশি ভারতের সরকারি সমর্থনে মুসলিমবিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক জনগণ মোটেই ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। বরং তারা কঠোরভাবে এর নিন্দা করেছেন এমনকি ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের আহ্বানও জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের উদারতা: চাওয়া মাত্রই পেয়ে যায় ভারত

আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনকালে বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য সূচিত হয়েছিল দীর্ঘকাল অমীমাংসিত গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ভারতের পক্ষে মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল নিরাপত্তা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে ভারতের প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের সহায়তা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সহায়তায় এ সমস্যা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়। বিদ্রোহীদের আশ্রয়স্থলগুলো ভেঙে দেওয়া হয় এবং পালিয়ে থাকা বিদ্রোহী নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ভারতের অপর চাওয়া ছিল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ট্রানজিট, এসব রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যা ছিল অপরিহার্য। জল, স্থল ও সমুদ্রপথে এ সুবিধা ভারতকে দিয়েছে বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণও ক্রমবর্ধমান। তবে বাণিজ্যের ভারসাম্য বিপুলভাবে ভারতের অনুকূলে। বিদ্যুৎ আমদানি ও উৎপাদনে পারস্পরিক স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তৎপরতা চলমান আছে।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১৬ লাখ পর্যটক ভারত সফরে যান। এই পর্যটকেরা বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর ভারতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত করেন। এছাড়া বাংলাদেশে লাখ লাখ তরুণ চাকরির অভাবে বেকার বসে থাকলেও ভারতীয়রা সেই কোটা দখল করে। কী পরিমাণ ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করছে, তার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা না হলেও ভারতের রেমিট্যান্সই সেটা বলে দিচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী ভারতের রেমিট্যান্সের চতুর্থ বা পঞ্চম বৃহত্তম উৎস হল বাংলাদেশ। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রেমিট্যান্স যদি বাংলাদেশ থেকে যায়, তাহলে বোঝা যায় আনুমানিক কত লক্ষ ইন্ডিয়ান এ দেশে ঢুকে আছে। অপ্রাপ্তি আর অসন্তোষের দীর্ঘ তালিকা বাংলাদেশের ভারতের প্রতি এমন বিরল বদান্যতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অপ্রাপ্তি, অসন্তোষের তালিকা বেশ দীর্ঘ।

গঙ্গার পানি চুক্তি যে প্রত্যাশার পরিবেশ তৈরি করেছিল, বিগত ২৪ বছরে তা দিগন্তরেখায় প্রায় অদৃশ্য। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি পেছাতে পেছাতে এখন তালিকা থেকেই বাদ পড়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে তিস্তার পুরো পানিই ব্যবহার করছে ভারত। ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজার বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েও আবার অশুল্ক বাধার বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্বের রাষ্ট্রসমূহে ট্রানজিট সুবিধা হাসিল করেছে ভারত, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য পরিবহনে শিলিগুড়ি করিডরের ১৪ মাইল দূরত্ব কমছে না কিছুতেই। তবে বাংলাদেশকে একেবারে কিছুই দেয়নি ভারত — তাও বলা যায় না। এই তো গতমাসে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশটি ঘোড়া আর দশটি কুকুর উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে। এর আগে ১০ টি রেল ইঞ্জিনও গিফট দিয়েছিল ভারত।

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে গুরুতর যে সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ, সেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে অপরাধী মিয়ানমারের প্রতি ভারতের পরোক্ষ সমর্থন মানুষকে বেদনাহত করেছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইনে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা বাংলাদেশের জনগণ বা সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আসামের নাগরিকপঞ্জিতে বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী ভারতীয়র গায়ে বিদেশি তকমা লাগানো হয়েছে। ভারত এটাকে তার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলছে। সরকারিভাবে বাংলাদেশ তা মেনেও নিয়েছে। কিন্তু এই ‘বিদেশি’রা কোন দেশ থেকে ভারতে এসেছে, সে প্রশ্ন ডেমোক্লিসের তরবারির মতো বাংলাদেশের মাথার ওপর ঝুলে আছে। সবচেয়ে যা আহত করেছে বাংলাদেশের মানুষকে, তা হচ্ছে ভারতীয় উচ্চ নেতৃত্বের অবস্থানে থেকে কথিত ‘বাংলাদেশি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’দের বিষয়ে অপমানকর বাক্য প্রয়োগ। সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে যাচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। এবং এর পক্ষে নানা খোঁড়া যুক্তি দেখিয়েই যাচ্ছেন ভারতের রাজনীতিক ও কূটনীতিকেরা।

সরকারি ভাষ্যে প্রীতিকর শব্দাবলী: জনগণ আর গিলছে না

দুই দেশের সরকারি ভাষ্যে যতই প্রীতিকর শব্দাবলি ব্যবহার করা হোক না কেন, এ প্রতিদানের অভাব বাংলাদেশের মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে মুসলিমবিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। এসবের কারণে ভারত বিরোধী মনোভাব চাঙা হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রতিবেশীর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের বাস্তব ঘাটতির কারণেই এটা হচ্ছে। টেকসই ভালো প্রতিবেশিত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য এ ঘাটতি পূরণে ভারতকে মনোনিবেশ করতে হবে।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘পাকিস্তান বনাম ভারতের যুদ্ধ’ বলে যে অপপ্রচার ভারতীয় অনেক রাজনীতিবিদরা করছেন, তাও বন্ধ করতে হবে। এই অপপ্রচার আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অস্বীকার করছে। আমাদের অস্তিত্বকে দিচ্ছে প্রকাশ্য হুমকি। মনে রাখতে হবে, হাজারো শহীদের রক্তের ওপর সার্বভৌমত্বের যে ভিত্তি বাঙালি জাতি রচনা করেছিল, নতুন কোন শক্তির কাছে ক্ষুণ্ন হতে না দেওয়াই সে বিজয়ের মূল চেতনা।

-এনটি

পূর্ববর্তি সংবাদ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৬ মৃত্যু, শনাক্ত ১১৩৪, সুস্থ ২২৩৯
পরবর্তি সংবাদশার্লি এবদোয় হামলাকারীদের সহায়তার দায়ে বিভিন্ন মেয়াদে ১৪ জনের কারাদণ্ড