ঈমান পরীক্ষা করার সহজ কয়েকটি উপায়

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক ।।

মানুষের জন্য ঈমানের চেয়ে বড় কোনো নেয়ামত নেই। আমরা এই নেয়ামতের কারণে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারী করি এবং এর সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী মেহনত করি।

আমাদের প্রত্যেকের উচিত  মাঝে মধ্যে নিজের ঈমান পরীক্ষা করা, যে -আল্লাহ না করুন- আমাদের ঈমান শুধু মৌখিক জমা খরচ নয় তো। এমন তো নয় যে, আমাদের ঈমান শুধু নামকে ওয়াস্তের, যা ‘গ্রহণযোগ্য ঈমান’এর মানদন্ডে উত্তীর্ণই হয় না! আল্লাহ না করুন, যদি বাস্তব অবস্থা এমন হয় তাহলে এখনই নিজের ইসলাহ ও সংশোধন আরম্ভ করা উচিত।

মনে রাখতে হবে, মৌলিকভাবে ঈমান যাচাইয়ের দুইটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায় : আমার ঈমান ঠিক আছে কি না। দ্বিতীয় পর্যায় : সবলতা ও দুর্বলতার বিচারে আমার ঈমানের অবস্থান কোথায়।

এখানে শুধু প্রথম পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কথা নিবেদন করছি। এর জন্য নিম্নোক্ত উপায়গুলো ব্যবহার করা অধিক সহজ :

আমার মাঝে কোনো কুফরী আকীদা নেই তো?

প্রথম কাজ এই যে, আমাদেরকে ইসলামী আকাইদ সঠিকভাবে জানতে হবে এবং চিন্তা করতে হবে আমার মধ্যে ঐসব আকীদার পরিপন্থী কোনো কিছু নেই তো? যদি থাকে তাহলে আমাকে তৎক্ষণাৎ তাওবা করতে হবে এবং ইসলামী আকীদার পরিপন্থী এই মতবাদকে বাতিল ও কুফরী বিশ্বাস করে এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে।

কুরআন কারীমে মুশরিকদের, আখিরাতে অবিশ্বাসীদের, ইহুদি, নাসারা, মুনাফিকদের, পার্থিবতাবাদী, বেদ্বীন,
নাস্তিকচক্রসহ সকল ভ্রান্ত মতবাদের খন্ডন বিদ্যমান রয়েছে। চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করে কিংবা কোনো নির্ভরযোগ্য তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তাফসীরের সাহায্যে কুরআন পাঠ করে এবং প্রয়োজনে কোনো আলিমের কাছে সবক পড়ে কাফিরদের প্রত্যেক শ্রেণীর বাতিল আকীদা সম্পর্কে জেনে নিজেদের বোধ-বিশ্বাসের পরীক্ষা নেয়া কর্তব্য যে, আমার মধ্যে ঐসবের কোনো কিছু নেই তো?

আমার মধ্যে নিফাক নেই তো?

নিফাকের বিভিন্ন প্রকার আছে। এক. বিশ্বাসগত নিফাক। এ প্রবন্ধে এ নিয়েই আলোচনা করা উদ্দেশ্য। বিশ্বাসগত নিফাকের অর্থ, অন্তরে কুফরী মতবাদ বা ইসলাম বিদ্বেষ লালন করেও কথা বা কাজে মুসলিম দাবি করা। বিশ্বাসগত নিফাক হচ্ছে কুফরীর এক কঠিনতম প্রকার। এটা যার মধ্যে আছে সে সরাসরি কাফির। তবে যথাযথ দলীল-প্রমাণ ছাড়া কারো বিষয়ে নিফাকের সন্দেহ করা বা কাউকে নিফাকের অভিযোগে অভিযুক্ত করা জায়েয নয়। হ্যাঁ, যখন কারো কথা বা কাজের দ্বারা নিফাক প্রকাশিত হয়ে পড়ে, অন্তরে লালিত কুফরী আকীদা ও ইসলাম-বিদ্বেষ জিহবায়ও এসে যায় তখন তো এর বিষয়ে মুসলমানদের সাবধান হতেই হবে এবং সরকারকেও এই লোক সম্পর্কে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশ্বাসগত নিফাকের রূপগুলো কী কী কুরআন কারীমে তা ঘোষণা করা হয়েছে। সেগুলো জেনে নিজেকে যাচাই করা উচিত, আমার মধ্যে এসবের কোনো কিছু নেই তো?

বিশ্বাসগত নিফাকের বিভিন্ন রূপ আছে। কয়েকটি এই :

* ইসলামী শরীয়ত বা শরীয়তের কোনো বিধানকে অপসন্দ করা।

* ইসলামের, ইসলামের নবীর, ইসলামের কিতাবের, ইসলামী নিদর্শনের কিংবা ইসলামের কোনো বিধানের বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করা।

* ইসলামের কিছু বিশ্বাস ও বিধানকে মানা, আর কিছু না মানা।

* শরীয়তের কোনো বিধানের উপর আপত্তি করা বা তাকে সংস্কারযোগ্য মনে করা।

* ইসলামের কোনো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন আকীদা বা বিধানের অপব্যাখ্যা করা।

শাআইরে ইসলামের বিষয়ে আমার অবস্থান কী?

শাআইরে ইসলামকে ‘শাআইর’ এজন্য বলা হয় যে, তা ইসলামের চিহ্ন। প্রধান ‘শাআইর’ এই : এক. ইসলামের কালিমা, দুই. আল্লাহর ইবাদত (বিশেষত নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব) তিন. আল্লাহর রাসূল, চার. আল্লাহর কিতাব, পাঁচ. আল্লাহর ঘর কা’বা, অন্যান্য মসজিদ ও ইসলামের অন্যান্য পবিত্র স্থান, বিশেষত মসজিদে হারাম, মিনা, আরাফা, মুযদালিফা, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববী। ছয়. হজ্বে কুরবানীর জন্য নির্ধারিত ঐ পশু, যাকে ‘হাদী’ বলে। কুরআন মজীদে (২২ : ৩২, ৩০) আল্লাহ তাআলা ইসলামের শাআইর (নিদর্শনাবলী) কে ‘শাআইরুল্লাহ’ ও ‘হুরুমাতুল্লাহ’ নামে ভূষিত করেছেন। এবং এই নিদর্শনগুলোর মর্যাদা রক্ষার আদেশ করেছেন। আর ইরশাদ করেছেন, এগুলোর মর্যাদা রক্ষা প্রমাণ করে, অন্তরে তাকওয়া আছে, আল্লাহর ভয় আছে।

নিজের ঈমান যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় এই যে, আমি আমার অন্তরে খুঁজে দেখি, নিজের কথা ও কাজ পরীক্ষা করে দেখি আমার মাঝে শাআইরে ইসলামের ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে কি না। তদ্রূপ কেউ শাআইরুল্লাহর অবমাননা করলে আমার কষ্ট হয় কি না। এমন তো নয় যে, কেউ শাআইরের অবমাননা করছে, আর আমি একে তার ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে নিরব ও নির্লিপ্ত থাকছি? না আমার কষ্ট হচ্ছে, না এই অশোভন আচরণ সম্পর্কে আমার মনে ঘৃণা জাগছে, আর না এই বেআদবের বিষয়ে আমার অন্তরে কোনো বিদ্বেষ, না তার থেকে ও তার কুফরী কার্যকলাপ থেকে বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদের) কোনো প্রেরণা!!

আল্লাহ না করুন, শাআইরের বিষয়ে এই যদি হয় আচরণ অনুভূতি তাহলে ঐ সময়ই নিশ্চিত বুঝে নিতে হবে, এ অন্তর ঈমান থেকে একেবারেই শূন্য। সাথে সাথে সিজদায় পড়ে যাওয়া উচিত এবং তওবা করে, সর্বপ্রকার কুফর ও নিফাক থেকে ভিন্নতা ঘোষণার মাধ্যমে ঈমানের নবায়ন করা উচিত।

আমার অন্তরে অন্যদের শাআইরের প্রতি ভালবাসা নেই তো?

ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্ম এবং দ্বীন ও আখিরাত-অস্বীকার সম্বলিত সকল ইজম সম্পূর্ণ বাতিল ও ভ্রান্ত। এদেরও ‘শাআইর’ ও নিদর্শন আছে, মিথ্যা উপাস্য ও আদর্শ আছে, যেগুলোর কোনো সারবত্তা নেই। কিন্তু ইসলাম এই সবের উপহাস ও কটুক্তিরও অনুমতি নিজ অনুসারীদের দেয় না। এক তো এ কারণে যে, তা ভদ্রতা ও শরাফতের পরিপন্থী, এছাড়া এজন্যও যে, একে বাহানা বানিয়ে এরা ইসলামের সত্য নিদর্শনের অবমাননা করবে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ مَرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থ : আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদেরকে ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে; এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি অতঃপর তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন। অনন্তর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকার্য সম্বন্ধে অবহিত করবেন। (আল আনআম ৬ : ১০৮)

তো অন্যান্য কওমের রব, ইলাহ ও শাআইরের উপহাস ও কটূক্তি থেকে বিরত থাকা ইসলামের শিক্ষা, যা স্বস্থানে ইসলামী আদর্শের এক উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্যের দিক। কিন্তু এর অর্থ কখনো এই নয় যে, তাদের রব ও মাবুদের (যা নিঃসন্দেহে অসার ও অসত্য) এবং এদের শাআইর ও নিদর্শনের (যা পুরোপুরি কল্পনা ও কুসংস্কার প্রসূত) সমর্থন ও সত্যায়ন করা হবে কিংবা এগুলোর প্রশংসা ও  মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হবে কিংবা অন্তরে আবেগ ও ভক্তি পোষণ করা হবে। কারণ এ তো সরাসরি কুফর। যদি তা বৈধ ও অনুমোদিত হয় তাহলে তো এরপরে ঈমান ও ইসলামের কোনো প্রয়োজনই অবশিষ্ট থাকে না। আর না উপরোক্ত বিশ্বাস ও কর্মের পরও ঈমানের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়। ভালোভাবে বোঝা উচিত, কোনো কিছুর কটূক্তি-অবজ্ঞা থেকে বিরত থাকার অর্থ এই নয় যে, ঐ বিষয়কে সম্মান করতে হবে বা সত্য মনে করতে হবে। তো কুফরের শাআইরের সম্মান বা ভালবাসা হচ্ছে পরিষ্কার কুফর।

আজকাল কিছু মানুষ দেখা যায়, যাদের দৃষ্টিতে নিজেদের তথা ইসলামী শাআইরের তো বিশেষ মর্যাদা নেই, এগুলোর অবমাননাও তাদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না। অথচ এরাই একাত্মতা প্রকাশ করে অন্যদের শাআইরের বিষয়ে। এরা অন্যদের ধর্মীয় উৎসবেও যোগদান করে এবং একে গৌরবের বিষয় মনে করে। একে তারা আখ্যা দেয় ‘সৌজন্য’ ও ‘উদারতা’র চিহ্ন বলে। তাদের জানা নেই, এটা সৌজন্য ও উদারতা নয়, এ হচ্ছে সত্য দীনের বিষয়ে শিথিলতা ও হীনম্মন্যতা এবং আপন জাতির সাথে বড় হীন ও গায়রতহীন আচরণ। হায়! তারা যদি বুঝত যে, কুফর ও শাআইরে কুফরের প্রীতি-আকর্ষণ, এসবের সাথে একাত্মতা প্রকাশ এবং এসবের ভক্তি-উপাসনায় সন্তোষ বা আনন্দ প্রকাশও সরাসরি কুফর।

এই শ্রেণীর মানুষের মনে রাখা উচিত, কুরআনে কারীমের আয়াত

إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ

অর্থ : … তাহলে তো তোমরাও তাদের মত হবে। (৪ : ১৪০)

এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ –

من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থ : যে কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।

মোটকথা, নিজের ঈমানের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা যাচাইয়ের অন্যতম উপায় এ চিন্তা করা যে, অন্তরে বেদ্বীন সম্প্রদায়ের এবং দীন ইসলামের বিদ্রোহীদের শাআইর-নিদর্শনের সমর্থন বা প্রীতি-আকর্ষণ নেই তো। যদি থাকে তাহলে তওবা করে নিজেকে সংশোধন করবে, আল্লাহ তাআলার কাছে শাআইরুল্লাহর ভক্তি-ভালবাসা এবং শাআইরুল্লাহর সংরক্ষণ ও সমর্থনের তাওফীক প্রার্থনা করবে। কুফরের শাআইরের প্রতি ঘৃণা ও সেগুলোর অসারতার বিষয়ে প্রত্যয় ও প্রশান্তি প্রার্থনা করবে।

পসন্দঅপসন্দের ক্ষেত্রে আমার নীতি উল্টা না তো?

জগতে পসন্দ-অপসন্দের অনেক মানদন্ড আছে। মানুষের স্বভাবটাই এমন যে, এতে সৃষ্টিগতভাবেই কিছু বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে আর কিছু বিষয়ে অনাগ্রহ ও বিমুখতা বরং ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কিন্তু কেউ যখন ইসলাম কবুল করে এবং ঈমানের সম্পদ লাভ করে তখন তার হাতে এসে যায় পসন্দ-অপসন্দের প্রকৃত মানদন্ড। সে মানদন্ড হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর প্রদত্ত শরীয়ত। সুতরাং যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পসন্দনীয় এবং শরীয়তে কাম্য তা মুমিনের কাছে অবশ্যই পসন্দনীয় হবে যদিও অন্য কোনো মানদন্ডে লোকেরা তা পসন্দ না করুক, কিংবা স্বয়ং তার কাছেই তা স্বভাবগতভাবে পসন্দের না হোক। আর যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে অপসন্দের এবং শরীয়তে নিষিদ্ধ তা তার কাছে অবশ্যই অপসন্দনীয় হবে যদিও অন্য কোনো মানদন্ডে লোকেরা তা পসন্দনীয় মনে করে কিংবা স্বভাবগতভাবে তার নিজেরও ঐ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে। মুমিন সর্বদা নিজের পসন্দ-অপসন্দকে দ্বীন ও ঈমানের দাবির অধীন রাখে। সে তার স্বভাবের আকর্ষণকে আল্লাহ তাআলার রেযামন্দির উপর কোরবান করে।

এজন্য ঈমান যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় যে, নিজের অন্তরকে পরীক্ষা করা তাতে পসন্দ-অপসন্দের মানদন্ড কী। আল্লাহ, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শরীয়তের পসন্দ-অপসন্দ, না প্রবৃত্তির চাহিদা, নিজের গোত্র, দল, দলনেতা, পার্থিব বিচারে মর্যাদাবান শ্রেণী, শুধু শক্তির জোরে প্রবল জাতিসমূহের সংস্কৃতি, সাধারণের মতামত, পার্থিব জীবনের চাকচিক্য কিংবা এ ধরনের আরো কোনো কিছু?

যদি তার কাছে মানদন্ড হয় প্রথম বিষয়টি তাহলে আল্লাহর শোকর গোযারী করবে আর যদি মানদন্ড হয় দ্বিতীয় বিষয়গুলো তাহেল খালিস দিলে তওবা করবে। নিজের পসন্দকে আল্লাহ ও তাঁর বিধানের অধীন করবে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উসওয়ায়ে হাসানার (শরীয়ত ও সুন্নতের) অনুগামী করবে এবং ঈমানের তাজদীদ ও নবায়ন করবে।

নিজের ইচ্ছা বা পছন্দের কারণে ঈমান ছাড়ছি না তো?

নিজের ইচ্ছা ও চাহিদা, স্বভাব ও রুচি-অভিরুচি, আত্মীয়তা ও সম্পর্কের আকর্ষণ ইত্যাদির সাথে যে পর্যন্ত ঈমানের দাবিসমূহের সংঘর্ষ না হয় ঐ পর্যন্ত ঈমানের পরীক্ষা হয় না। ঐ সকল বিষয়ের দাবি আর ঈমান-আকীদার দাবির মধ্যে একটিকে গ্রহণ করার পরিস্থিতি তৈরি হলেই ঈমানের পরীক্ষা হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিই হচ্ছে মুমিনের ঈমানী পরীক্ষার মুহূর্ত। আল্লাহ তাআলা বান্দার ঈমান পরীক্ষার জন্য, মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য করার জন্য এমনসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন এবং দেখেন, পরীক্ষায় কে সত্য প্রমাণিত হয়, কে মিথ্যা, কার ঈমান খাঁটি সাব্যস্ত হয়, কার ঈমান নামকেওয়াস্তে।

মুমিনের কর্তব্য, এই পরীক্ষার মুহূর্তে পূর্ণ সতর্ক থাকা। যেহেতু এসব ক্ষেত্রে দুটোকে গ্রহণের সুযোগ নেই তাই অবশ্যই তাকে কোনো একটি দিক প্রাধান্য দিতে হবে। এই প্রাধান্যের ক্ষেত্রে তাকে প্রমাণ দিতে হবে ঈমানের। যদি সে আল্লাহ, রাসূল, হিদায়েতের কিতাব, এবং দীন ও শরীয়তকে প্রাধান্যের মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করে এবং ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহের বিপরীতে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদা, স্বভাবগত পসন্দ-অপসন্দ এবং আত্মীয়তা ও সম্পর্কের আকর্ষণ ও দুর্বলতাকে জয় করতে পারে তাহলে সে আল্লাহর কাছে সফল ও ঈমানী পরীক্ষায় কামিয়াব। পক্ষান্তরে যদি সে নিজের স্বভাব, কামনা-বাসনা ও পার্থিব সম্পর্ককে প্রাধান্যের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে আর এসবের খাতিরে ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহের কোরবান করে তাহলে সে ব্যর্থ ও ঈমানী পরীক্ষায় নাকাম। তার নিশ্চিত জানা উচিত, তার ঈমান শুধু নামকে ওয়াস্তের, অন্তর নিফাক দ্বারা পূর্ণ।

আল্লাহকে হাকিম  বিধানদাতা মেনে নিতে আমার মনে কোনো দ্বিধা –নাউযুবিল্লাহ– নেই তো?

এক তো হচ্ছে বর্তমানকালের বাস্তবতা যা আমাদেরই কর্মফল যে, ভূপৃষ্ঠের কোনো অংশ এমন নেই যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিধান কার্যকর, কিন্তু মুমিনমাত্রের জানা আছে যে, মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত অবস্থা এ নয়, মুসলিম উম্মাহ তো পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও শরীয়তের অধিকারী। যাতে বড় একটি অংশ রয়েছে রাজ্য-শ্বাসন বিষয়ক। উম্মাহর নেতৃত্ব ও পরিচালনা যাদের উপর ন্যস্ত তাদের ফরয দায়িত্ব ঐ নীতি ও বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, আমর বিল মারূফ, নাহি আনিল মুনকার (সকল মন্দের প্রতিরোধ ও প্রতিাবদ), ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ’ (নববী আদর্শ অনুযায়ী যমীনে খেলাফত পরিচালনা করা)-এর দায়িত্ব পালন করা, ইসলামী হদ, কিসাস ও তাযীর (দন্ডবিধি) কার্যকর করা, সাধ্যানুযায়ী ইসলামী জিহাদের দায়িত্ব পালন করা, রাষ্ট্র পরিচালনা (আইন-বিচার, নির্বাহী) এর ক্ষেত্রে নতুন-পুরাতন জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান এবং নতুন-পুরাতন সকল তাগূতি ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে ইসলামী বিধি-বিধানের আনুগত্য করা।

কোনো মুসলিম ভূখন্ডে শাসকদের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র হচ্ছে, যেখানে কুরআন-সুন্নাহ নিশ্চুপ এবং ইজমায়ে উম্মত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের ঐকমত্যপূর্ণ ফয়সালায় যার নজির নেই। অন্যভাষায়, নবউদ্ভূত ইজতিহাদী প্রসঙ্গসমূহ, মোবাহ ক্ষেত্রসমূহ এবং ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াদি (যা মোবাহ বিষয়াদিরই অন্যতম বড় অংশ)-এই তিনটি ক্ষেত্রেই মুসলিম শাসকদের আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হতে পারে এবং এর অবকাশও তাদের আছে।

আর এর প্রথমটি অর্থাৎ নবউদ্ভূত ইজতিহাদী প্রসঙ্গসমূহের বিধানও সমসাময়িক ফকীহগণের উপর ন্যস্ত করা অপরিহার্য।

যেসব বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত নির্দেশনা আছে সেখানে হুবহু ঐ শিক্ষা ও নির্দেশনার অনুসরণ করা ও তা কার্যকর করা জরুরি। এসব বিষয়ে নতুন আঙ্গিকে বিন্যাস ও সংকলনের কাজ হতে পারে, কিন্তু তা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই। তদ্রূপ সেসব থেকে বিমুখ হয়ে আলাদা আইন প্রণয়ন কিংবা তার স্থলে মানব রচিত (যে-ই হোক এর রচয়িতা) কোনো আইন গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। কেউ এমনটা করলে যদি নিজেকে অপরাধী মনে করে, অন্তরে আল্লাহর প্রতি, আখিরাতের প্রতি, তাঁর রাসূল, তাঁর কিতাব, তাঁর বিধান ও শরীয়তের প্রতি ঈমান থাকে, আর তার উপলব্ধি এই থাকে যে, আল্লাহর বিধান অনুসারেই রাজ্য পরিচালনা করা ফরয, এতেই আছে কল্যাণ ও কামিয়াবি কিন্তু ঈমানী কমযোরি ও বুযদিলির কারণে আমি তা করতে পারছি না। তাহলে অন্তরে ঈমান থাকার কারণে এবং ঐ হারাম কাজে নিজেকে অপরাধী মনে করার কারণে তার উপর কাফির-মুনাফিকের হুকুম আরোপিত হবে না। পক্ষান্তরে অবস্থা যদি এই হয় যে, আল্লাহর বিধান তার পসন্দ নয়, ইসলামকে সে ঘর ও মসজিদে আবদ্ধ রাখতে চায়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের নেতৃত্বে তার ঈমান নেই, আসমানী বিধিবিধানের উপর মানব রচিত আইন-কানুনের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই তার এই কর্ম ও অবস্থান সরাসরি কুফর। আর এই কুফরের সাথে কথায় বা আচরণে ঈমানের দাবি সরাসরি নিফাক ও মুনাফেকী।

জ. আমি সাবীলুল মুমিনীন থেকে বিচ্যুত হচ্ছি না তো?

সর্বশেষ কথা এই যে, কুরআন-সুন্নাহয় সিরাতে মুসতাকীম ও হেদায়েতের উপর অবস্থিত নাজাতপ্রাপ্ত লোকদের পথকে ‘সাবীললু মুমিনীন’ বলা হয়েছে এবং এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

অর্থ : কারো কাছে সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস! (আন নিসা ৪ : ১১৫)

এ কারণে নিজের ঈমান যাচাইয়ের সহজ পথ, নিজের আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা এবং জীবন ও কর্ম নিরীক্ষা করা। যদি এতে কোনো কিছু ‘সাবীলুল মুমিনীন’ (মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ রাস্তা)-এর বিপরীত চোখে পড়ে তাহলে খাঁটি দিলে তওবা করে শুযূয ও বিচ্ছিন্নতা থেকে ফিরে আসব এবং ‘সাবীলুল মুমিনীন’ (মুমিনদের রাস্তায়) চলতে থাকব। যার দ্বিতীয় নাম ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহা-বী’। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ঐ রাস্তার উপর দৃঢ়পদ রাখুন। আমীন।

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ

ঝ. দল ও দলনেতা আখেরাতে কাজে আসবে না

যে কেউ দুনিয়াতে ‘সাবীলুল মুমিনীন’ থেকে আলাদা থাকবে সে আখেরাতে আফসোস করতে থাকবে :

وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا l يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا l لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولًا

অর্থ : জালিম ব্যক্তি সেইদিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায়, দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম, আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে উপদেশ আসার পর। শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক। (আলফুরকান ২৫ : ২৭-২৯)

إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا l خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا l يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا l وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا l رَبَّنَا آَتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا

অর্থ : আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জ্বলন্ত অগ্নি; সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং তারা কোন অভিভাবক এবং সাহায্যকারী পাবে না যেদিন তাদের মুখমন্ডল আগুনে উলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে, ‘হায়, আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম!’ তারা আরো বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল; ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে দাও মহাঅভিসম্পাত। (আলআহযাব ৩৩ : ৬৪-৬৮)

কিন্তু জবাব পাওয়া যাবে যে,

قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لَا تَعْلَمُونَ

অর্থ : আল্লাহ বলবেন, ‘প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না। (আলআ’রাফ ৭ : ৩৮)

এবং নেতারা বলবে :

فَمَا كَانَ لَكُمْ عَلَيْنَا مِنْ فَضْلٍ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْسِبُونَ

অর্থ : আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সুতরাং তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন কর। (আলআরাফ ৭ : ৩৯)

তওবার দরজা খোলা আছে

মওত হাজির হলে তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই সংশোধনের সময়, খাঁটি তওবা করলে আল্লাহ তাআলা কুফর-শিরক ও নিফাকসহ বড় বড় অপরাধও মাফ করে দেন। শর্ত হচ্ছে, ‘তাওবায়ে নাসূহ’ খালিস তওবা, যে তওবাতে সকল প্রকার কুফর শিরক মুনাফেকী বর্জনের পাশাপাশি সকল প্রকার গুনাহ থেকে বাচার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও কর্ম সংশোধন এবং সাধ্যমত অতীত জীবনের ক্ষতিপূরণও শামিল :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَنْ تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُبِينًا l إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا l إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللَّهِ وَأَخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ فَأُولَئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ وَسَوْفَ يُؤْتِ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ أَجْرًا عَظِيمًا l مَا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَآَمَنْتُمْ وَكَانَ اللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا

অর্থ : হে মুমিনগণ! মুমিনগণের পরিবর্তে কাফিরগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহকে তোমাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ দিতে চাও? মুনাফিকগণ তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য কখনো কোন সহায় পাবে না। কিন্তু যারা তওবা করে, নিজেদেরকে সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের দ্বীনে একনিষ্ঠ থাকে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনগণকে আল্লাহ অবশ্যই মহাপুরস্কার দিবেন। তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান আন তবে তোমাদের শাস্তিতে আল্লাহর কি কাজ? আল্লাহ পুরস্কারদাতা সর্বজ্ঞ। (আননিসা ৪ : ১৪৪-১৪৭)

মাসিক আল কাউসার থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত

ইজে

পূর্ববর্তি সংবাদভারতে ‘রহস্যময়’ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৩০০
পরবর্তি সংবাদচাপে ফেলতে হেফাজত নেতাদের মামলাগুলো ফের সচল করা হচ্ছে