রাসূল-অবমাননা : সভ্যতার মুখোশধারীদের আসল চেহারা

মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ ।।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ও তাঁর কালজয়ী আদর্শ পশ্চিমা বিশ্বকে এমনই বেসামাল করে রেখেছে যে, ওরা নিজেরাই ওদের ভিতরের কলুষ-কালিমা উন্মোচিত করে দিচ্ছে। একের পর এক তারা ঘটিয়ে চলেছে চরম ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক সব ঘটনা, যা কোনো সভ্য-সমাজে কল্পনা করাও দুষ্কর। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এগুলো কোনো মানসিক ভারসাম্যহীন, বিকৃত মস্তিষ্ক লোকের দ্বারা অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; বরং একটি জাতিকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও বিপর্যস্ত করার জন্য এবং তাদেরকে তাদের সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটানো হচ্ছে। বারবার ছক ধরে আঘাত করা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ্র সবচেয়ে ভক্তি-ভালবাসার জায়গাটিতে। আশ্চর্য! ভদ্রতার মুখোশে মানুষ এত অভদ্রও হতে পারে?

পশ্চিমের এসকল কর্মকা- স্পষ্ট প্রমাণ করছে যে, একবিংশ শতকের ইউরোপ যান্ত্রিক উন্নয়নে অনেকদূর অগ্রসর হলেও সত্যিকারের ভদ্রতা ও শালীনতা তারা আজও শিখতে পারেনি। নৈতিকতা ও মানবিকতার ক্ষেত্রে তারা এখনো বন্দী হয়ে আছে তাদের হাজার বছরের পুরানো অতীতে। তাদের জীবনের ঐসব ক্ষেত্রে এখনো পৌঁছেনি জ্ঞান ও সভ্যতার আলো। এই শূন্যতা ওরা কীভাবে পূরণ করবে? ওরা তা পূরণ করতে চায় অনাচার ও মিথ্যাচার দ্বারা।

কে না জানে যে, বর্তমান বিশ্বে মুসলিমদেরকে বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা এখন সবচেয়ে বিপর্যস্ত। তবু তারাই কেন পশ্চিমাদের চক্ষুশূল? কেন তাদেরকেই আরো বিপর্যস্ত করার এই প্রাণান্ত প্রয়াস?

কারণ, একমাত্র মুসলিমজাতির অধিকারেই আছে ঐ আবে হায়াত-কুরআন ও সুন্নাহ, যা মানবতার সবচেয়ে বড় সম্পদ। যুগে যুগে যা মানবজাতির মাঝে প্রাণের সঞ্চার করেছে। মূর্খতা ও বর্বরতার অন্ধকার থেকে বের করে এনেছে এমন এক নূরানী মানব-কাফেলা, যাঁদের হৃদয় ও মস্তিষ্কের আলো থেকে দিকে দিকে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে চিন্তা ও কর্মের অসংখ্য প্রদীপ। পশ্চিমের দুর্ভাগ্য যে, ওরা এই শাশ্বত আলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আল্লাহ্র নূরকে ওরা নিভিয়ে দিতে চায় অনাচার-অপপ্রচারের দ্বারা, সন্ত্রাস, হত্যা, লুণ্ঠন ও আগ্রাসনের দ্বারা। যে কোনো উপায়ে ওরা চায় মানবজাতিকে ইসলামের কল্যাণ আদর্শ থেকে বিচ্যুত-বিভ্রান্ত-বীতশ্রদ্ধ করতে।

এইসকল ঘটনা প্রমাণ করে আলকুরআনের বিধান ও বিবরণের যথার্থতা। কুরআন মাজীদে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে ইয়াহূদ-জাতির পরিচয় ও জাতীয় বৈশিষ্ট্য। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যারা সর্বদা অভ্যস্ত ছিল আসমানী পয়গামের বিরোধিতায় এবং আল্লাহ্র নবী-রাসূলগণের অবাধ্যতায়। এমনকি এদের জাতীয় ইতিহাস কালিমালিপ্ত হয়ে আছে আল্লাহ্র নবী-রাসূলগণের হত্যার ঘটনায়। হযরত ঈসা আ.-কেও এদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে। পরিশেষে আল্লাহ নিজ কুদরতে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। এরপর গোটা খ্রিস্টধর্মই বিকৃত হয়ে গেছে ইহুদী সেন্ট পলের মাধ্যমে। পৃথিবীর জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরিহাস এই যে, বর্তমান খ্রিস্টজগৎ তাদের বিপুল জনসংখ্যা এবং আর্থিক ও সামরিক সক্ষমতা সত্ত্বেও তাদের চরম শত্রু ইহুদী-জাতির ক্রীড়নক ও পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হযরত ঈসা আ.-এর পর শেষ নবী, মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এলেন তখনও এরা ওদের জাতীয় চরিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। তাঁকে কষ্ট দেওয়ার কোনো সুযোগই এরা হাতছাড়া করেনি। ইসলামকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে নির্মূল করার কিংবা খ্রিস্টধর্মের মতো বিকৃত করার কোনো অপচেষ্টাই ওরা বাদ রাখেনি। কিন্তু ইসলাম তো আল্লাহ্র মনোনীত সর্বশেষ দ্বীন, যা কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবতার হেদায়েতের জন্য নাযিল হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এই দ্বীনের হেফাযতের ঘোষণা দান করেছেন। তাঁর এই ঘোষণা সত্য। যুগে যুগে মুসলমানদের চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তেও আল্লাহ তাআলা এই দ্বীনকে রক্ষা করেছেন এবং কিয়ামতের আগ পর্যন্ত রক্ষা করবেন। তাই ইসলামের বিরুদ্ধে ওদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে গেছে। আর ওদের দুষ্কৃতির চরম ফল ওদের ভুগতে হয়েছে যুগে যুগে।

বিশ্বব্যাপী ইসলাম-বিরোধী সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায় মুসলিম উম্মাহ ও তার নেতৃবৃন্দেরও অনেক বড় দায়িত্ব আছে। কুরআন মাজীদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তা বর্ণনা করেছে এবং সে দায়িত্ব পালনের উপর আল্লাহ তাআলার মদদ ও নুসরতের ওয়াদা ঘোষণা করেছে।

ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) ‘কাফিররা যেন মনে না করে যে, তারা পরিত্রাণ  পেয়েছে। তারা কখনোই মুমিনদের হতবল করতে পারবে না।

‘তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে। এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহ্র শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এছাড়া অন্যদেরকে, যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন।’ … -সূরা আনফাল (৮) : ৫৯-৬০

কুরআনের এই বাণী ও বিধান যে কত সত্য ও যথার্থ তা ইসলাম-বিদ্বেষী পশ্চিমের উপর্যুপরি ঘটিয়ে যাওয়া অনাচারগুলো থেকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।

কে না জানে, বর্তমান সময়টা যতটা না যুক্তির, তার চেয়েও বেশি শক্তির। এখন যুক্তি শোনা হয় শক্তিমানের, দুর্বলের নয়। কাজেই মুসলিম জাহানের শাসকদের উপলব্ধি করতে হবে যে, তাদের  যুক্তি তখনই ওরা শুনতে ‘আগ্রহী’ হবে, যখন যুক্তির পিছনে থাকবে শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা।

এখানে এ প্রশ্নও এসে যায় যে, মুসলিম উম্মাহ্র বিদ্যমান শক্তি ও সক্ষমতা কেন উম্মাহ্র স্বার্থে, ইসলাম ও ইসলামের নবীর মর্যাদা রক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে না? মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের দায়িত্বশীলগণ আল্লাহ্র কাছে এর কী জবাব দেবেন?

যারা শুধু ‘শান্তির কথা’ শুনতে ও শোনাতে চান তাদের উপলব্ধি করা উচিত, দুষ্টের দমন ছাড়া কখনো কোনো সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় না। ক্ষুদ্র-বৃহৎ উভয় সমাজের ক্ষেত্রেই তা সত্য। আর তাই শান্তির ধর্ম ইসলামে আলাদাভাবে আছে জিহাদ ও নাহি আনিল মুনকারের বিধান।

ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আবারো প্রমাণ করল যে, ‘আলকুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদা’-সকল কুফ্র এক ধর্ম আর সকল কাফির এক ধর্মের, এক সম্প্রদায়ের।  আর তাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় খ্রিস্ট-সমাজে, ইহুদী-সমাজে, নাস্তিক সমাজে এবং পৌত্তলিক সমাজে। ইসলাম-বিরোধী সাম্প্রদায়িকতায় এরা সব একজোট। সুতরাং এটাই এখন সত্য যে, ভাষা ও ভূখ-ের সকল বৈচিত্র্যের মাঝেও পৃথিবীতে বাস করে দুটোমাত্র সম্প্রদায় : মুসলিম এবং অমুসলিম। তাই আজ বড় প্রয়োজন, সকল বিভেদ-বৈচিত্র্য ভুলে ইসলাম ও ইসলামের নবীর মর্যাদার প্রশ্নে সকল  মুসলিমের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো এবং সীসাঢালা প্রাচীরের মতো প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

এসব ঘটনা আরো প্রমাণ করে, বর্তমান যুগের উদারতা-অসাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার ও পরমতসহিষ্ণুতার মতো শব্দগুলোর নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। এইসকল শব্দ ও পরিভাষা শক্তিমানের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারমাত্র।

মুসলিম জাহানে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ইতি ঘটলেও মুসলিম জনগণের প্রতি ‘আধুনিক’ ফ্রান্সের আগ্রাসী মানসিকতার ইতি ঘটেনি। গণতন্ত্র, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকার- ওদের এই শব্দগুলো মুসলমানদের ক্ষেত্রে যেন একেবারেই মূল্যহীন। নতুবা একটি অন্যায় উসকানীমূলক ঘটনার জেরে ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে, হত্যাকারীকে গুলি করে মেরে ফেলার পরও, গোটা দেশে সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননা ওদের মনগড়া মতবাদ অনুসারেও কীভাবে বৈধ হতে পারে?

কে সেই হত্যাকারী? কী এই হত্যাকাণ্ডের কারণ- এইসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণে না আনা; বরং এইসব অনুসন্ধানের পথ বন্ধ করে দেওয়া, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শেখানোর নামে ক্লাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যঙ্গ-কার্টুন প্রদর্শনকারী শিক্ষককে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের কী ব্যাখ্যা হতে পারে? এই ঘটনা ফ্রান্সের শিক্ষা-ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আইন-বিচার-প্রশাসন ও নির্বাহী বিভাগ পর্যন্ত সবকিছুকেই প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

এক পরিসংখ্যান অনুসারে ফ্রান্সে গত এক বছরের মধ্যেই এক হাজারেরও বেশি ইসলামোফোবিক ঘটনা ঘটেছে। ২২টিরও বেশি মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে। আর এবারের ঘটনা তো সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আগে যা হত ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে এখন তা-ই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে! আমরা জানি না, এই দুর্ভাগাদের আর কতটুকু সময় বাকি আছে। আল্লাহ তাআলার কাছে সবকিছুর সময় নির্ধারিত। আমাদের কর্তব্য, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আমাদের ঈমান ও মহব্বতকে সজীব ও শানিত করা। জীবন ও কর্মে তাঁর সুন্নাহ্র অনুসরণের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা। বিশ্বময় জীবনের সকল অঙ্গনে তাঁর সুমহান জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার মহান লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

পূর্ববর্তি সংবাদ১২ নভেম্বর ১৯৭০ : আল্লাহর কুদরতের সামনে মানুষ বড় অসহায়!
পরবর্তি সংবাদট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর থেকে পেন্টাগন কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক