হিজাব নিয়ে বিজ্ঞপ্তি: জনস্বাস্থ্যের পরিচালককে কেন টার্গেট করা হচ্ছে?

ওয়ারিস রাব্বানী ।।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক তার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোশাক বিষয়ে শালীনতা অবলম্বনের নির্দেশনা জারি করেছেন। ওই নির্দেশনায় দেখা গেছে, তিনি তার অফিসে কর্মরত মুসলিম নারীদের হিজাব পরা এবং মুসলিম পুরুষদের টাখনুর উপর কাপড় পরতে বিশেষভাবে আদেশ করেছেন। কিন্তু এজাতীয় আদেশের খবরে গণমাধ্যম ও ‘অতি চেতনাশীলদের’ একটি অংশকে উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।

তারা নানা রকম প্রশ্ন ও বাক্যবাণে জনস্বাস্থ্যের পরিচালক সাহেবকে বিদ্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর বুধবার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহীম তার অফিসে শালীন পোশাক ও ভদ্রোচিত জীবন-বিচরণ বজায় রাখার স্বার্থে একটি বিশেষ নির্দেশনায় বলেছেন, ‘অত্র ইনস্টিটিউটের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অফিস চলাকালীন সময়ে মোবাইল সাইলেন্ট/বন্ধ রাখা এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুরুষ টাকনুর ওপরে এবং মহিলা টাকনুর নিচে কাপড় পরিধান করা আবশ্যক এবং পর্দা মানিয়া চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’

আরো আশ্চর্যজনক খবর হলো, জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালকের এই নির্দেশনা নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। পুরো করোনাকালে ব্যাপক ধীরগতি ও ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়েও এই শোকজ নোটিশ জারিতে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার স্বাক্ষর রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খবর প্রকাশের ২/৩ ঘন্টার মধ্যে এবং আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা- ৬টার দিকে নোটিশ জারি করার ‘কৃতিত্ব’ দেখিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে প্রগতিশীল মহলে মন্ত্রণালয়ের প্রতি বাহবাদানও শুরু হয়েছে।

অফিসের শৃংখলা ও শালীনতা বজায় রাখতে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দেওয়া এ নির্দেশনার কপি-ছবি ও খবর হাতে পেয়ে কোনো কোনো ‘অতি প্রগতিশীল’ গণমাধ্যমের রাগে ফেটে পড়ার দশা। ধর্ষণের খবর পেলেও তারা এত উত্তেজিত হতেন কিনা সন্দেহ! গত কয়েকদিন আগে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এমপির অপকর্মের বহুল ধিকৃত ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এবং দেশব্যাপী এ ঘটনায় রিরি পড়ে গেলেও এ নিয়ে তারা কোনো টু-শব্দ করেননি। অথচ এখন তারা শালীন পোশাকের নির্দেশনা দেওয়ায় জনস্বাস্থ্যের পরিচালককে টার্গেট করছেন। প্রশ্নে প্রশ্নে তাকে ঝালাপালা করে ফেলার মতো অবস্থা চলছে।

এই লেখা তৈরির সময় (সন্ধ্যা ৭টা/ ২৯ অক্টোবর) পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ঢাকার একটি প্রভাবশালী পোর্টাল ও অত্যন্ত প্রভাবশালী বাংলা দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে জনস্বাস্থ্যের পরিচালকের বিরুদ্ধে নেতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এই পরিচালক কেন তার সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইসলামী নির্দেশনার আলোকে শালীন পোশাক পরার নির্দেশ দিলেন- এ নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেশি-বিদেশি আরো বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাইট ‘গরম’ হয়ে উঠবে। ‘একাত্তর-বাহাত্তরের’ মতো বহু টেলিভিশন টকশোর রাতে ‘টেবিল থেকে মাছি তাড়াতে’ ব্যস্ত হয়ে যাবে। অথচ শালীন পোশাকের নির্দেশনার বিপরীতে এই পরিচালক সাহেবই যদি অশালীন পোশাক পরার কোনো নির্দেশনা (অফিস কোড/ড্রেস কোড) জারি করতেন তাহলে এই ‘দুর্গন্ধ শুঁকা’ গণমাধ্যমগুলো তালি বাজিয়ে ‍উল্লাস করতো।

এখানে কয়েকটি ব্যাপার খুবই লক্ষণীয়। কেউ কেউ এমন আপত্তি উঠাতে পারেন যে, ধর্মীয় পোশাক পরতে তিনি অফিসে ঢালাওভাবে এমন নির্দেশনা জারি করতে পারেন কিনা, যেখানে অফিসটি তার ব্যক্তিগত নয়; বরং সরকারি। এক্ষেত্রে আমরা বলব, তার নির্দেশনায় ‘মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য’ শব্দ ও শর্তের দিকে তারা খেয়ালটা ফেরাতে পারেন। অমুসলিম কোনো নারী-পুরুষ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অনুসরণের জন্য শালীন পোশাকের এ নির্দেশনাটি তিনি জারি করেননি।

নিজের অফিসের মুসলমান কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ইসলাম নির্দেশিত শালীন পোশাক পরতে বলাও কি অপরাধ? তবে একথাও সত্য যে, একটি সরকারি অফিসে এ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তিটি নির্দেশনার পরিবর্তে দাওয়াতী বা আহবানমূলক হলে বেশি ভালো হতো। কিন্তু নির্দেশ দিয়েও তিনি বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেননি।

এ নির্দেশনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন, বিজ্ঞপ্তিতে ‘মহিলা হিজাবসহ টাকনুর নিচে কাপড় পরিধান করা আবশ্যক’- এ বাক্য থেকে বোঝা যায়, ওই অফিসে খোলামেলা স্কার্টসহ থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট পরিধানে অভ্যস্ত উগ্র পোশাকের কিছু নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অফিসে অন্তত স্বাভাবিক, অনুত্তেজক ও শালীন পোশাক পরতে উদ্বুদ্ধ করতেই সম্ভবত এজাতীয় নির্দেশনা জারি করতে হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও সেই বিজ্ঞপ্তি নিয়ে হৈ-হুল্লোড় বাধানো প্রতিবেদনের পর সময় খুব বেশি পার হয়নি; সেজন্য ওই অফিসের ভেতরের বিস্তারিত চিত্র জানাও সম্ভব হয়নি। কিন্তু একশ্রেণির গণমাধ্যমের ‘মাথা গরম’ প্রতিবেদন ও হইচই দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওই অফিসের ভেতর থেকেই এজাতীয় শালীন পোশাকের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানো খেমটা নাচের নারী-পুরুষের উস্কানি আছে।

আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, তিনি ওই নির্দেশনায় অফিস চলাকালে মোবাইল ফোন সাইলেন্ট কিংবা বন্ধ রাখতে বলেছেন। সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, ‘ফোন চালু রেখে অনেকেই ফেইসবুকসহ নানা ব্যস্ততায় অফিস সময় নষ্ট করে। আর উঁচু আওয়াজে কথা বলে অন্যদের কাজে বিঘ্ন ঘটায়। তাই আমি নিষেধ করেছি। আমার মূল উদ্দেশ্য অফিসের শৃংখলা বজায় রাখা ‘

প্রবল মাথা গরম করা একটি নিউজ পোর্টাল জনস্বাস্থ্যের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহীমকে এমন নির্দেশনা ও বিজ্ঞপ্তি জারির কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। টাকনুর ওপর যদি পুরুষ কাপড় পরে তাহলে তার কোনো গুনাহ নাই, টাকনুর নিচে পরলে সে কবিরা গুনাহ করলো। একইভাবে নারীদের জন্যও সেটা প্রযোজ্য, নারীরা পর্দার ভেতরেই সুন্দর। টাকনুর নিচে কাপড় পরলে তার কবিরা গুনাহ হবে না।

এখানে তিনি কি কিছু ভুল বলেছেন? ধর্ষণ-ব্যভিচারের এই বেদনাদায়ক সয়লাবের যুগে ঢেকে-ঢুকে চলতে বলাই কি তার অপরাধ? এ সমাজটা কি নগ্নতাবাদী ‘প্রগতিশীল নারী-বন্ধুদের’ জন্য অভয়ারণ্য হয়েই থাকবে? যারাই এই অপয়া গতির মুখটা ঘুরিয়ে দিতে চাইবে তাকেই কি জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীমের মতো নিন্দা-তিরস্কারের টার্গেট হতে হবে?

জানি না, জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট পরিচালকের এই বিজ্ঞপ্তি কতদিন বহাল থাকবে। গণমাধ্যমগত এবং মন্ত্রণালয়গত নানারকম চাপের মুখে পড়ে এ বিজ্ঞপ্তি তাকে প্রত্যাহার করতেই হয় কিনা- এটা হয়ত পরিস্থিতি বলে দেবে।

কিন্তু আমরা ছোট্ট করে এই কথাটা বলতে পারি, দ্বীনী জীবন ও শালীনতার পক্ষে আওয়াজ তুললে এই দেশে নানা রকম চেতনার টাওয়ার থেকে বিরুদ্ধ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে যে থাকে, তা এদেশের ভবিষ্যতকে কখনোই মসৃণ হতে দিবে না। সচেতন মানুষের দায়িত্ব, এই অসাধু চেতনা তরঙ্গের সামনে প্রতিরোধের প্রাচীর দাঁড় করানো।

পূর্ববর্তি সংবাদফ্রান্সের ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বি-বাড়িয়ায় বিক্ষোভ সমাবেশ
পরবর্তি সংবাদঠাকুরগাঁওয়ে বন্ধুকে হত্যা করে আগুনে পোড়ানোর দায়ে ৩ যুবকের মৃত্যুদণ্ড