মুহাম্মাদ আদম আলী ।।
অদ্দান উপত্যকা। গভীর রাত। এসময় গিফার গোত্রের লোকজন ঘুমায় না। তারা শিকারের সন্ধানে থাকে। মানুষ শিকার। পথে কাউকে একা পেলেই তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়। মেরে ফেলতেও কার্পণ্য করে না। ডাকাতের দল এরা। লুণ্ঠনই জীবীকার অবলম্বন। কত বণিক দল যে তাদের হাতে নিঃস্ব হয়েছে, হিসেব রাখে না কেউ। অবশ্য সব বণিকদলের ওপর এরা আক্রমণ করে না। মক্কার কুরাইশরাও এ পথে সিরিয়া যায়। তাদের কাছ থেকে ভালো চাঁদা পায় বলে কিছু বলে না। চাঁদা দিতে না চাইলেই লুটতরাজ চলে। তাদের ভয় করে সবাই।
এসব ভয়ানক মানুষের ভিড়ে একজন কেবল ব্যতিক্রম। ডাকাতির বাইরে নতুন এক চিন্তায় তার মন অস্থির হয়ে আছে। মানুষটির নাম জুন্দুব। অবশ্য এ নামে সে তেমন পরিচিত নয়। সবাই তাকে আবু যর নামেই চেনে। সে একজন দুর্ধর্ষ ডাকাত। দুর্দান্ত সাহসী। সাহস না থাকলে ডাকাতি করা যায় না। তবে তার সাহসের সবাই প্রশংসা করে। গোত্রে নাম-ডাক ছড়িয়েছে। এমনিতে গোত্রের লোকেরা মূর্তি পূজা করে। অনেক খোদা মানে। এগুলো তার মনে ধরেনি কখনো। ডাকাতরা ধর্মের চিন্তা করে না। জুন্দুব চিন্তা করে। তার মন বলে―খোদা কেবল একজনই। এত খোদা থাকতে পারে না। নিকষ কালো অন্ধকারেও তার মন আলোর সন্ধান করেছে।
এভাবে কতকাল গিয়েছে, কে জানে। এখন সে শুনেছে, মক্কায় এক নতুন নবীর আগমন ঘটেছে। তিনি নতুন ধর্মের কথা শোনাচ্ছেন। এক স্রষ্টার দিকে আহ্বান করছেন। এই নতুন নবী সম্পর্কে জানা দরকার। ধর্মটাই বা কী? তার আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। জুন্দুব সর্দার মানুষ। অনেক দায়িত্ব। এগুলো ফেলে কোথাও যাওয়া মুশকিল। নতুন নবী সম্পর্কে জানতে হলে মক্কায় যেতে হবে। পথ অনেক। হুট করে যাওয়াও যাচ্ছে না। ফিরে আসতে সময় লাগবে। অনেক ভেবে নিজের ভাইকেই পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। তার ভাইয়ের নাম আনিস। আনিসকে বুঝিয়ে বলল সব। নতুন নবীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে আসতে হবে।
আনিস গেল। এবার জুন্দুবের অপেক্ষা করার পালা। মাত্র কটা দিন। সময় যেন কাটছেই না। এক অপার্থিব অস্থিরতা তাকে ঘিরে রেখেছে। হঠাৎ আনিস ফিরে আসার খবর এলো। জুন্দুব দৌড়ে গেল। এক শ্বাসে অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। আনিস বলতে লাগল : ‘আমি মক্কায় এমন এক ব্যক্তিকে দেখেছি, যিনি তোমার ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এক নতুন ধর্ম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। আল্লাহ তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তবে লোকজন তাকে সবি বলে। লোকজন তাকে কী নামে সম্বোধন করছে, আমি কেবল তা-ই বলছি। কেউ বলে তিনি একজন যাদুকর, কেউ বলে গণক, আবার কেউ বলে কবি; কিন্তু আমি তার কথা নিজ কানে শুনেছি, আমি নিশ্চিত তিনি এসবের কিছুই নন। আল্লাহর কসম, তিনি সত্যই বলছেন।’
আনিসের কথায় জুন্দুবের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। নিজেকে সামলানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এখনই সেই মানুষটির কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তাকে স্বচক্ষে না দেখলে তৃপ্তি মিটবে না। সব ছেড়ে গেলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? এ দায়িত্ব কাউকে দেওয়া দরকার। আনসিকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেল। শুধু বলল, মক্কার লোকদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। জুন্দুবের মনে এখন আনন্দের ঢেউ। মনে হয়, বহুকাল পরে কোনো প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হবে। সে দ্রুত রওনা হয়ে গেল। মরুর পথে একাকী। মক্কার দিকে। প্রিয়জনের সাক্ষাতে।
২। মক্কার অলি-গলি তার অপরিচিত। নতুন নবী কোথায় থাকেন, তিনি দেখতেই বা কেমন―এসব তার জানা নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। এ শহরে তার পরিচিত কেউ নেই। নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতায় এরা অভ্যস্ত। সম্ভবত এরা গীফারীদেরও ছাড়িয়ে যাবে। শহরে ঢুকতেই একজনের দেখা মিলল। আবু যরের দেরি করতে ইচ্ছে করছে না। তাকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, ‘তোমরা যাকে সাবি বলো, সেই লোকটি কোথায়?’
লোকটি এ প্রশ্নে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সে এমন করে আবু যরের দিকে তাকায় যেন এখনই মাথায় তুলে আছাড় দিবে। আবু যর ভয়ই পেয়ে যায়। এ ভয় কাপুরুষতা নয়, এটি এত কাছে এসেও না পাবার ভয়। তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। এজন্য কথা না বাড়িয়ে আবার হাঁটা শুরু করে। কাবা চত্বরে গেলে নিশ্চয়ই কিছু জানা যাবে। সব কবিলার লোকই সেখানে যায়। নতুন নবীও হয়তো আসবেন। কাবা চত্বরে এসেও কিছু জানা যাচ্ছে না। কারও সঙ্গে কথা-ই বলা যাচ্ছে না। সবাই কেমন জানি নির্লিপ্ত। দ্বিধায় জর্জরিত। সাবিদের মধ্যে কারও খবর মিলছে না। পথের ক্লান্তিতে বিষণ্ন হয়ে উঠছে তার মন। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। দেহকে আর সোজা রাখা যাচ্ছে না। সে সটান হয়ে চত্বরের এক পাশে শুয়ে পড়ে। জ্বলে উঠা লণ্ঠনের আলো এসে পড়ছে তার চেহারায়। এ চেহারা এ শহরের মানুষ কখনো দেখেনি!
৩। আগন্তুকের চেহারা দেখে আলী ইবনে আবি তালিব থমকে দাঁড়ালেন। এ পথ দিয়েই তাকে বাড়ি যেতে হয়। পথে মুসাফির কাউকে পেলে সঙ্গে নেন। আজকের লোকটাকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। সম্ভবত মক্কায় নতুন এসেছে। কাউকে চেনে না মনে হয়। চোখে-মুখে রাজ্যের অনিশ্চয়তা। পেটানো শরীর হলেও কেমন নুইয়ে পড়েছে। তিনি তাকে ডাকলেন। নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
মক্কায় এক কঠিন অবস্থা বিরাজ করছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত লাভ করেছেন। তিনি সে কথা প্রকাশ্যে ঘোষণাও করেছেন। তারপর থেকেই মক্কার মুশরিকরা বেঁকে বসেছে। তাদের এতদিনের ‘আল-আমীন’ এখন শত্রু হয়ে গেছে। কেউ মুহাম্মাদের কাছে ভিড়লে তার আর রক্ষা নেই। এ পর্যন্ত মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন তার ওপর ঈমান এনেছে। প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়া শুরু হয়নি এখনো। শহরে বিভিন্ন স্থানে চৌকি বসানো হয়েছে। বাইরের লোকদের মুহাম্মাদের ব্যাপারে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে তারা তাদের সেখানে যেতে বারণ করে। তারপর না শুনলে শাস্তি দেয়। এজন্য নতুন নবীর কথা জানলেও কেউ মুখ ফুটে বলে না। কাউকে দাওয়াত দিতেও ভয় ভয় লাগে। নেতাদের বলে দিলে সর্বনাশ হবে। জুন্দুব নীরবে আলীকে অনুসরণ করল। নতুন নবীর প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করবে কিনা, বুঝতে পারছে না।
কে জানে লোকটা কেমন! লোকটার বয়স কম। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। আচরণও ভালো মনে হচ্ছে। তবু ভয় লাগে। নেতাদের কেউ হলে তাকে মক্কা থেকে বের করে ছাড়বে। তখন তো আসাটাই বৃথা হয়ে যাবে। এদিকে আলীও ভয় পাচ্ছেন। দ্বীনের কথা বললে যদি সে গ্রহণ না করে! শেষ পর্যন্ত কেউই এ বিষয়ে কোনো কথা বলল না। তাদের মনের কথা অব্যক্তই রয়ে গেল।
মনের কথা আটকে রাখা সহজ নয়। কষ্টের। পরিবেশ কতটা মারাত্মক হলে অন্তরে এতটা ভয় কাজ করে! রাতের অন্ধকারের নির্জনতায়ও সে ভয় কাটে না। পরদিন সকালে আবার যে যার পথে বেরিয়ে পড়ল। জুন্দবের পথ কাবা চত্বরেই থেমে আছে। আজ দুই দিন হয়ে গেল। সে যার সন্ধানে এসেছে, তার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানতে পারেনি। জানার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আজ রাতেও নিশ্চয় ওই লোকটা এসে তাকে নিয়ে যাবে। ঘুমাবে। পরদিন আবার এখানে এসে বসে থাকবে। হলোও তাই। এভাবে তৃতীয় রাত ঘনিয়ে এলো। সম্ভবত আর দেরি করা যায় না। মুসাফিরের উদ্দেশ্য জানা দরকার। কতদিন এভাবে কাটবে? তিনদিন তো হয়ে গেল। আলী-ই ঝুঁকি নিলেন। তারই হক বেশি জানার। সাহস সঞ্চয় করে মুসাফিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি মক্কায় কেন এসেছেন?’
৪। সময় এসেছে মনের কথা বলার। এখন আর সংকোচ করে লাভ নেই। যা-ই ঘটুক, বলারই সিদ্ধান্ত নিল জুন্দুব। আগে একটু ভূমিকা করে বলল, ‘আপনি যদি আমার কাছে অঙ্গীকার করেন, আমি যা চাই সেদিকে আমাকে পথ দেখাবেন―তাহলে আমি বলতে পারি।’
জুন্দুবের কথা শেষ হতেই আলী সায় দিলেন। তখন জুন্দুব বলে উঠল, ‘আমি অনেক দূর থেকে মক্কায় এসেছি―নতুন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তিনি যেসব কথা বলেন তার কিছু শুনতে।’
আলীর চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। এমন মানুষই তো তিনি খুঁজছেন। এবার দুজনের কথার খই ফুটতে লাগল। নবীর পরিচয় দিতে আলী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ‘তিনি প্রকৃতই একজন সত্য নবী,’ এই বলে আলী আলোচনা শুরু করলেন। জুন্দুব গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তার প্রতিক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। যে চায়, সে পায়। এই প্রাপ্তিতে জুন্দুব উচ্ছসিত। এখনো প্রিয়জনের দেখা বাকি!
সকালেই দুজন নবীর সাক্ষাতে রওনা হলো। মক্কা থেকে রাসূলের নিবাস বেশি দূরে নয়। তবু এই পথটুকুতে দুজনের জন্য একসঙ্গে চলা কঠিন। আলীকে সবাই চেনে। জুন্দুবকে কেউ চেনে না। তাকে আলীর সঙ্গে দেখলে মুশরিকদের মনে সন্দেহ দানা বেধে উঠবে। এজন্য সতর্কতা প্রয়োজন। আলী বললেন, ‘আমি আগে আগে হাঁটব। আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি কোনো বিপদের আশঙ্কা করি, তাহলে প্রস্রাবের ভান করে রাস্তার এক পাশে সরে যাব। আপনি আপনার পথে চলতে থাকবেন। চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে ঠিকই খুঁজে নেব। আর আমি যদি কোনো বিপদের আশঙ্কা না করি, তাহলে আপনি আমার সঙ্গেই পথ চলবেন এবং আমরা যেখানে যেতে চাই, সেখানে গিয়ে মিলিত হব।’ শীঘ্রই তারা একটি ঘরের নিকট এসে দাঁড়ালেন। কেউ একজন তাদের জন্য দরজা খুলে দিল। জুন্দুব ঘরে প্রবেশ করেই এমন এক উদ্ভাসিত চেহারা দেখলেন, যেন পূর্ণিমার চাঁদ, যার আগমন-প্রতীক্ষায় তিনি বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে দৃষ্টি দিতেই তার অন্তর প্রশান্তিতে ভরে গেল।
জুন্দুব বলে উঠলেন, ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ।’ তার কথায় মনে হয়, জুন্দুব ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তারপর তিনি নিজের আশা-আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। নিজের পেশা ও মক্কায় আসার কারণ বর্ণনা করে বলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে এখন কী করতে হবে? আপনি মানুষকে কোন ধর্মের দিকে আহ্বান করেন?’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : ‘আমি তোমাকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য আহ্বান করছি। তার সঙ্গে অন্য কারও ইবাদত করা যাবে না। আর সকল মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করতে হবে।’ আবু যর তখনই উচ্চারণ করলেন : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং আমি এটিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি তার রাসূল।’
আর এভাবেই জুন্দুব ইসলামে চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন।