সালাম : আমাদের স্বকীয়তা

মাওলানা শিব্বীর আহমদ ।।

প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.। শুরুর জীবনে ছিলেন ইহুদি। থাকতেন মদীনায়। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত সম্পর্কে তার জানাশোনা ছিল প্রচুর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরতের পর তিনি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এক হাদীসে তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবেÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন, বাঁধভাঙা স্রোতের মতোই মানুষ তাঁর দিকে ছুটতে শুরু করল। তারা বলাবলি করতে লাগল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চলে এসেছেন; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চলে এসেছেন। তাঁকে দেখার জন্যে মানুষের ভিড়ের মাঝে আমিও গেলাম। আমি তাঁর চেহারা দেখেই তাঁকে চিনতে পারলাম আর তখনি বুঝতে পারলামÑ এ চেহারা কোনো মিথ্যুকের চেহারা নয়। সেদিন আমি তাঁকে প্রথম যে কথাটি বলতে শুনেছি তা হল- হে মানুষেরা! তোমরা সালামের বিস্তার ঘটাও, মানুষকে খাবার খাওয়াও এবং যখন অন্য মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়, তাহলে তোমরা শান্তিতে ও নির্বিঘেœ জান্নাতে যেতে পারবে। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৮৫

হাদীসটির প্রেক্ষাপট ও উপস্থাপন আমাদের সামনে সালামের গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করে এসে মানুষদেরকে প্রথম উপদেশ দিচ্ছেনÑ তোমরা সালামের অধিক প্রচলন কর!

দেখা-সাক্ষাতে একে অন্যকে শুভেচ্ছা-অভিবাদন জানানো মানুষের একটি সহজাত গুণ। মানবসমাজে এ প্রথা চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। কোনো কোনো এলাকায় প্রচলন ছিল সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানানোর রীতি। ইসলামপূর্ব যুগে আরবের লোকেরা পরস্পর দেখা-সাক্ষাতে বলতÑ ‘اَنْعِمْ صَبَاحًا- তোমার সকাল সুন্দর হোক’ اَنْعَمَ اللهُ بِكَ عَيْنًا- আল্লাহ তোমার চোখ শীতল করুন’ জাতীয় শব্দ। গুডমর্নিং বা শুভ সকাল তো একালেরও প্রচলিত অভিবাদন। কিন্তু ইসলাম আমাদেরকে দিয়েছে এক অভূতপূর্ব অভিবাদন-রীতি, যেমনটি কোনো ধর্মে কিংবা কোনো দেশে প্রচলিত ছিল না। মানের বিচারেও তা অন্যসব কিছু থেকে শ্রেষ্ঠ। ইসলাম আমাদেরকে শিখিয়েছে- দুই মুসলমান যখন মিলিত হয় তখন যেন একে অন্যকে সালাম দেয় অর্থাৎ একজন বলবে, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ- তোমার ওপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক; অপরজন বলবে, ওয়া আলাইকুমুস সালামু ওয়ারাহমাতুল্লাহÑ তোমার ওপরও শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। এভাবে স্থান-কালের বন্ধন থেকে মুক্ত করে একে অন্যের জন্যে আল্লাহর রহমত ও শান্তি কামনাÑ এর চেয়ে উত্তম শুভেচ্ছা আর কী হতে পারে!  এ সালাম আমাদের অহংকার, আমাদের স্বকীয়তা।

সালাম যে কেবল অভিবাদন আর শুভ কামনা এমন নয়, কিংবা সালাম কেবল মহব্বত-ভালোবাসার প্রকাশই নয়, বরং এ সালামের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার দাবিটুকুও আদায় করা হয়। একজন আরেকজনের জন্যে প্রার্থনা করেÑ আল্লাহ তোমাকে শান্তি ও নিরাপদে রাখুন, তোমার ওপর বর্ষিত হোক পরম করুণাময়ের দয়া ও অনুগ্রহের বারিধারা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে দয়াময় আল্লাহ তোমাকে সবরকমের বিপদ ও শঙ্কা থেকে মুক্ত রাখুন। সাক্ষাতের সঙ্গে সঙ্গে একে অন্যের জন্যে এ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে যেন একথাও মনে করিয়ে দেয়া হয়Ñ আমরা একে অপরের যে সহযোগিতা আর উপকার করতে চাই, তা কেবল আল্লাহর ইচ্ছায়ই হতে পারে। এভাবে সালামের মাধ্যমে একে অন্যকে আল্লাহর কথাও মনে করিয়ে দেয়। আর কেউ যখন অন্য কারও জন্যে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রার্থনা করে, সে যেন এর ভেতর দিয়ে এ অঙ্গীকারও করে- আমার পক্ষ থেকেও কোনো অনিষ্টতায় তুমি আক্রান্ত হবে না। আমার দিক থেকে তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। পারস্পরিক ভালোবাসার দাবি পূরণের চেয়ে সুন্দর পন্থা আর কী হতে পারে!

কেউ যখন কাউকে সালাম দেয়, তখন এর উত্তর দেয়া ওয়াজিব। এ আদেশ সরাসরি আল্লাহরÑ

وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا.

যখন তোমাদের সালাম দেয়া হয় তখন তোমরা এর চেয়ে উত্তম পন্থায় সালামের উত্তর দাও কিংবা (অন্তত) ততটুকুই বলে দাও। Ñসূরা নিসা (৪) : ৮৬

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম দেয়াকে একজন মুসলমানের অন্যতম সেরা আমল হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর বর্ণনা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক সাহাবী প্রশ্ন করলেন- ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল কোনটি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ، وَعَلَى مَنْ لَمْ تَعْرِفْ.

তুমি মানুষকে খাবার খাওয়াবে আর তোমার পরিচিত-অপরিচিত সকলকেই সালাম দেবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস : ১২

এ হাদীসে স্পষ্টভাবেই সালামকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে পরিচিত-অপরিচিত সবার মাঝে। পরিচিত কাউকে যখন সালাম দেয়া হয়,  তা আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব কিংবা অন্য যে কোনো সূত্রেই হোক, সালামের মাধ্যমে সেই পরিচয়ের সূত্র আরও ঘনিষ্ঠ হয়। আর অপরিচিত কাউকে যখন কেউ সালাম দেয় তখন এ সালামের মধ্য দিয়েই সূচিত হতে পারে গভীর আন্তরিকতার। জীবনে কখনো দেখা হয়নি এমন কারও সঙ্গেও যখন কথাবার্তার শুরুতে সালামের আদান-প্রদান হয় তখন অকৃত্রিম হৃদ্যতা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। এক অপার্থিব শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভূত হয়। মোটকথা, সালাম বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। হৃদ্যতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। ভালোবাসা ও সম্প্রীতির এ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সামাজিক বন্ধন যেমন সুদৃঢ় হয় তেমনি পরকালীন মুক্তিও এর সঙ্গে জড়িত। দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেহেশত লাভের জন্যেও পারস্পরিক এ ভালোবাসার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন- হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে তিনি বলেছেন,

لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا. أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ.

তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমাদের ঈমান ততক্ষণ পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না তোমরা একে অন্যকে ভালোবাস। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি আমলের কথা বলব, যখন তোমরা তা করবে, তখন একে অন্যকে ভালোবাসবে। তোমরা তোমাদের মাঝে সালামের প্রচলন ঘটাও।’ Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৪

সালামের প্রচলন কীভাবে ঘটানো যায় তার একটি রূপরেখাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন : তোমাদের কেউ যখন তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তখন যেন সে সালাম দেয়। এরপর কোনো গাছ কিংবা কোনো পাথর বা দেয়ালের আড়াল থেকে এসে যখন আবার তার সঙ্গে দেখা হয় তখনো যেন তাকে সালাম দেয়। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২০০

শুধু পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতিই নয়, সালামের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয় আমাদের আমলনামাও। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রা.-এর বর্ণনা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে এসে এক ব্যক্তি السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ বলে সালাম দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালামের উত্তর দিলেন। লোকটি তখন মজলিসে বসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দশ (অর্থাৎ তুমি দশ নেকি পেলে)। এরপর আরেকজন এসে السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللَّهِ বলে সালাম দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালামের উত্তর দিলেন। লোকটি তখন মজলিসে বসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বিশ (অর্থাৎ তুমি বিশ নেকি পেলে)। এরপর তৃতীয় আরেকজন এসে

السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ বলে সালাম দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালামের উত্তর দিলেন। লোকটি তখন মজলিসে বসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ত্রিশ (অর্থাৎ তুমি ত্রিশ নেকি পেলে)। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৯৫

সালামের আরেক সুফলÑ সালাম মানুষকে অহংকার থেকে মুক্ত রাখে। তবে এজন্যে শর্ত হল আগে সালাম দেয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :

الْبَادِئُ بِالسَّلَامِ بَرِيءٌ مِنَ الْكِبْرِ

যে আগে সালাম দেয় সে অহংকার থকে মুক্ত। Ñশুয়াবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৮৪০৭

মানুষ যখন বড় হয়, তা বয়সের বিবেচনায়ই হোক, কিংবা যশ-খ্যাতি সম্মান বা অর্থসম্পদের দিক দিয়েই হোক, আর পদমর্যাদা ও ক্ষমতা দিয়েই হোক, সে চায় তার অধীনস্তরা কিংবা তার চেয়ে ছোট যারা তারা তাকে সম্মান করুক। অন্যদের সম্মানে সে তৃপ্তি পায়। তাই কেউ বড় হয়ে গেলে ছোটদের নিয়ে এ মানসিকতা থাকা স্বাভাবিকÑ আমি কেন তাকে সালাম দেব, বরং সে আমাকে সালাম দেবে! এ মানসিকতা থেকেই অহংকারের সূচনা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মানসিকতাকেই শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলেছেন। তাঁর বাণী ও শিক্ষা অনস্বীকার্যÑ যে যত বড়ই হোক, সামাজিকভাবে যত উচ্চ মর্যাদার অধিকারীই হোক, আগে বেড়ে সে যখন অন্য কাউকে সালাম দেবে তখন তার মন থেকে অহংকার বিদায় নিতে বাধ্য।

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ছিলেন মদীনা মুনাওয়ারার বিদ্বান সাহাবীদের অন্যতম। তাকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে ওঠে হাদীস চর্চার পাঠশালা। অথচ তিনি হাদীসের মজলিস রেখে মাঝে মাঝেই বাজারে ঘুরে বেড়াতেন। উদ্দেশ্য- অধিক সংখ্যক মানুষকে সালাম দেয়া। তাঁর শিষ্য হযরত তুফায়েল ইবনে উবাই ইবনে কাবের বক্তব্য শুনুনÑ ‘আমি একদিন আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর নিকট এলাম। তিনি তখন আমাকে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা করলেন। আমি তাকে বললাম, বাজারে গিয়ে আপনি কী করবেন? আপনি তো কোনোকিছু কেনাবেচা করেন না, কোনো পণ্য সম্পর্কে কিছু জানতেও চান না, কোনোকিছু নিয়ে দামাদামিও করেন না, কারও সঙ্গে কোনো বৈঠকেও শরিক হন না, তবুও কেন আপনি বাজারে যাবেন? আপনি এখানে বসুন, আমরা হাদীস শুনব। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তখন বললেন, আরে শোনো, আমরা তো কেবল সালাম দেয়ার জন্যেই বাজারে যাই। যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই আমরা সালাম দিয়ে থাকি।’ Ñমুয়াত্তা মালেক, হাদীস  ১৭২৬

সালামকে যদি আমরা এভাবে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারি, এবং যদি সালামের মর্ম আমরা আমাদের জীবনে ধারণ করতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন আমাদের পরকালীন পুঁজি বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সমাজে বয়ে যাবে আন্তরিকতা আর সম্প্রীতির ¯িœগ্ধ হাওয়া। আমাদের পার্থিব জীবনও হয়ে ওঠবে শান্তি ও কল্যাণময়। 

পূর্ববর্তি সংবাদহুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী: সংকল্পদৃঢ় জীবন যেমন
পরবর্তি সংবাদবগুড়ায় আ.লীগ নেতার গলাকাটা লাশ উদ্ধার