মুগ্ধতা ছড়ানো একটি মাদরাসায় কিছুক্ষণ

প্রতীকী ছবি

মাওলানা শিব্বীর আহমদ।।

নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানাধীন বীরগাও গ্রাম। রায়পুরার চরাঞ্চলে মেঘনা নদীর একটি ছোট শাখার তীর ঘেষে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বীরগাও দারুল কুরআন মাদরাসা। মাদরাসার নামটি যেমন সাদামাটা, পরিবেশটাও তেমন সরল সুন্দর। মাঝারি রকমের দুটি টিনের ঘর। একটি পূর্ব-পশ্চিমে, আরেকটি উত্তর-দক্ষিণে। দুটি মিলিয়ে ‘এল’ আকৃতির হয়। সামনে খোলামেলা একটি মাঠ। আর পাশেই নদী। এমনকি এখন নদীর পানি যতটুকু বিস্তৃত, এর কিছুটায় মাদরাসার জমিও রয়েছে।

পরিবেশ-প্রকৃতির সৌন্দর্য বিবেচনা করলে এর চেয়ে আরও অনেক বেশি মুগ্ধকর মাদরাসা পাওয়া যাবে। কিন্তু আকারে ছোট এ মাদরাসাটির মুগ্ধতার জায়গা ভিন্ন। দাওরায়ে হাদীসের কিতাবসমূহ পাঠদানের পদ্ধতিতে একটি বিপ্লব ঘটানোর প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে এ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অল্প সময়েই তা গুণীজনদের মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।

আমাদের মাদরাসাগুলোতে যেভাবে হাদীসের দরস প্রদান করা হয়, এটার উপকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো কথা নেই। সময়ের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে বিশালাকার এ সিলেবাস শেষ করতে গেলে বর্তমানের প্রচলিত পদ্ধতি অস্বাভাবিকও নয়। আর হাদীসের পাঠ গ্রহণের ক্ষেত্রে হাদীসের কেবল শাব্দিক তেলাওয়াতও একটি স্বীকৃত রীতি। সে যাই হোক, ছোট এ মাদরাসাটি যাত্রা শুরু করেছে দারসুল হাদীসের একটি বছরকে কীভাবে আরও প্রাণবন্ত ও অধিকতর উপকারী করে তোলা যায় সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে।

মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুখতার হোসাইন নোমানীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়—তারা দাওরায়ে হাদীসের এক বছরেই কুতুবে সিত্তাহ এবং তাহাবী শরীফের পুরোটাই তাকরীরের সঙ্গে পড়িয়ে থাকেন। তাও আবার সনদ-মতন সবসহ। তবে মুয়াত্তা মালেক ও মুয়াত্তা মুহাম্মদ কিতাবদুটির পাঠদান হয় সামান্য পরিমাণে। কীভাবে সব কিতাব অল্প সময়ে তাকরীর (আলোচনা) করে শেষ করেন—এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, তারা জামে তিরমিযীকে প্রথমত পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেন। প্রতিটি ভাগের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দরস। এখানে যে হাদীসটি পড়া হবে, সে হাদীসটি কুতুবে সিত্তাহর অন্য কিতাবগুলোতে আরও কোথায় কোথায় আছে, সেগুলো বের করে তেলাওয়াত করা হয়। এরপর সেগুলোতে লফযের কোনো ভিন্নতা আছে কিনা—তা চিহ্নিত করা হয়। হাদীসটি কোথায় কোন উদ্দেশ্যে সংকলন করা হয়েছে—তা আলোচনা করা হয়। এভাবে জামে তিরমিযী কিতাবটি পূর্ণ তাকরীরের সঙ্গে শেষ করা হয়।

এর পাশাপাশি অন্যান্য কিতাবের পাঠদানকালে যখন তিরমিযী শরীফে পড়ানো কোনো হাদীস আসে, তখন সেখানে কোনো আলোচনা না করে কেবলই হাদীসটি তেলাওয়াত করে সামনে চলা হয়। একটি হাদীস যদি একই কিতাবের একাধিক জায়গায় থাকে সেখানেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সব মিলিয়ে কথা হলো, একটি হাদীসের ওপর আলোচনা একবারই হবে। এ ছয় কিতাবের অন্য কোথাও এ হাদীস নিয়ে আর আলোচনা হবে না। এভাবে সহজেই তারা বছর শেষে সবগুলো কিতাব আলোচনা করেই শেষ করতে পারেন।

এখানে পাঠদানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হাদীসের সনদ। দাওরায়ে হাদীসের দরস যেখানে হয় সনদসহই তো হয়। কোনো কোনো কিতাবের কিছু কিছু জায়গায় আবশ্যিকভাবেই সনদের বিস্তারিত আলোচনা করতে হয়। এর বাইরে সনদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা নির্ভর করে পাঠদানকারী উস্তাযের রুচির ওপর। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে কেউ সনদ নিয়ে কথা বলেন, কেউ কেবলই হাদীসের মূল পাঠ বা মতনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ মাদরাসায় সুনান-চতুষ্টয়ের প্রতিটি কিতাবের প্রতিটি হাদীসই সনদের সংক্ষিপ্ত আলোচনাসহ পড়ানো হয়। এর পদ্ধতি এমন—প্রতিটি হাদীস পড়ানোর সময় সে হাদীসের যত রাবী, তাদের সকলের অতিসংক্ষিপ্ত পরিচিতি কমপক্ষে ‘তাকরীবুত তাহযীব’ থেকে লিখিয়ে দেয়া হয়। একজন রাবীর নাম যতবার আসবে, ততবারই তার পরিচিতি লেখানো হয়। প্রতিটি হাদীসের ضبط الرواة , عدالة الرواة এবং اتصال السند এ তিনটি বিষয় শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। এতে হাদীসের মান সম্পর্কে একটি ধারণা সহজেই লাভ করা যায়। علة خفية আর شذوذ নিয়ে অবশ্য কোনো আলোচনা সাধারণত হয় না। হাদীসের মতন সম্পর্কে কারও কোনো মূল্যায়ন থাকলে তাও জানিয়ে দেয়া হয়। বুখারী-মুসলিম—এ দুই কিতাবের সনদ নিয়ে কোনো কথা হয় না, যেহেতু এ দুই কিতাবের সব হাদীসই সহীহ। এ হচ্ছে মুগ্ধতার প্রথম ধাপ।

পরবর্তী ধাপ এবার শুনুন। মুহতামিম সাহেবকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাওরায়ে হাদীসে ছাত্র কতজন? উত্তরে তিনি বললেন : এ বছর পাঁচজন ভর্তি হয়েছে। আমাদের টার্গেট ছয়জন। গত বছর অবশ্য পীড়াপীড়ি করে মোট এগারজন ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল—ছয়জনের অতিরিক্ত যারা, তারা এখানে থেকে কাঙ্খিত ফায়েদা হাসিল করতে পারবে না। বছর শেষে আটজন ছিল। এত কম ছাত্র কেন—এর উত্তরে তিনি জানান : ছাত্রদেরকে এখানে প্রচুর মেহনত করতে হয়। ছাত্র বেশি হলে সে মেহনতের ধারা ও মান রক্ষা করা সম্ভব হয় না। জামে তিরমিযীর পাঁচটি অংশকে পাঁচজন ছাত্রের দায়িত্বে দেয়া হয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অংশ প্রতিদিন মুতালাআ করে আসে এবং দরসে ইবারত পড়ে। ছয় কিতাবের বাকি পাঁচটিকেও এ পাঁচজনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রতিদিন কুতুবে সিত্তাহর দুটি কিতাবের ইবারত পড়ে থাকে এবং এটা বাধ্যতামূলক। আরেকজন ছাত্রের দায়িত্বে থাকে তাহাবী শরীফ এবং মুয়াত্তা। ছাত্রদের দায়িত্ব কেবল ইবারত পড়া এবং তা আগে মুতালাআ করে আসার মধ্যেই সীমিত নয়। বছরের শুরুতে প্রথম পনের দিন তাদের কাজ শুধুই ইবারত ঠিক করে পড়ে আসা। ছাত্রদের ইবারত পড়া শেষে উস্তায হাদীসের তরজমা বলেন এবং আনুষাঙ্গিক অন্যান্য কথা আলোচনা করেন। পনের দিনের পর থেকে প্রত্যেক ছাত্রকেই নিজ নিজ অংশের হাদীসের ইবারত পড়ার পাশাপাশি তরজমাও শিখে আসতে হয়। এভাবে চলে কুরবানির ঈদের ছুটি পর্যন্ত। এরপর ছাত্রদের দায়িত্বে যোগ হয় সনদ বিষয়ক মুতালাআ।

ওপরে প্রতিটি সনদের প্রত্যেক রাবীর যে বিবরণের কথা বলা হয়েছে, এটা এখন থেকে প্রত্যেক ছাত্রকেই লিখে নিয়ে আসতে হয়। এ কাজটি প্রচুর মেহনতের—সন্দেহ নেই। কোনো কোনো রাবীকে তো সহজেই চিহ্নিত করা যায়। আবার কোনো কোনো রাবীকে নির্ণয় করতে ঘাম ঝড়াতে হয়। কষ্টসাধ্য এ কাজ শেষ করেই ছাত্রদেরকে দরসে বসতে হয়। এভাবে চলতে চলতে যখন প্রথম সাময়িক পরীক্ষা আসে, এরপর থেকে দরসে আসার আগেই প্রত্যেক ছাত্রকে জেনে নিতে হয়—তার আজকের পঠিতব্য হাদীসটি কোন মাযহাবের কিংবা কোন ইমামের দলিল। এভাবে চলে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার পূর্ব পর্যন্ত। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার পর দরসে উস্তাযের দৃশ্যত কোনো কাজই থাকে না। ছাত্র নিজে ইবারত পড়ে, তরজমা করে, সনদের রাবীদের জীবনী শোনায়, পঠিত হাদীসটি কোন ইমামের বা মাযহাবের দলিল তা বলে এবং এ ক্ষেত্রে আরও কী কী মত আছে ইমামদের, তাদের কার কী দলিল—সেসব বিষয়ও বলে। এভাবে চলেই বছরের শেষ নাগাদ কিতাবগুলো অনেকটা সহজেই শেষ করা যায়। এখানকার ছাত্ররা যে খুবই মেধাবী—এমন নয়। জানা কথা, মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ঝোঁক অনেকটাই শহরমুখী। গ্রামাঞ্চলে ছাত্র পাওয়া সহজ নয়। এ মাদরাসাটি রাজধানী ঢাকায় কিংবা অন্য কোনো জেলাশহরেও প্রতিষ্ঠিত নয়। নরসিংদী জেলার চরাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এর অবস্থান। ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল। এ দুর্বলতা কাটানোর জন্যে সেখানে বছরের শুরুতে কিছুদিন উস্তায ই’রাবের ব্যাখ্যাও করে দেন।

কয়েকদিন এভাবে চলার পর ছাত্রদেরকে ই’রাবের ব্যাখ্যা ঠিক করে আসতে হয়। মাদরাসার প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মশৃঙ্খলাও বেশ চমৎকার। রমজানের পর শাওয়ালের আট তারিখেই নিয়মতান্ত্রিক দরস শুরু হয়ে যায়। নতুন ছাত্রদের ভর্তি শেষ হয়ে যায় রমজানেই কিংবা রমজানেরও আগে। দরস বন্ধ করে ছাত্রদেরকে দিয়ে কোনো কালেকশনও করানো হয় না। মাস শেষে নিয়মিত মাসিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দু-তিন দিন ছুটিও থাকে। সকাল থেকে দরস শুরু হয়। আসরের আগেই দরস শেষ হয়ে যায়। বিকাল থেকে পরবর্তী সকাল পর্যন্ত ছাত্রদের নিজস্ব মুতালাআর সময়। এ সময়ে কোনো দরস হয় না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকতা হচ্ছে—মাদরাসা নিচ থেকে উপরে ওঠে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটি এখানেও স্রোতের উল্টো চলেছে। মাদরাসার প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরই দাওরায়ে হাদীসের দরস চালু হয়েছে। এবং শুধুই দাওরায়ে হাদীস। নিচের ক্লাসগুলো তখন ছিল না। এখন অবশ্য নুরানী মক্তব বিভাগ এবং তাইসির জামাত থেকে নাহবেমির জামাত পর্যন্ত ক্লাস রয়েছে। খুব শীঘ্রই হিফজ বিভাগ খোলারও পরিকল্পনা রয়েছে। আরও অবাক-করা বিষয়—হাদীসের পাঠদানের ক্ষেত্রে এ যে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন, অথচ যিনি পরিকল্পনা করেছেন, মাদরাসার মুহতামিম সাহেব, তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা দাওরায়ে হাদীস পর্যন্তই! ২০০৬ সালে তিনি দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। এরপর থেকেই গাজীপুরের খিরাটিতে একটি মাদরাসায় পাঠদান করেছেন। দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতিমান আলেমের পদধূলিতে এ মাদরাসা ধন্য হয়েছে। যারাই গিয়েছেন, বিবরণ শুনেছেন, মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। আমরা গত ১৩.৮.২০২০ বৃহস্পতিবার গিয়েছিলাম সেখানে। আমরাও মুগ্ধ। এ মুগ্ধতা আরও ছড়িয়ে পড়ুক। এ আলো দীর্ঘদিন টিকে থাকুক—এটাই আমাদের কামনা।

পূর্ববর্তি সংবাদইয়েমেনে নতুন করে সুদানি সেনা পাঠাচ্ছে সৌদি
পরবর্তি সংবাদ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নভোচারীদের জন্য নির্মিত হল টয়লেট!