বখতিয়ার খিলজী: যে তুর্কি বীরের হাতে বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা

ইসলাম টাইমস ডেস্ক: ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের ফলে এ দেশে মুসলমানদের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়।  এর আগে পীর, সুফী, দায়ী, মুবাল্লিগদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলাম প্রচার হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।  তবে  বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়টা ঐতিহাসিকদের কাছে এখনো এক বিস্ময় রয়ে গেছে।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী আফগানিস্তানের গরমশির এলাকার অধিবাসী ছিলেন। তিনি তুর্কীদের খিলজী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তার বাল্যজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

মুহাম্মদ ঘুরী তখন ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযান চালাচ্ছিলেন। বখতিয়ার ঘুরীর সৈন্যদলে চাকুরীপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। তখন নিয়ম ছিলো, প্রত্যেক সৈন্যকে নিজ ঘোড়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হতো। সামর্থ্যের অভাবে বখতিয়ার ঘোড়া বা ঢাল-তলোয়ার কিছুই যোগাড় করতে পারেননি। তাছাড়া খাটো দেহ, লম্বা হাত ও বেমানান চেহারার কারণে বখতিয়ার খিলজী সেনাধক্ষ্যের দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারেননি।

গজনীতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার দিল্লীর সম্রাট কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে আসেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হন। অতঃপর বখতিয়ার পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বদাউনে গিয়ে পৌঁছেন। বদাউনের শাসনকর্তা মালিক হিজবর-উদ-দীন তাকে নগদ বেতনে চাকুরীতে রাখেন, তবে এমন চাকুরীতে বখতিয়ার সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিছুদিন কাজ করার পর তিনি অযোধ্যায় চলে যান। অযোধ্যার শাসক হুসাম-উদ-দীন বখতিয়ারের প্রতিভা অনুধাবন করেন এবং তাকে ভিউলী ও ভগত নামে দু’টি পরগনার জায়গীর প্রদান করে মুসলিম রাজ্যের পূর্বসীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিযুক্ত করেন।

বখতিয়ারের জায়গীর সীমান্তে অবস্থিত বাংলার বিভিন্ন রাজ্য। তখন বাংলা শাসন করত সেন বংশ। তারা ছিল উগ্র ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী, সাম্প্রদায়িক, পরমত বিদ্বেষী ও অত্যাচারী। তারা বৌদ্ধদের উপর সীমাহীন নির্যাতন চালাত।তারা বৌদ্ধ পালদেরকে উৎখাত করে প্রজাদের উপর হিন্দুত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়।  কৌলিণ্য প্রথা প্রবর্তন করে তারা সমাজে অনৈক্য সৃষ্টি করে। সেন বংশ শাসিত গৌড় বা লক্ষণাবতীয় রাজের রাজধানী ছিল নদীয়া ও লক্ষ্মবতী। বখতিয়ার খিলজী  সৈন্য সংগ্রহ করে এক এক করে অত্যাচারী হিন্দু রাজ্যগুলোর উপর আক্রমণ চালান।

আরো পড়ুন: ‘বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের সময় থেকেই তুরস্কের সাথে আমাদের সম্পর্কের সূচনা’

তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেন বাংলার রাজধানী নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন। নদিয়াকে মনে করা হত সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চল। বলা হয়ে থাকে, নদিয়ায় আসার কিছু আগে রাজসভার কিছু পণ্ডিত তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এক তুর্কি সৈনিক তাকে পরাজিত করতে পারে। এতে করে লক্ষণ সেনের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করে।

লক্ষণ সেনের ধারণা ছিল, ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্য দিয়ে কোনো সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদিয়া আক্রমণ করা সম্ভব নয়; কিন্তু বখতিয়ার সেই পথেই তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসেন। নদিয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সাথে মাত্র ১৮ জন সৈনিকই তাল মেলাতে পেরেছিলেন। বখতিয়ার সোজা রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করেন। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষণ সেন দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন।

নদিয়া জয় করে পরবর্তীতে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসহ হন এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। এই লক্ষণাবতীই পরবর্তীকালে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। গৌড় জয়ের পর আরও পূর্বদিকে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি এলাকাগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে একজন করে সেনাপতিকে শাসনভার অর্পণ করেন। বখতিয়ারের সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে দুজনের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আলি মর্দান খলজি বরসৌলে, হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি গঙ্গতরীর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।

নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যে তিনি সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। তার সাথে অভিযানে সময় এবং পরবর্তীতে যেসব মুসলিম সেখানে বসবাসের জন্য আসেন, তাদের জন্য তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ নির্মাণ করেন। তিনি জানতেন, শুধু সামরিক শক্তির ওপরেই একটি রাজ্যের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে না, পরিপূর্ণ শান্তির জন্য চাই অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা। আর তাই তার প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের স্থায়ীত্ব-বিধানে তিনি সুষ্ঠু মুসলিম সমাজ তৈরির প্রয়াস নেন।

এভাবে মুসলমানগণ বিজয়ীর বেশে এ দেশে আসার পর এ দেশকে তারা মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। এদেশকে স্থায়ী আবাস ভূমি হিসাবে গ্রহণ করে এ দেশের অমুসলিম অধিবাসীর সাথে মিলেমিশে বাস করেন।  শাসক হিসাবে শাসিতের উপরে কোন অন্যায়-অবিচার তাঁরা করেননি। জনসাধারণও তাদের শাসন মেনে নেয়। তারা শুধু মুসলমানদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও মাদরাসা স্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি, পাশপাশি অমুসলিমদের প্রতি উদারনীতি অবলম্বন করেন।  বখতিয়ার ইচ্ছা করলে পলাতক লক্ষ্মণ সেনের পশ্চাদানুসরণ করে তাকে পরাজিত করতে পারতেন কিন্তু সে কথা তিনি মনে আদৌ স্থান দেননি। তাই অনেক নিরপেক্ষ হিন্দু ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতেও তাকে উদার মানসিকতার অধিকারী একজন শাসক হিসাবে দেখা হয়।

পূর্ববর্তি সংবাদবিশ্ব ওজোন দিবস: জীববৈচিত্র্যকে সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে রক্ষার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
পরবর্তি সংবাদকাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আসামির হঠাৎ মৃত্যু