নারায়ণগঞ্জজুড়ে দুই লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ!

ইসলাম টাইমস ডেস্ক: নারায়ণগঞ্জে বাসাবাড়ি ও শিল্প-কারখানায় তিতাস গ্যাসের অবৈধ লাইনের ছড়াছড়ি। যে যেভাবে পেরেছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং তিতাস গ্যাসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে এসব সংযোগ নিয়েছে। মাটির ওপর দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপ, জরাজীর্ণ লোহার পাইপ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে নেওয়া হয়েছে এসব অবৈধ গ্যাসের সংযোগ। ফলে যেকোনও সময় ঘটতে পারে নারায়ণগঞ্জের মসজিদের বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনা। ঝরে পড়তে পারে তাজা প্রাণ। তাছাড়া এভাবে অবৈধ সংযোগ নেওয়ায় সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

তিতাস গ্যাস অফিস সূত্রে জনা যায়, ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ ঘোষণা করা হলেও গত ১০ বছরে পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১৭৯ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছে। যার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। ২০১৩ সালের ৭ মে আবাসিক গ্যাস সংযোগ চালু করার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার বাড়িঘরে জ্বলছে গ্যাসের চুলা। শুধু আবাসিক বাসাবাড়িতেই নয়, বাণিজ্যিক লাইনেও রয়েছে অবৈধ সংযোগ নেওয়ার উৎসব।

ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সংযোগ

তবে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী মোহাম্মদ আল মামুন জানিয়েছেন, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আগামী দুই মাসের মধ্যে সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বিশেষ অভিযান চালানো হবে। সেখানে নারায়ণগঞ্জকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তিতাসের পক্ষে এককভাবে এই বিশাল কাজটি করা কষ্টসাধ্য। তাই এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’

সর্বাধিক অবৈধ লাইন বন্দর উপজেলায়

গত দুই বছর তিতাস কর্তৃপক্ষের অভিযানে বিচ্ছিন্ন হওয়া অবৈধ গ্যাস লাইনের সংখ্যাই বলে দেয় বন্দর উপজেলায় কী পরিমাণ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ দিনেই জেলার রূপগঞ্জ ও বন্দরের বিভিন্ন ইউনিয়নের ১১ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন তিতাসের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বন্দরের বিভিন্ন ইউনিয়নে অভিযান চালিয়ে ১৫ হাজার এবং ১৯ আগস্ট শুধু বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়নেরই ছয় হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

বন্দরের বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ গ্যাস সংযোগের মূল হোতা হলেন কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এসব ইউনিয়নে চেয়ারম্যানদের অনুমতি ছাড়া বৈধ বা অবৈধ যেকোনও গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ক্ষমতা খোদ তিতাসের কর্মকর্তাদেরও নেই। এছাড়া বন্দর সিটি করপোরেশনের ৯টি ওয়ার্ডে গ্যাস সংযোগের তদারকিতে আছেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এসব স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের যোগসাজশে রাতের আঁধারে পুরো বন্দর উপজেলায় হাজার হাজার বাড়িতে অবৈধ গ্যাস লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে গত কয়েক বছরে। প্রতি গ্যাস সংযোগের জন্য প্রতিটি বাড়ি থেকে ৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন এই চক্রের সদস্যরা।

বন্দর উপজেলার মুসাপুর ও ধামগর ইউনিয়নের গোকুলদাসেরবাগ ও কুটিপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মাটির ওপর দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপ, জরাজীর্ণ লোহার পাইপ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে নেওয়া হয়েছে গ্যাস লাইনের সংযোগ। এ ব্যাপারে বন্দর মুসাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন ও তার লোকজন গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে ৬০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা করে নিয়ে তিতাস গ্যাসের সংযোগ দিয়েছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন। যদিও অভিযোগটি অস্বীকার করে চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন জানিয়েছেন, তারা শুধু তদারকি করেছেন, যেন ঠিকাদাররা মানুষের টাকা না মেরে দেয় এবং গ্যাস মানুষ যেন পায়। তিনি বলেন, ‘সারদেশে যখন গ্যাসের সংযোগ নেওয়া হয়, ঠিক সেই সময়ই আমাদের এলাকার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সংযোগ দিয়েছি। শুধু শহরের মানুষ সুবিধা ভোগ করবে, আর গ্রামের মানুষ গ্যাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, তা হবে না। গ্যাস সংযোগ পাওয়া গ্রাহকরা বৈধ হাতে চান।’

তবে তিতাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকার পর কীভাবে গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের কোনও উত্তর তিনি দিতে পারেননি।

অভিযোগ রয়েছে বন্দরের এক ইউপি চেয়ারম্যানের নিজের প্রতিষ্ঠানই চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে। উপজেলায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বন্দর ও কলাগাছিয়া ইউনিয়ন। এই দুটি ইউনিয়নেই রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার অবৈধ লাইন।

সোনারগাঁয়ে গ্যাসের হরিলুট

সোনারগাঁ পৌর এলাকা ছাড়াও ১০টি ইউনিয়নের এমন কোনও গ্রাম নেই যেখানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেই। অভিযোগ রয়েছে শিল্পাঞ্চল কাঁচপুর, বিসিকসহ আশপাশের শিল্পঘন এলাকায় রীতিমতো তিতাস গ্যাসের হরিলুট চলছে। এসব এলাকায় আবাসিক বাসাবাড়ি ছাড়াও রয়েছে ছোট বড় কয়েকশ’ শিল্প প্রতিষ্ঠান। আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক যেকোনও গ্যাস সংযোগ নিতে হলে স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। পাশাপাশি যারা আগেই অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়েছেন এমন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রতি মাসে ওই জনপ্রতিনিধিদের মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতে হয় বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

একই অভিযোগ রয়েছে বারদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল হক ও সাবেক মেম্বার রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। উপজেলার আনন্দবাজার-বারদী সড়কের ছনপাড়া সেতুর কাছে সড়ক কেটে গ্যাসের পাইপ বসানোর অভিযোগ রয়েছে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ওই এলাকার ফুলদী গ্রামের বাসিন্দা আলী আজগর বলেন, ‘গ্যাস-সংযোগ নিতে আমরা ৭০-৮০ জন গ্রাহকপ্রতি ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা করে দিয়েছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চেয়ারম্যান জহিরুল হকের মোবাইলে ফোনে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে সাবেক মেম্বার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলার সর্বত্র এরই মধ্যে গ্যাস পৌঁছে গেছে। তাই আমরাও গ্যাস নিয়েছি। যেহেতু সরকার কাউকে বাধা দেয়নি, তাই সবার যা গতি হয় আমাদেরও তা-ই হবে।’

জানা গেছে, সোনারগাঁ পৌরসভার সাহাপুর এলাকায় তিতাসের প্রধান লাইন হতে অবৈধভাবে সংযোগ নিয়ে বৈদ্যের বাজার ও বারদী ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ গ্যাস ব্যবহার করছে। গত বছর এক অভিযানে এই এলাকায় অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ফলে প্রায় চার হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু মাত্র কয়েক দিন পরই সেই সংযোগ রহস্যজনক কারণে ফের চালু হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

রূপগঞ্জে অবৈধ গ্যাস লাইনের হিসাব নেই

গ্যাস সংকটের কারণে যেখানে শিল্পাঞ্চল রূপগঞ্জের অর্ধশত শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ হওয়ার হুমকিতে, সেখানে পুরো উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার অবৈধ আবাসিক গ্যাস লাইন। জানা গেছে, পুরো উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ১০ হাজার বৈধ গ্রাহকের জন্য ৪, ৩, ২ ও ১ ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ লাইন রয়েছে। এসব লাইন থেকে অবৈধ উপায়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংযোগ।

স্থানীয়রা জানান, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতারা সরাসরি এই গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি দলের কতিপয় নেতার ‘পারমিশন’ ছাড়া অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিতে পারেন না ঠিকাদাররা। তাই নেতাদের সঙ্গে বিশেষ ‘নেগোসিয়েশন’ এর মাধ্যমেই রাতের আঁধারে বা প্রকাশ্য দিবালোকে এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সংযোগ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঠিকাদার জানান, ‘রূপগঞ্জে সরকারি দলের নেতাদের ছাড়া আমরা এসব সংযোগ দিতে পারি না। রাতের আঁধারেও সংযোগ দিলে দিনে সে লাইন বন্ধ করে দেয়। ফলে তাদেরও টাকা দিতে হয়। যেখানে অবৈধ লাইনগুলো আমরা তিতাসের লাইনম্যানদের সঙ্গে আঁতাত করে ১০ থেকে ২০ হাজারে দিতে পারতাম, সেখানে এসব রাজনৈতিক নেতাদের কারণে গ্রাহককে বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে।

সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাস চুরি যেন বৈধ

সিদ্ধিরগঞ্জের ১৬টি চুনা ফ্যাক্টরি ও প্রায় ২০টি মশার কয়েল ফ্যাক্টরির কাছে তিতাস কর্তৃপক্ষ অনেকটাই যেন নমনীয়। গত কয়েক বছরে যে কয়েকটি মশার কয়েল ফ্যাক্টরি সিলগালা করা হয়েছে তার চেয়েও বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে।

স্থানীয়রা জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের ১৬টি চুনা ফ্যাক্টরি বাইপাসের মাধ্যমে গ্যাস চুরি করে আসছে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু এসব ফ্যাক্টরিতে কবে কখন অভিযান চলেছে তার কোনও ইয়াত্তা নেই। পাশাপাশি গত ১০ বছরে সিদ্ধিরগঞ্জে নতুন গড়ে ওঠা কয়েক হাজার বাসাবাড়িতে চুলা জ্বলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়েই।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকার প্রভাবশালীরা তিতাসের অসাধু ঠিকাদারদের সহায়তায় ক্ষেত্র বিশেষ এক থেকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে নতুন গড়ে ওঠা বহুতল আবাসিক ভবনে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়েই চলেছে।

তিতাসের অভিযানকে অনেকটা লোক দেখানো বলে ক্ষোভ জানিয়ে এলাকাবাসী বলেন, আমরা বৈধ গ্যাস লাইন নিয়ে, নিয়মিত বিল দিয়েও গ্যাস পাই না। সকালের রান্না করতে হয় রাতে, আর রাতেরটা ভোরে। বৈধদের গ্যাস শুষে নিচ্ছে অবৈধরা। তাদের অভিযোগ, সিদ্ধিরগঞ্জে কিছু অসাধু ঠিকাদার, স্থানীয় প্রভাবশালী তিতাসের নিম্নশ্রেণির কিছু কর্মচারীর সহযোগিতায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ এ বিষয়টি জানার পরও দীর্ঘদিন ধরে নীরব ভূমিকা পালন করছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।

এদিকে, একই অবস্থা বিরাজ করছে জেলার ফতুল্লা, আড়াইহাজার ও সদর এলাকাতেও। একই পন্থায় এসব এলাকাতেও নেওয়া হয়েছে অগণিত অবৈধ গ্যাস সংযোগ।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

আরো পড়ুন:

তিতাসের আবেদনে ৫ লাখ টাকার জরিমানা স্থগিত করল আপিল বিভাগ

মসজিদে বিস্ফোরণ: লিকেজ হওয়া পাইপটি পরিত্যক্ত ২২ বছর ধরে, গ্যাস বন্ধ করেনি তিতাস

মসজিদকে যারা অবৈধ বলার চেষ্টা করেছে তারাই অবৈধ: খেলাফত মজলিস

মসজিদ বৈধ জায়গায় রয়েছে, মুতাওয়াল্লী জমি দান করেছেন: নারায়ণগঞ্জ ওলামা পরিষদ

পূর্ববর্তি সংবাদকুড়িগ্রামে মাদকসহ পল্লী চিকিৎসক আটক
পরবর্তি সংবাদমসজিদে বিস্ফোরণ: আলামত বুঝে পেল সিআইডি