পূজার অনুষ্ঠানে ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের কৈফিয়ত কেন?

ইমামুদ্দীন মেহের ।।

বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিক ও ভারত নামক রাষ্ট্রের স্বার্থ-সুবিধা কি অভিন্ন? হিন্দু বললেই ভারত ভাবতে হবে? ভারতের কথা উঠলেই হিন্দুদের মন জুগিয়ে কথা বলতে হবে? এ প্রশ্নটি আবার সামনে এসেছে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সরকার পরিচালনাকারী দলের সাধারণ সম্পাদক সাহেবের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে। গত ১১ আগস্ট মঙ্গলবার হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমী পালন উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত তথা শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি সরকারের সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। দু’দেশের সম্পর্ক একাত্তরের রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ। বর্তমানে এ বন্ধুত্ব ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ।’

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, মোদি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক ‘ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে উষ্ণ ও সৌহাদ্যপূর্ণ’ হতেই পারে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্ঠমী পূজার অনুষ্ঠানে সরকারের একজন মন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দিতেই পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদেশের হিন্দুদের পূজার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় আমাদের একজন মন্ত্রীর ভারত নামক রাষ্ট্রটির সঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্টের সুসম্পর্কের ওপর কথা কেন বলতে হবে? মোদি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের ‘সবচেয়ে উষ্ণ ও সৌহাদ্যপূর্ণ’ সম্পর্কের কথা কেন মনে করিয়ে দিতে হবে? তবে কি এদেশের হিন্দু নাগরিক ও ভারত নামক রাষ্ট্রের সুবিধা ও স্বার্থ অভিন্ন? তবে কি বাংলাদেশে বসবাস করলেও এদেশের প্রধান সংখ্যালঘু ধর্মের অনুসারীরা মনের গহীনে ও প্রকাশ্যে ভারত নামক রাষ্ট্রটির প্রতি বিশেষ দুর্বলতা অনুভব করেন? এবং এ বিষয়টির প্রতি সযত্ন সমর্থন ও সচেতন উৎসাহদানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মন্ত্রী মহোদয় পূজার অনুষ্ঠানেও ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের কথাটি বলতে ভুলেননি?

বাস্তব ঘটনা কী- তা আমরা জানি না। কিন্তু এজাতীয় অনুষ্ঠানে এধরনের বক্তব্য থেকে যে প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসে, আমরা শুধু সেটাই উল্লেখ করলাম। পূজার অনুষ্ঠানে ভারত-বন্ধুত্ব টেনে আনায় এজাতীয় প্রশ্ন জাগতেই পারে। মন্ত্রীর বক্তব্যকে অনেকটা হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে দেওয়া বিশেষ কোনো কৈফিয়তের মতো মনে হয়েছে।

ভারতের মুসলমান হত্যার নায়কদের একজন মনে করা হয় নরেন্দ্র মোদিকে। ‘গুজরাটের কসাই’ ছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বিশ্লেষণ। পৃথিবীর বড় রাষ্ট্রগুলোতে মোদির ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সমন জারি করা হয়েছিল। এনআরসি, সিএএ বাস্তবায়নকারী বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা ভারতের বাংলাভাষী লাখ লাখ মুসলমানদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার হুংকার দিয়েছে এক বছর পার হয়নি। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেখানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মন্দির বানানোর কাজ শুরু করা হয়েছে। সেই মোদি সরকারের সঙ্গে ‘উষ্ণতম সম্পর্কের’ কথা বলে আমাদের মন্ত্রী মহোদয় আরো বলেছেন, ‘অসহিষ্ণুতা এবং সাম্প্রদায়িকতার স্থান পৃথিবীর কোনো ধর্মেই নেই। ধর্মের নামে যারা অধর্ম চর্চা করে, ধর্মকে স্বার্থসিদ্ধির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, এসব তাদের হাতিয়ার। যারা সম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ কিংবা উগ্রতা চর্চা করে প্রকৃতপক্ষে তারা ধর্মের মূল শিক্ষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।’

মন্ত্রীর বক্তব্যের এই অংশটি বেশ সুন্দর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে উষ্ণ বন্ধু্ত্বের কথা বলে এ বক্তব্যটি তাহলে কার বা কাদের উদ্দেশে দেওয়া হলো? প্রশ্ন হলো, মোদি এবং তার দলের চেয়ে, ভারত নামক রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতাবাদী অনাচারের চেয়ে এ মুহূর্তে পৃথিবীতে আর কে এতবড় সাম্প্রদায়িকতাবাদী শক্তি ও গোষ্ঠিী? সেই মোদির ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা মুখভরে বাংলাদেশের হিন্দুদের কেন শোনাতে হচ্ছে? এদেশের নাগরিকদের একটি অংশের সঙ্গে কি তাহলে ভারত নামক রাষ্ট্রের এবং মোদি সরকারের বিশেষ কোনো গাঁটছাড়া রয়েছে? এবং সে কথাটি মাথায়-মনে সদা জাগ্রত থাকার কারণেই এভাবে দুটি পক্ষকে একাকার করে কথা বলতেই হচ্ছে? দেশের মানুষের মনে নানারকম ধারণা বিরাজ করে। মন্ত্রীর এই বক্তব্য সেসব ধারণার ডালপালা বিস্তারে আরো সহায়কের ভূমিকা রাখে কিনা- বুঝতে পারছি না।

আরেকটি দৃ্ষ্টিকটূ ব্যাপারের কথা বলি। হিন্দুদের পূজার অনু্ষ্ঠান কিংবা খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়ে আমাদের বড় নেতাদের কেউ কেউ দায়মুক্ত হওয়ার একটা আমেজ নিয়ে প্রায়ই ‘সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ’ বিরোধী গরমাগরম কিছু বক্তব্য ঢেলে দেন। অথচ উপমহাদেশব্যাপী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বড় কোনো বিষাক্ত মানবাচার এখন নেই। কিন্তু সেটি নিয়ে কথা বলেন না তারা।

দুনিয়াজুড়ে বর্ণবাদী, খ্রিস্টান সুপ্রিমেসির হেইটক্রাইম আর সাম্রাজ্যবাদী বোমাবাদ পুরোদস্তুর সচল। এ অবস্থায় অপর ধর্মের অনুষ্ঠানে মুসলমানদের একটি গোষ্ঠীর দিকে ইঙ্গিত করে নেতিবাচক বক্তব্য ছেড়ে দেওয়া জাতীয় ও দেশীয় আত্মমর্যাদার সঙ্গে কতোটা সামঞ্জস্যশীল- এ প্রশ্নটিও বড় হয়ে ওঠে। বিশেষত টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড এবং এর জের ধরে এক প্রদীপ দাসের হাতে শতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যখন দেশজুড়ে আলোচনা ও ক্ষোভের বিষয়ে পরিণত, তখন এমন বক্তব্য থেকে নিরীহ আম জনতা ভুল কোনো বার্তা গ্রহণ করলে শুধু তাদের ঘাড়েই কি দোষ চাপানো যাবে?

পূর্ববর্তি সংবাদএবার ১১ মার্কিন কর্মকর্তার ওপর চীনের নিষেধাজ্ঞা
পরবর্তি সংবাদনেত্রকোনায় ট্রলার ডুবি: শহিদদের পরিবারে রিক্সা ভ্যান দিয়ে সহায়তা পিসবের