পারিবারিক সংকট: ‘করোনার কী আর ভয়, আমি তো ঘরের করোনায় আক্রান্ত’

মাওলানা হাসান মুরাদ।।

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি জানতে পারেন তোমাদের মধ্যে কে নেক আমলে উত্তম।’ -সূরা মুলক: ২

বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই সব জানেন, আমরা কিছু জানি না। আল্লাহ মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ইচ্ছে করলে নেক বা পাপ কাজ করতে পারে। তবে মানুষের পেছনে লেগে আছে চিরশত্রু শয়তান। শয়তান সর্বদা মানুষকে নেক আমল থেকে বিচ্যুত করতে চায়। ভ্রষ্টতার পথে ঠেলে দেয়।

পবিত্র কোরআনের ৯টি সূরার ৯ স্থানে এসেছে, ‘আর শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ শয়তান প্রকাশ্য শত্রু, কিন্তু ধোঁকা দেয় আড়ালে থেকে এবং বিভিন্নভাবে।

হাদিস শরিফে এসেছে হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, শয়তান পানির ওপর তার সিংহাসন স্থাপন করে, তারপর তার বাহিনী প্রেরণ করে। আর সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত সে, যে বেশি ফেতনা সৃষ্টি করে। সিংহাসনে বসে শয়তান সকলের ফেতনার ফিরিস্তি শোনে। একজন এসে বলে আমি অমুক কাজ করেছি, শয়তান বলে তুমি তেমন কোনো কাজ করোনি। এভাবে শয়তান প্রেরিত অন্য শয়তানদের মন্দ কাজের বিবরণ শুনতে থাকে। অতঃপর একজন এসে বলে আমি অমুকের সঙ্গে ধোঁকার আচরণ করেছি, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছি। একথা শুনে শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয়। আর বলে তুমিই বড় কাজ করেছ। হাদিস বর্ণনাকারী আমাশ বলেন, আমার মনে হয় তিনি বলেছেন, অতঃপর শয়তান তাকে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। -সহিহ মুসলিম শরিফ: ৬৮৪৬

শয়তান মানুষের জীবনের বাঁকে বাঁকে বিভিন্নভাবে ধোঁকা দেয়। মানুষের ইবাদত-বন্দেগি ও আমল নষ্ট করতে চায়। তবে বর্ণিত হাদিসসহ অন্য আরও হাদিস থেকে থেকে বোঝা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ একটি বড় ফেতনা এবং এটা শয়তানের পছন্দনীয় কাজ।

সমাজের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কিছু না কিছু অশান্তি বিরাজমান। পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা কারণে পারিবারিক ও সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

ইসলাম পরিপালন করার ক্ষেত্রে নামাজ, রোজা, হজ হয়ত আমরা পালন করি, কিন্তু ইসলাম সংসার ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে যে আদর্শ দিয়েছে, তা জানি না এবং জানার চেষ্টাও করি না। অনেকে তো বিয়ের মাধ্যমে যে পারিবারিক জীবন গড়ে উঠে তার উদ্দেশ্যই জানে না। স্বামী-স্ত্রী, শশুর-শাশুড়ি থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ভাবে। ইসলামের নীতিকথা ভাবে না। ইসলামের বিধান অনুসরণ করে না। ফলে স্বাভাবিকভাবে পারিবারিক সংকট তৈরি হয়।

সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে, করোনাকালে পারিবারিক সংকট অনেক বেড়ে গেছে। এর কারণ কী? এখন তো বিপদের সময়, এই কঠিন সময়ে তো পরিবারের সবার একত্রে, মিলেমিশে থাকার কথা। যারা কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে বেশি সময় থাকেন, তাদের জন্য তো এই সময়টা বলতে গেলে এক প্রকার নেয়ামত। কারণ এ উসিলায় পরিবারকে সময় দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

সেদিন এক প্রতিবেশী মনোকষ্টে বলেই ফেললেন, করোনার কী আর ভয়! আমি তো ঘরের করোনায় আক্রান্ত! বিষয়টি স্পষ্ট করে বুঝতে চাইলে তিনি যা বললেন, সেটার সারাংশ হচ্ছে- তার স্বামী বিভিন্ন নারীর সঙ্গে চ্যাটিং করে। আগে বাইরে থাকত। বাসায় আসার পূর্বে সব বন্ধ রাখত। কিন্তু এখন বাইরে যেতে পারে না। বিষয়টি ভাববার মতো।

এখন অনেকেই সামাজিক বিভিন্ন নেটওয়ার্কে জড়িত। সেখানে পুরুষের নারী বন্ধু, নারীর পুরুষ বন্ধু এসব বাধাহীন সম্পর্কের ছড়াছড়ি। এসব সম্পর্কের কুফল এসে পড়ে পারিবারিক সম্পর্কে। এর কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব থেকে পরিবারিক বিবাদ-বিতর্ক কখনও গড়াচ্ছে বিচ্ছেদে। আর হাতাহাতি, মারামারি, খুন-খারাবিতো আছেই। বলি, এর নিরসন কোন পথে?

মানুষ সামাজিক জীব। একসঙ্গে বসবাস করতে গেলে অনেক কিছুই হতে পারে। তবে আমরা সেটাকে ক্ষমা সুন্দর আচরণে দেখতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ না করে ক্ষমাশীল হতে হবে। একে অপরের ভালো-মন্দ উভয়টিই তুলনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শয়তান আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে। তার সৃষ্ট ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না। কোনো সংকট দেখা দিলে তা নিরসনে পরিবারের মুরুব্বি ও বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে পরিবারের প্রত্যেকেই নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। পুরুষ ভিন্ন নারী সঙ্গ এবং নারী ভিন্ন পুরুষ সঙ্গ বর্জন করে চলবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, একে অপরের অধিকার আদায় করা। পারিবারিক জীবন সম্পর্কে ইসলাম কী বলেছে, সেগুলো জানতে চেষ্টা করা ও সেভাবে চলা।

পারিবারিক অশান্তি নিরসনে পর্দার কোনো বিকল্প নেই। নারী-পুরুষ উভয়কেই শরয়ি পর্দা করতে হবে। এর সঙ্গে যাবতীয় লোভ ও হিংসা পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অনেক পরিবার নষ্ট হয়েছে লোভের কারণে। অমুক এতকিছু করেছে বা পেয়েছে, আমি কি পেলাম? এসব অবান্তর বিষয় মনে স্থান দেওয়া যাবে না। সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় ঘটাতে হবে। কারো সঙ্গে কোনো বিষয়ে তুলনায় যাওয়া যাবে না। অল্পেতুষ্টির অভ্যাস গড়তে হবে। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, উল্লেখিত বিষয়গুলো মেনে চললে, যাবতীয় পারিবারিক সংকট সহজে নিরসন হবে- ইনশাআল্লাহ।

শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম, বুজরুকগড়গড়ী, চুয়াডাঙ্গা।

পূর্ববর্তি সংবাদলেবাননে বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশের গুদামে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে উদ্বেগ
পরবর্তি সংবাদদুদকের মুখোমুখি স্বাস্থ্যের সাবেক ডিজি আজাদ