
ইসলাম টাইমস ডেস্ক: গত ৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি অযোধ্যার শহিদ করা বাবরি মসজিদের স্থানে সোনা-রূপার ইট দিয়ে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। পাকিস্তান সরকার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছে, এই কাজটি ভারতের অসার গণতন্ত্রের চেহারায় কলঙ্কের দাগ এঁকে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে বুধবার অযোধ্যায় সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। যদিও করোনা সংকটের দরুন আমন্ত্রিত অতিথি সংখ্যা ১৭৫ এ নামিয়ে আনা হয়। তম্মধ্যে কট্টরপন্থী আর এস এস প্রধান, মন্দির ট্রাস্টের প্রধানও ছিলেন।
নরেন্দ্র মোদির আগমনের পর রাম মন্দিরের স্থানে ভূমিপুজোর আয়োজন করা হয়। পুজো শেষে প্রস্তাবিত মন্দিরের গর্ভগৃহে রূপার তৈরী একটি প্রতীকী ইট স্থাপন করা হয়। যা পরবর্তীতে মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান হিসাবে বিবেচিত হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যে নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত সাধুসন্ন্যাসীদেরকে লক্ষ করে বলেন, ‘আজকের দিন ভারতের এক ঐতিহাসিক দিন। রাম সবার, তিনি সবার মাঝে আছেন।’ হিন্দু ভগবানকে তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির মূল, মাবনতার প্রতীক ও জাতীয় ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করেন। তিনি আরো বলেন, ‘অযোধ্যার এই ঐতিহাসিক দিনের সাক্ষী হতে পেরে আমি বড় কৃতজ্ঞ। কোটি হিন্দুস্তানি এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে এই দিন এসে গেছে। সারা দেশে রাম রাম ধ্বনিত হচ্ছে। রাম কোটি মানুষের ঐক্যের প্রতীক।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাম মন্দিরের জন্য অসংখ্য মানুষ শত বছর ধরে আযাদী আন্দোলনের মতো সংগ্রাম করে আসছে। আজকের দিনটি সেই সংগ্রামের প্রতিফলন, আত্মোৎসর্গের প্রতিচ্ছবি। রামজন্মভূমি আজ মুক্ত হয়েছে।’ মোদি বলেছেন, ‘আদালতের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত পুরো ভারতবাসী মেনে নিয়েছে কারো আবেগ-উদ্বেগকে আঘাত করা ছাড়াই। সেই অনুভূতি আমি আজও দেখতে পাচ্ছি। সবার আবেগের প্রতি লক্ষ রাখা আমাদের কর্তব্য। সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে করে চলতে হবে। সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। তবেই দেশের উন্নয়ন হবে।’
এসময় আর এস এস প্রধান ও যোগী আদিত্যনাথও ভাষণ প্রদান করেন। তাদের বক্তব্যেও আগের মতো নেতিবাচক, সংঘাত পূর্ণ কিছু ছিলো না।
তবে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া ভূমিপুজোয় নরেন্দ্র মোদী ও আদিত্যনাথের অংশগ্রহণের চরম সমালোচনা করেছে। তাদের পক্ষ থেকে টুইট করা হয়েছে, ‘রাজনীতিকে ধর্ম মুক্ত রাখার প্রবক্তাগণ আইনের প্রতি লক্ষ করুন। ভারতের সুস্পষ্ট আইন হলো, ধর্ম ও রাজনীতি একসাথ করা যাবে না। তবে কেন প্রধানমন্ত্রী ও উত্তরপ্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী একটি মন্দিরের ভূমিপুজোর মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিলেন!’
কংগ্রেস প্রধান রাহুল গান্ধী তার এক বক্তব্যে বলেন, ‘ভগবান রাম ভালোবাসা ও ন্যায়ের প্রতীক। তিনি কখনও ঘৃণা ও অন্যায়ের কাজে তুষ্ট হবেন না।’
মন্দিরের নির্মাণ ভারতীয় গণতন্ত্রের মুখে কলঙ্কের দাগ
রাম মন্দির নির্মাণে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পাকিস্তান বলেছে, একটি ঐতিহাসিক মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণ করার মাধ্যমে ভারতের অসার গণতন্ত্রের মুখে কলঙ্ক লেপে দেওয়া হলো।
এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘যে ভূমিতে সুদীর্ঘ ৫ শত বছর বাবরী মসজিদ বিদ্যমান ছিল, সেখানে রাম মন্দির নির্মান করা একটি নিন্দনীয় সিদ্ধান্ত। মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণে আদালতের এই রায় ভারতের সংখ্যাগুরুদের জুলুমের বহিঃপ্রকাশ শুধু নয় বরং এই রায়ে ফুটে উঠেছে ন্যায়ের বিপক্ষে একটি ধর্মের অন্যায়-বিজয় এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের ইবাদতখানাগুলোকে একের পর নিশানা বানানোর চিত্র।’
মিডিয়ার রিপোর্ট মতে, মন্দিরের জন্য সারা দেশ থেকে সোনারূপা, অর্থকড়ি জমা করা হচ্ছে। পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এসব সংরক্ষণের।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার মতে, বিগত বছরগুলোতে সাধারণ হিন্দুদের কাছ থেকে প্রায় দুই লক্ষ সোনার ইট সংগ্রহ করা হয়। যেগুলোর ওপর ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা হয়। এগুলো মন্দিরের মূল কাঠামোতে ব্যবহার করা হবে।
মন্দির নির্মানকারী প্রধান আর্কিটেক্ট বলেন, ‘মন্দিরের স্টাইল হবে উত্তর ভারতে প্রসিদ্ধ স্টাইলের অনুরূপ। গর্ভগৃহ -যেখানে প্রধান মূর্তি রাখা হবে- তা আটটি দেয়াল পরিবেষ্টিত হবে। মন্দিরে ৩৬৬ খুঁটি ও পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি তিল তলা ভবনও নির্মাণ করা হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘মন্দির নির্মাতাদের স্মরণে একটি সৌধও বানানো হবে।’
অযোধ্যার এই বিতর্ক কেন
মোঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবরের শাসনামলে তার নামে স্থানীয় এক জেনারেল এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। অনেক হিন্দুদের ধারণা, তাদের ভগবান রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছে এই স্থানে। তারা মনে করে, রাম মন্দির ভেঙ্গে বাবরী মসজিদ তৈরী করা হয়েছিলো। ঊনিশ শতকে এই স্থান নিয়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা আদালত পর্যন্ত গড়ালে ইংরেজ সরকার মুসলমানদের পক্ষে রায় দেয়।
ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কতিপয় সন্নাসী মসজিদের মিম্বারে রামচন্দ্রের মূর্তি রেখে দেয়। স্থানীয় সরকার তখন দাঙ্গা হাঙ্গামার আশংকায় মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। এবং তার পর থেকে আর কখনও সেখানে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বিজেপির সিনিয়র নেতা এল কে আদবানীর নেতৃত্বে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন মিলে রাম মন্দিরের জন্য একটি তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে বাবরী মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণকে বিজেপি নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদকে শহীদ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনা সমগ্র ভারতে ভয়ংকর দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। কোটি মানুষের রক্তের বন্যা বয়ে যায় এতে। রাম মন্দির আন্দোলন হিন্দু-মুসলিম অস্থিরতার সূচনা করেছিলো।
আদালতের ফায়সালা কী ছিলো
গত বছর নভেম্বর মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সুদীর্ঘ এক মোকদ্দমা শেষে বাবরী মসজিদের স্থানে বিতর্কিত রাম মন্দির স্থাপনের রায় প্রদান করে।
আদালত বলেন, আর্কিউলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট মতে, বাবরী মসজিদের নীচে এমন এক ভবনের চিহ্ন পাওয়া যায়, মুসলিম নিদর্শনের সাথে যার কোনো মিল নেই। এই সাক্ষের ভিত্তিতে আদালত বাবরী মসজিদের ভূমি হিন্দুদেরকে প্রদান করে এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য মুসলমানদেরকে ভিন্ন একটি ভূখণ্ড প্রদান করার আদেশ জারী করে। এবং যাবতীয় কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের লক্ষে একটি কমিটি গঠনের আদেশ দেয়।
আদালত এটাও বলেন, ‘বাবরী মসজিদ ধ্বংস করা আইন বিরোধী ছিলো।’
শহীদ বাবরি মসজিদ: মুসলিম হৃদয়ে রক্তক্ষরণের নতুন প্রতীক
বাবরি মসজিদ মামলা : রায়ের প্রধান ভিত্তিটাই সন্দেহমূলক
বাবরি মসজিদের নিচে রামমন্দিরের কোনো অস্তিত্ব নেই
পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া
১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ শহীদ করা হলে পাকিস্তানে অনেক মন্দিরে ভাংচুর করা হয়। এবার রাম মন্দিরের সূচনা বিতর্ককে কেন্দ্র করে গত মাসে পাকিস্তানে মন্দির ও গীর্জা সংরক্ষক সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে মন্দির-গীর্জার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়। এবং উক্ত সংস্থার পক্ষ থেকে রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে সার্বক্ষণিকভাবে প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয় যেন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।
এই সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সারাদেশের বিশৃঙ্খলা আমাদের একার পক্ষে পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব। তাই আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।’
রাম মন্দির স্থাপনের প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানে ঘটার বিষয়ে ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিচ স্টাডিজের ডিরেক্টর আমের রানা। তিনি বলেন, ‘আগস্ট মাস দুই দেশেরই বিজয়ের মাস। তাই দুই দিকেই উত্তেজনা বিরাজ করবে। এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলো আন্দোলনও করতে পারে। কিন্তু বড় কোন বিপর্যয়ের কোনো আশংকা নেই এতে। কেননা, দুই দিকের বাসিন্দারাই বাবরী মসজিদ বিতর্কে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকেই মেনে নিয়েছে। এবং সবাই এখন সামনে অগ্রসর হতে চায়।’
পাঞ্জাবের তথ্যমন্ত্রী ফাইয়াজ হাসান চৌহানও মনে করেন, এসময়ে পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হলেও পাকিস্তানিরা বড় সতর্ক। তারা সংখ্যালঘুদের উপসনালয় ও ধর্মীয় স্থানগুলোর ক্ষতি সাধন করবে না। আর রাস্ট্রও এমন কোন কর্মকাণ্ডের সুযোগ দেবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘পাকিস্তান করতারপুর করিডোর খোলার মতো উদার পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর বিপরীতে ভারত মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিপক্ষে কাজ করছে। যা ভারতকে বিশ্বের সামনে হাসির পাত্র বানিয়ে তুলেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বিজেপির কর্মকাণ্ডে দেশটি আর সেকুলার থাকেনি। সমগ্র বিশ্ব আজ তাদেরকে নিন্দা জানাচ্ছে।’
বিবিসি অবলম্বনে- মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন আজিম