তোমাদের ভাই তোমাদের সেবক

মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ।।

আজকের দরসে যে হাদীসটি পাঠ করেছি তা একটি বিখ্যাত হাদীস। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্য অনেক হাদীসগ্রন্থে তা বর্ণিত হয়েছে। আমি সহীহ বুখারী থেকে তা পাঠ করেছি। ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীর কয়েক জায়গায় হাদীসটি এনেছেন। ঈমান-অধ্যায়ে এই হাদীসের উপর তাঁর শিরোনাম-

“المعاصي من أمر الجاهلية”

অর্থাৎ ‘নাফরমানি ও গুনাহ জাহেলিয়াতের বিষয়।’

জাহেলিয়াহ কাকে বলে?

প্রাক-ইসলামী যুগের শিরক ও কুফরের অন্ধকার চিন্তা-বিশ্বাস এবং সেই অন্ধকার বিশ্বাস লালনকারীদের রীতি-নীতিকে ‘জাহেলিয়াহ’ বলে। ইসলামের মাধ্যমে আলোর সন্ধান পাওয়া মানুষ জীবনের সবক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের অন্ধকার সম্পর্কে সচেতন থাকবে। আকীদা-বিশ্বাসে তো বটেই জীবনের সাধারণ কাজ-কর্মেও জাহেলিয়াতের অনুসরণ থেকে বেঁচে থাকবে। তাই ইমাম বুখারী রাহ.-এর শিরোনাম –

“المعاصي من أمر الجاهلية”

গুনাহ ও নাফরমানি জাহেলিয়াতের বিষয়। এগুলো ইসলামের বিষয় নয়; ইসলামবিরোধী বিষয়।

এই শিরোনামে তিনি যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তা আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন মনীষী সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী রা.-এর একটি ঘটনা।

কে ছিলেন হযরত আবু যর? হাফেয যাহাবী রাহ. ও অন্যান্য রিজালবিদ বলেছেন, তিনি ‘সাবিকীনে আওয়ালীনে’র একজন ছিলেন। ‘সাবিকীনে আওয়ালীন’ অর্থ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লামের ঐসকল সম্মানিত সাহাবী, যাঁরা ইসলামের শুরুর যুগেই ইসলাম কবুল করেন। কুরআন মাজীদে তাঁদের উল্লেখ অত্যন্ত মর্যাদার সাথে হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ السّٰبِقُوْنَ الْاَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهٰجِرِیْنَ وَ الْاَنْصَارِ وَ الَّذِیْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِاِحْسَانٍ، رَّضِیَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ وَ اَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ تَحْتَهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۤ اَبَدًا، ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ.

মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নি¤œদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এ-ই তো মহাসাফল্য। -সূরা তাওবা (৯) : ১০০

কারো কারো মতে, তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে পঞ্চম। তবে মক্কায় এসে ইসলাম কবুল করার পর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে নিজ এলাকায় চলে যান। হিজরতের পর মদীনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসেন। জীবনের শেষ দিকে মদীনা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ‘রাবাযা’তে বসবাস করেছেন। ৩২ হিজরীতে ইন্তিকাল।

স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এই সাহাবী সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

مَا أَقَلّتِ الْغَبْرَاءُ، وَلَا أَظَلّتِ الْخَضْرَاءُ، مِنْ رَجُلٍ أَصْدَقَ لهجة مِنْ أَبِي ذَرٍّ.

‘এই ধুসর মাটির উপরে, এই সবুজ আকাশের নিচে আবু যরের চেয়ে বেশি সত্যভাষী আর কেউ নেই।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৫৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮০১

সুবহানাল্লাহ!

* * *

বুখারীর এ বর্ণনায় এই মনীষী সাহাবীর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন তাবেয়ী মা‘রূর ইবনে সুয়াইদ রাহ.। ইনি কুফার অধিবাসী ছিলেন। হাদীসশাস্ত্রের ইমামদের কাছে ‘ছিকা’-বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি বলেন, আমি রাবাযায় আবু যর গিফারী রা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করি। দেখলাম, তাঁর পরনে যে পোশাক তাঁর গোলামের পরনেও সেই পোশাক। আমি তাঁকে এই অভিন্নতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি তখন তাঁর জীবনের একটি ঘটনা শোনালেন-

একবার এক ব্যক্তির সাথে আমার কটূক্তি বিনিময় হয়ে গেল। আমি তাকে তার মায়ের কথা বলে খোঁটা দিই।…

খোঁটাটা কী ছিল?       রেওয়ায়েতে আছে যে, ‘আবু যর গিফারী রা. তাকে- يا ابن السوداء ‘হে কালো মায়ের সন্তান!’ বলে সম্বোধন করেছিলেন।’

একে তো গায়ের রং নিয়ে খোঁটা দেয়া, দ্বিতীয়ত কথা কাটাকাটি হয়েছে একজনের সাথে, সেখানে মায়ের কী অপরাধ? এই ব্যক্তি গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ দায়ের করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন-

أَعَيّرْتَهُ بِأُمِّهِ؟ إِنّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيّةٌ.

‘তাকে তার মায়ের কথা বলে লজ্জা দিলে! তুমি তো দেখছি এমন লোক, যার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়ে গেছে!’

তাহলে কোন্ কৃষ্ণতা লজ্জার? বাইরের কৃষ্ণতা, না ভিতরের কৃষ্ণতা? হাদীস শরীফ আমাদের সচেতন করছে যে, ভেতরের সাদা-কালোকে ভুলে আমরা যেন বাইরের কালো-সাদা নিয়ে পড়ে না থাকি।

মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বে বাইরের কালো-সাদার কোনো প্রভাব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নির্মিত হয় ভেতরের সাদা-কালো দ্বারা। আল্লাহ্র কাছে সে-ই বেশি মর্যাদার, যে বেশি মুত্তাকী।

এক রেওয়ায়েতে আছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরের কথায় অবাক হয়ে আবু যর গিফারী রা. প্রশ্ন করেছিলেন-

مَنْ سَبّ الرِّجَالَ سَبّوا أَبَاهُ وَأُمّهُ.

আল্লাহর রাসূল! কেউ কাউকে কটূক্তি করলে সচরাচর সে তার মা-বাবা সম্পর্কেও কটূক্তি করে থাকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৬১

অর্থাৎ বিষয়টির নিষিদ্ধতা তাঁর জানা ছিল না। তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবধান করে দিলেন, যার অর্থ, এটা জুলুম এবং জাহেলিয়াত। ইসলামের বিধান হল, কেউ যদি কাউকে কষ্ট দেয় তাহলে সমান সমান প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আছে। তবে ক্ষমা করা উত্তম। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوْا بِمِثْلِ مَا عُوْقِبْتُمْ بِهٖ،  وَ لَىِٕنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَیْرٌ لِّلصّٰبِرِیْنَ.

যদি তোমরা শাস্তি দাও-ই, তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দিবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য তা-ই তো উত্তম। -সূরা নাহল (১৬) : ১২৬

কাজেই কেউ কাউকে কটূক্তি করলে সে তাকে অনুরূপ কটূক্তি করতে পারে, যদি না তাতে কোনো অশ্লীলতা বা অনাচার থাকে। কিন্তু যদি একজনের কটূক্তির কারণে তার মা-বাবা সম্পর্কে কটূক্তি করা হয় তাহলে এটা জুলুম ও সীমালঙ্ঘন হয়ে যায়। মা-বাবা তো অপরাধ করেননি তাহলে কেন তারা কটূক্তির শিকার হবেন।

জুলুম ও সীমালঙ্ঘন হচ্ছে জাহেলিয়াত। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমাশীলতা।

ইমাম বুখারী রাহ. শিরোনাম দিয়েছেন- “المعاصى من أمر الجاهلية”

‘গুনাহসমূহ জাহেলিয়াতের বিষয়।’

তাঁর শিরোনাম ও শিরোনামে নির্বাচিত হাদীস শরীফ থেকে যেমন জানা যাচ্ছে যে, গুনাহ ও পাপাচার হচ্ছে কুফুর-জাহেলিয়াতের শাখা-প্রশাখা তেমনি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে গুনাহ ও পাপাচারের বিস্তৃতি সম্পর্কেও । আমাদের পারস্পরিক আচরণের মধ্যেও আছে ইনসাফ ও জুলুমের প্রসঙ্গ । আছে গুনাহ ও সওয়াবের বিষয়। পরস্পর কথা কাটাকাটির মধ্যে কত সময় কত জুলুম হয়, তা হয়ত আমরা খেয়ালই করি না। অথচ তা খেয়াল করা কত প্রয়োজন।

স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পাড়া-পড়শির মধ্যে এমন কত ঘটনা ঘটে যায় যেখানে কথা কাটাকাটির মধ্যে যেকোনোভাবে কথায় হারিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা থাকে। একজন একটা বললে তাকে তিনটা শুনিয়ে পরাস্ত করার চেষ্টা করা হয় অথচ কর্তব্য হচ্ছে, ইনসাফের মধ্যে থাকা, নতুবা সবরের মাধ্যমে দৃশ্যত পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। ঈমানী প্রজ্ঞা থাকলে বোঝা যাবে, এটা পরাজয় নয়; মহা বিজয়। আপনার প্রতিপক্ষ জুলুমের মাধ্যমে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করল আর আপনি ইনসাফের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করলেন কিংবা সবর ও ক্ষমার দ্বারা নিজ আমলনামাকে আরো সমৃদ্ধ করলেন।

ইমাম বুখারী রাহ.-এর শিরোনাম আমাদের জানাচ্ছে যে, পারস্পরিক আচরণও গুনাহ-সওয়াবের অনেক বড় ক্ষেত্র। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া চাই। এটা হাদীস শরীফের শিক্ষা।

* * *

এক রেওয়ায়েতে আছে, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সতর্ক করলেন তখন বিষয়টি জানা ও বোঝার পর হযরত আবু যর গিফারী রা. আক্ষেপ করে বললেন-

عَلَى حِينِ سَاعَتِي هَذِهِ مِنْ كِبَرِ السّنّ؟

ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই বৃদ্ধ বয়সেও আমার মধ্যে এই বিষয়টি রয়ে গেল! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৫০

এই হচ্ছে সাহাবায়ের কেরামের বৈশিষ্ট্য। দোষ-ত্রুটি সামনে আসার পর তাঁরা অনুতপ্ত হয়েছেন এবং নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছেন। দোষ-ত্রুটিকে অবহেলার বিষয় মনে করেননি। আর এভাবেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁরা পরিশুদ্ধ হয়েছেন ও পরবর্তীদের জন্য উত্তম আদর্শে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের প্রতি এটা ছিল আল্লাহ তাআলার অতি বড় দান। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা তাঁদের সম্পর্কে বলেছেন-

وَ لٰكِنَّ اللهَ حَبَّبَ اِلَیْكُمُ الْاِیْمَانَ وَ زَیَّنَهٗ فِیْ قُلُوْبِكُمْ وَ كَرَّهَ اِلَیْكُمُ الْكُفْرَ وَ الْفُسُوْقَ وَ الْعِصْیَانَ،  اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الرّٰشِدُوْنَ، فَضْلًا مِّنَ اللهِ وَ نِعْمَةً،  وَ اللهُ عَلِیْمٌ حَكِیْم.

…কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তাকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। আর কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন । তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী; আল্লাহ্র দান ও অনুগ্রহস্বরূপ; আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ৭-৮

আল্লাহ তাআলার দয়া ও করুণায় সাহাবায়ে কেরাম উপরোক্ত মহান বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছেন। আল্লাহ তাআলাই তাঁদেরকে ঐ গুণাবলী দান করেছেন। তবে কীভাবে দান করেছেন, এর পিছনে তাঁদের নিজেদের আত্মনিবেদন ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা কেমন ছিল, তাঁদের মহান শিক্ষক আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাসন তরবিয়ত কেমন ছিল তার বর্ণনা আমরা পাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনেতিহাসে। উপরের ঘটনাটি সেই শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণেরই এক অনুপম দৃষ্টান্ত।

* * *

‘তুমি তাকে তার মায়ের কথা বলে লজ্জা দিয়েছ? তুমি তো এমন লোক যার মধ্যে (এখনও) কিছুটা জাহেলিয়াত রয়েছে?!’ প্রিয় সাহাবীকে এই শাসনের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

إِخْوَانُكُمْ…

‘তোমাদের ভাই তোমাদের সেবক। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। অতএব আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তা খাওয়ায়, যা সে নিজে খায়। তা পরায় যা সে নিজে পরে। আর তোমরা তাকে এমন কর্মের ভার দিও না, যা সে পালনে অক্ষম। যদি এমন ভার দিতে হয় তাহলে তাকে সহযোগিতা করো।’

সুবহানাল্লাহ! কী সহজ-সাবলীল মর্মস্পর্শী বক্তব্য। প্রতিটি বাক্য হৃদয় ও মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে।

‘তোমাদের ভাই তোমাদের সেবক। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন।’ সকল মানুষ আদম আ.-এর সন্তান। এদিক থেকে সকল মানুষ এক জাতি ও এক শ্রেণির। এরপর ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সূত্রে সকল মুসলিম ভাই-ভাই; কিন্তু মানুষের মাঝে ভাষা ও ভূমি, পেশা ও সম্পদের পার্থক্য আছে। আছে  কর্তা ও অধীনের পার্থক্য। মানবজাতির অভিন্নতা যেমন আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি তেমনি নানা ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যও তাঁরই সৃষ্টি। এই পার্থক্যের উপর নির্ভর করেই বিদ্যমান রয়েছে জীবনের গতি ও সচলতা। কুরআন মাজীদে কত পরিষ্কার ভাষায় ইরশাদ হয়েছে-

نَحْنُ قَسَمْنَا بَیْنَهُمْ مَّعِیْشَتَهُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ رَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجٰتٍ لِّیَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِیًّا.

…আমিই তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরজনের উপর মর্যাদায় উন্নত করেছি; যাতে তারা একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে…। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩২

এই পেশা ও সহায়-সম্পত্তিগত এবং  কর্তা-কর্মীর পর্যায়গত ভিন্নতা সত্ত্বেও সকল মানুষ এক জাতিভুক্ত, বিশেষত মুসলিমেরা

তো পরস্পর ভাই-ভাই। এ সত্য ভুলে যাওয়া যাবে না।

হাদীস শরীফের উপরোক্ত বাক্য মানব-হৃদয়ে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগ্রত করছে। তোমার অধীনজন যখন তোমারই মত মানুষ এবং তোমারই ভাই তাহলে তার কাছ থেকে সেবা নেয়ার সময়ও মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের দাবি পূরণ করে চলতে হবে। সেই দাবির কিছু নমুনা হাদীস শরীফের সামনের বাক্যগুলোতে বলা হয়েছে।

‘সে যেন তাকে তা খাওয়ায়, যা সে নিজে খায়; তা পরায় যা সে নিজে পরে।’

কী উদারতা ও মানবতার শিক্ষা! অন্তরে-বাহিরে ভ্রাতৃত্বের বহিঃপ্রকাশের কী অনুপম শিক্ষা!

তবে ইসলামের শিক্ষার সৌন্দর্য এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম যেমন উদারতা ও মানবতার উচ্চতম স্তরের শিক্ষা দান করেছে এবং ঐ স্তরে উন্নীত হতে উৎসাহিত করেছে তেমনি ন্যায়-নীতির সাধারণ স্তরেরও স্বীকৃতি ও শিক্ষাদান করেছে। হাদীস শরীফে ‘মামলূক’ বা ভৃত্যের ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে-

لِلْمَمْلُوكِ طَعَامُهُ وَكِسْوَتُهُ بِالْمَعْرُوفِ.

‘মামলূক রীতি-অনুযায়ী খাদ্য-বস্ত্রের হক্বদার হবে।’ -মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ২৮০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৬২

অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে যেমন খাদ্য-বস্ত্র তার প্রাপ্য তার কম হতে পারবে না। এটি তার সাধারণ প্রাপ্য। ন্যায়সঙ্গতভাবে এই প্রাপ্য আদায় করতে হবে। এটা যদি সাইয়েদের সাধারণ খাদ্য-বস্ত্রের চেয়ে নি¤œস্তরের হয় আর তিনি ইচ্ছে করেন তাকে এর চেয়ে উচ্চস্তরের খাদ্য-বস্ত্র প্রদান করবেন; এমনকি তিনি নিজে যে প্রকারের খাদ্য-বস্ত্র গ্রহণ করেন অনুরূপ খাদ্য-বস্ত্র তাকেও প্রদান করবেন, তাহলে তা অতি উত্তম কাজ। যার উদাহরণ হযরত আবু যর গিফারী রা. এবং আরো অনেক সাহাবীর জীবনে আমরা পাই। তাহলে দুটি পর্যায় হল : একটি প্রাপ্য আদায়ের স্তর। এটি ওয়াজিব বা অপরিহার্য পর্যায়ে কাম্যতার স্তর। আর দ্বিতীয়টি মহানুভবতার স্তর। এটি মুস্তাহাব বা ঐচ্ছিক পর্যায়ে কাম্যতার স্তর।

উল্লেখ্য যে, এটি হচ্ছে ‘মামলূক’ বা দাসের খাদ্য-বস্ত্রের ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশ। তাহলে ‘আজীর’ বা কর্মচারীর ক্ষেত্রে নির্দেশনা কী হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানেও পারিশ্রমিক ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারনের ক্ষেত্রে প্রাপ্যতা ও মহানুভবতা উভয় স্তরের বিবেচনা হতে পারে।

হাদীস শরীফের শিক্ষায় শুধু উদারতা ও মানবতার শিক্ষাই নয়, আছে মানবতা ও উদারতার বিভিন্ন স্তর বিন্যাসও, যেন সকল মানুষ নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে মানবতার কোনো না কোনো স্তরে উন্নীত হতে পারে এবং উন্নতির প্রত্যাশা করতে পারে।

 

* * *

‘আর তোমরা তাকে এমন ভার দিও না যা সে পালনে অক্ষম।’

অর্থাৎ যে কাজ চালিয়ে যেতে সে অক্ষম ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। হাদীস শরীফের নির্দেশনা হচ্ছে, কর্মীর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা অনুসারে কাজ নিতে হবে। অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপানো যাবে না। কোনো সময় বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিলে সহযোগিতা করতে হবে।

ইমাম মালিক রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, কেউ যদি তার মামলূকে দিনের বেলায় শষ্য কাটাইয়ে লাগিয়ে রাখে তাহলে রাতের বেলা তাদের দিয়ে মাড়াইয়ের কাজ করাবে না। হাঁ, দিনে পরিশ্রম করার পর রাতে হালকা কাজ দেয়া হলে, যা তাকে পরিশ্রান্ত করে না- দোষ নেই। -আলমুনতাকা, শরহুল মুয়াত্তা, হাদীস ২৮০৬, ২৮০৭-এর আলোচনায়।

আলমুনতাকা-গ্রন্থে আরো বর্ণিত আছে যে, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর রা. প্রতি শনিবার মদীনার ‘আওয়ালীতে যেতেন। ওখানে মামলূকেরা খেজুর বাগানে কাজ করত। ওখানে ওদের কারো উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ দেখলে তিনি তার কাজ কমিয়ে দিতেন। এমনভাবে যে, সে-ও পরিশ্রান্ত না হয়ে পড়ে, সাইয়েদেরও ক্ষতি না হয়।

ইমাম মালেক রাহ. বলেছেন, ‘ওদের কারো খোরপোষ কম থাকলে ওমর রা. তা বাড়িয়ে দিতেন।’

দেখুন, এ হচ্ছে দাস-সম্পর্কে ইসলামের নীতি ও প্রয়োগ। আজ যারা ওরিয়েন্টালিষ্টদের কিছু বাইপত্র পড়ে দাস-প্রথা নিয়ে ইসলামকে বিদ্ধ করতে চান তাদের অন্তত এইটুকু জানা থাকা উচিত যে, ইসলামী শরীয়ত দাস-প্রথার উদ্ভাবক নয়; সংস্কারক। ইসলাম এমনভাবে এর সংস্কার সাধন করেছে যে, মামলূকের প্রাপ্য অধিকারই শুধু রক্ষা পেয়েছে তা নয়, বরং সাইয়েদ ও মামলূকের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। না, শুধু শ্রুতিমধুর শব্দ-বাক্যের ঝংকারে নয়, জীবন ও কর্মের বাস্তব অনুশীলনে।

ইসলামের মানবতা, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির, সর্বোপরি খোদাভীতি ও আখিরাতমুখিতার শিক্ষার কারণে ঐ সময় মামলূকেরা যে অধিকার পেয়েছিলেন, জাগতিক ও পারলৌকিক উন্নতির যে উচ্চ সোপানে আরোহন করেছিলেন তা আজকের ‘সভ্য’ যুগের ‘স্বাধীন’ লোকদের নাগালেরও বাইরে। ক্ষেত্রবিশেষে চিন্তারও বাইরে।

কী, অতিরঞ্জন মনে হচ্ছে? তাহলে একটি প্রশ্নের জবাব দিন। আমাদের আজকের যুগের শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের স্বপ্নের দৌড় কতটুকু? তাদের কেউ কি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পদার্থ বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখে কিংবা ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির হওয়ার? কী আশ্চর্য প্রশ্ন, তাই না?

এযুগে যে প্রশ্নটি পর্যন্ত আশ্চর্যের ইসলামের সোনালী যুগে তার বাস্তব দৃষ্টান্তও আশ্চর্যের ছিল না। স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের একেবারেই অজানা। সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়নি তা-ও নয়, আরবী ভাষায় তো এ বিষয়ে প্রাচীন-আধুনিক অনেক গ্রন্থ আছে। বাংলা ভাষায়ও নেই তা নয়। কিন্তু কী দাওয়াই আছে আমাদের পাঠ-বিমুখতার? শুধু পাঠ-বিমুখতাই নয়, কারো কারো অল্প-স্বল্প পাঠাভ্যাস থাকলেও তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই তা অগোছালো ও দিকদর্শনহীন। অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে জানতে চান ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছে। ফলে শুধু অস্বচ্ছ  অবাস্তব ধারণাই  তৈরি হয় না, অর্থহীন দ্বিধা-সংশয়, অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধাও তৈরি হয় ও বাড়তে থাকে।

যাই হোক, ইসলামী শিক্ষার সাথে আজকের শিক্ষার তুলনা করতে হলে সংক্ষেপে এটুকু বলাও যথেষ্ট যে, ইসলাম দাস-প্রথার শুধু নামটি ছাড়া আর সবকিছু আমূল বদলে দিয়েছিল আর বর্তমান পশ্চিমা সংস্কৃতি সবকিছু বাকি রেখে শুধু নামটি বদলে দিয়েছে। এর এক প্রমাণ তো পাওয়া যাচ্ছে আমাদের আলোচ্য হাদীস থেকেই। কারণ আজকের বিশে^ যারা শ্রমজীবী মানুষ তারা মামলূক-শ্রেণিভুক্ত নয়, ইসলামী শরীয়তের পরিভাষা অনুসারেও ‘আহরার’ বা স্বাধীন শ্রেণিভুক্ত। এই শ্রেণির মানুষের সাথেও তাদের কর্তাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে তা মামলূকের সাথে সাইয়েদের আচরণ সংক্রান্ত হাদীস ও এ বিষয়ক অন্যান্য হাদীস থেকেই আহরণ করা সম্ভব। বরং বলুন, বিষয়টি আমলে নেয়া হলে আজকের ‘স্বাধীন’ লোকগুলোও জানে বেঁচে যাবে।

যাইহোক, উপরের হাদীস শরীফ থেকে আচরণগত যে মৌলিক শিক্ষা আমরা পাচ্ছি তা সংক্ষেপে :

সেবক, ভৃত্য, শ্রমিক বা মামলূককে কটূক্তি করা যাবে না।

বাবা-মার প্রসঙ্গ তুলে লজ্জা দেয়া যাবে না। তাদের সাথে সহজ ও অনুগ্রহপূর্ণ আচরণ করতে হবে।

তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

মনে রাখতে হবে যে, হাদীস শরীফে তাদেরকে ‘ভাই’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

সর্বাবস্থায় দ্বীনের শিক্ষা বিস্তারে প্রয়াসী থাকতে হবে এবং ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ অব্যাহত রাখতে হবে।

দেখুন, ফতহুল বারী, শরহু সহীহুল বুখারী, শরহুন নববী লি সহীহ মুসলিম।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

পূর্ববর্তি সংবাদপশ্চিম তীর থেকে আরো দুই শতাধিক ফিলিস্তিনিকে গৃহহীন করবে ইসরাইল
পরবর্তি সংবাদশেষ সময়ের হাট: গরু নিয়ে কাড়াকাড়ি, দামও বাড়তি