আবু নোমান।
বাবরের কথা এবং তার মহত্ত্বের কথা আমার যতটুকু মনে পড়ে ছোটবেলায় সর্বপ্রথম হিন্দু কবি কালিদাস রায়ের কবিতা থেকেই জানতে পারি। এখনকার অতিমাত্রার সেকুলার পাঠ্যে হয়তো সে কবিতা নেই। কিন্তু অনেকেই ছোটবেলায় কালি দাস রায়ের কবিতাটি পড়ে থাকবেন। একটু উদ্ধৃতি দেই।
চিতোরের এক তরুন যোদ্ধা রনবীর চৌহান
করিতেছে আজ বাবরের সন্ধান,
কুর্তার তলে কৃপান লুকায়ে ঘুরিছে সে পথে পথে
দেখা যদি তার পায় আজি কোনো মতে
লইবে তাহার প্রাণ,
শোণিতে তাহার ক্ষালিত করিবে চিতোরের অপমান।
দাঁড়ায়ে যুবক দিল্লির পথ-পাশে
লক্ষ করিছে জনতার মাঝে কেবা যায় কেবা আসে।
হেন কালে এক মত্ত হস্তী ছুটিল পথের পরে
পথ ছাড়ি সবে পলাইয়া গেল ডরে।
সকলেই গেল সরি
কেবল একটি শিশু রাজপথে রহিল ধুলায় পড়ি।
হাতির পায়ের চাপে
গেল গেল বলি হায় হায় করি পথিকেরাভয়ে কাঁপে।
কুড়াইয়া আন ওরে
সকলেই বলে অথচ কেহ না আগায় সাহস করে।
সহসা একটি বিদেশি পুরুষ ভিড় ঠেলে যায় ছুটে,
কর কী কর কী বলিয়া জনতা চিৎকার করি উঠে।
করি শুন্ডের ঘর্ষন দেহে সহি
পথের শিশুরে কুড়ায়ে বক্ষে বহি
ফিরিয়া আসিল বীর।
চারি পাশে তার জমিল লোকের ভিড়।
বলিয়া উঠিল এক জন আরে এ যে এক জন মেথরের ছেলে,
এহার জন্য বে-আকুফ তুমি তাজা প্রাণ দিতে গেলে?
খুদার দয়ায় পেয়েছ নিজের জান,
ফেলে দিয়ে ওরে এখন করগে স্লান।
শিশুর জননী ছেলে ফিরে পেয়ে বুকে
বক্ষে চাপিয়া চুমা দেয় তার মুখে।
বিদেশি পুরুষে রাজপুত বীর চিনিল এসে,
এ যে বাদশাহ স্বয়ং বাবর পর্যটকের বেশে।
ভাবিত লাগিল, হরিতে ইহারই প্রাণ
পথে পথে আমি করিতেছি সন্ধান?
বাবুরে পায়ে পড়ি সে তখন লুটে
কহিল সঁপিয়া গুপ্ত কৃপাণ বাবরের করপুটে।
অবশেষে যে ছোরা নিয়ে এসেছিল বাবরের মণ্ডপাত করতে, সে ছোরা নিয়েই সে হয়ে গেল বাবরের দেহরক্ষী। হিন্দু সমাজে এভাবে জায়গায় জায়গায় মুসলিম বাদশাহগণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন।
হ্যা, অযোধ্যার শহীদ হওয়া বাবরি মসজিদ যার নামে অনেক হিন্দু ঐতিহাসিক তার চারিত্রিক এসব গুণাবলি এড়িয়ে যেতে পারেননি।
বাবর সম্পর্কে হিন্দুদের মন্তব্য
মোঘলদের শেষ যুগের ঐতিহাসিক সোবহান রায় লিখেছেন, বাবর ইনসাফ ও ন্যায় পরায়ণতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু লিখেছেন, তিনি ছিলেন জাগরণ যুগের আদর্শ নেতা। তার চরিত্রে অভিযান প্রিয়তা, শিল্প সাহিত্যা অনুরাগ ও সৌখিন জীবনের আগ্রহ ছিল।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির ড. রাম প্রসাদ ত্রিপাঠি লেখেন, বাবর ধর্মান্ধ ছিলেন না। আমীর গরীব, হিন্দি আফগানী সবার সাথেই তার আচরণ ছিল ভদ্র শালীন ও বন্ধুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক শ্রীরাম শর্মা লিখেছেন, বাবর কোনো মন্দির ধ্বংস করেছেন কিংবা কোনো হিন্দুকে ধর্মীয় কারণে কষ্ট দিয়েছেন এমন কোনো প্রমাণ ইতিহাসে নাই।
ঐতিহাসিক রাম প্রসাদ খোশলা লিখেছেন, বাবরের রোযনামচায় কোনো মন্দির ধ্বংস করার কথা নেই।তার উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল।
বাবর তার ছেলেকে অসিয়ত করে লিখেছেন, গাভী কোরবানী থেকে বিরত থেকো। তাহলে ভারতবাসীর হৃদয় জয় করতে পারবে এবং তাদের আনুগত্য লাভ করবে। হুকুমতের আইন কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রজার মন্দির ও উপাসনালয় ধ্বংস করোনা । এমনভাবে ন্যায় বিচার করো যেন বাদশাহ প্রজাদের প্রতি আর প্রজা বাদশাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকে।
এই বাবর সম্পর্কে কি চিন্তাও করা যায়, তিনি মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ বানিয়েছেন?
বিধর্মীদের উপাসনালয় সম্পর্কে ইসলাম কী বলে
বিধর্মীদের উপাসনালয়ের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদারতা ছিল অতুলনীয়। সে যুগে বিজিত ভূখণ্ডের যেসব অধিবাসী বশ্যতা আনুগত্য করেছে তাদের জান-মাল, ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আল্লাহর আমানত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিম্মাদারি বলে গণ্য হতো।
সর্বাবস্থায় তারা পূর্ণ নিরাপত্তা ভোগ করত। তাঁর ফরমান এই ছিল যে, তাদের কোনো কিছুতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তাদের মূর্তি বিগ্রহ ভাঙ্গা যাবে না । এবং কোনো পূজারীকে অপসারণ করা যাবে না। কোনো সন্ন্যাসীকে তার অবস্থা থেকে এবং গির্জা মন্দিরের কোনো সেবায়েতকে তার পদ থেকে সরানো যাবে না । তাদের যা কিছু যেভাবে আছে সেভাবে থাকবে। কেউ ফরিয়াদি হলে তার প্রতি ন্যায় বিচার করা হবে।
এক্ষেত্রে সাহাবাগণ এবং পরবর্তী মুসলিম আদর্শ শাসকগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শকে পূর্ণ মাত্রায় ধরে রেখেছেন। ভারতের মুসলিম শাসনকালকেও যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, মুহাম্মদ বিন কাসিম থেকে বাহাদুর শাহ যফর পর্যন্ত এ নীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। কখনো যদি কারো দ্বারা এই নীতি লংঘিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত অপরাধ হিসাবে ধরতে হবে।
এই ভারতে যে সুদীর্ঘ কাল মুসলিম শাসকগণ শাসন করেছেন তারা যদি মন্দিরকে মসজিদ বানানোর পরিকল্পনা করতেন তাহলে হয়তো ভারতে না এত এত হিন্দুর অস্তিত্ব থাকত, না এত এত মন্দিরের অস্তিত্ব থাকত।