“বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ককে যারা সোর্স অফ ইনকাম বানায়, তারা আল্লাহর বিধানের অবজ্ঞাকারী”

আবু নোমান।।

‘যৌতুক না দেওয়ায় গৃহবধূর সারা শরীরে ব্লেডের পোঁচ’- গতকাল একটি অনলাইন দৈনিকে প্রকাশিত শিরোনামটি দেখে অনেকেই শিউরে উঠেছেন। যদিও আমাদের দেশে এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু প্রধান দেশে যৌতুকের জন্য এর চেয়ে নির্মম ঘটনাও ঘটে থাকে, তারপরও গতকাল সিলেটের মত একটি ধর্মপ্রাণ জনগণের এলাকায় এহেন ঘটনায় অনেকেই যারপরনাই ব্যথিত হয়েছেন।

সংবাদে বলা হয়েছে, হাসপাতালের বিছানায় আর্তচিৎকার দিয়ে কাতরাচ্ছেন এক নারী। সারা শরীরে ব্লেড দিয়ে কাটা অসংখ্য দাগ নিয়ে আর্তনাদ করে চলেছেন তিনি। সার্জারি বিভাগের চেষ্টায় শঙ্কামুক্ত হলেও কতদিনে শুকাবে এই দাগ জানে না কেউ। ‘প্রেম করে’ বিয়ে করা স্বামী শরীফ মিয়া যৌতুকের দাবিতে তার এমন হাল করার পর থেকেই পলাতক আছেন। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, প্রেম করে বিয়ে করায়  মেয়েদের জন্য ধর্মীয় ক্ষতি ছাড়াও দুনিয়াবী দিক থেকেও তারা প্রতারণা ও ক্ষতির শিকার  হতে পারেন এই ঘটনা তার আরেকটি প্রমাণ।

যৌতুক কি? কোথা থেকে আসল এই নিষ্ঠুর প্রথা?

সহজ কথায় যৌতুক হল, এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যধি, এবং বহু কবীরা গুনাহর সমষ্টি। ইসলামের ইতিহাসে যৌতুক বলে কিছু পাওয়া যায় না। জাহেলী যুগেও যৌতুকের প্রচলন ছিল না। আমাদের মুসলিম সমাজে যৌতুক এসেছে হিন্দু সমাজ থেকে।

ইসলামে  জাহিয বলে  কি যৌতুকের মত কিছু আছে

অনেকে জাহিয আর যৌতুকের পার্থক্যটা গুলিয়ে ফেলেন। ইসলামে যৌতুক বলতে কিছু নেই। জাহিয নামে যেটা আছে সেটা সুন্নত মোস্তহাব কোনো আমল নয়। মোবাহ বা বৈধ জিনিস। জাহায বা জাহীয হচ্ছে, কন্যাকে দেওয়া পিতার উপহার। এসম্পর্কে বিদগ্ধ আলেম মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক লেখেন, جهاز  আরবীতে একটি শব্দ আছে, جهاز যার উর্দু তরজমা করা হয় জাহীয। কেউ কেউ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই এই শব্দের তরজমা করেন যৌতুক। যা সঠিক নয়।

বিয়ের সময় বাবা তার মেয়েকে যা দেন স্বামী বা শ্বশুরালয়ের কেউ এর মালিক নয়, এর মালিক কন্যা নিজে। পিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কন্যাকে তা দিয়ে থাকে। এতে স্বামী ও শ্বশুরালয়ের দাবি ও চাপাচাপি তো দূরের কথা, কন্যার পক্ষ থেকেও কোনো দাবি থাকে না। এটা নামধামের জন্য দেওয়া হয় না। যৎসামান্য উপহার পিতা নিজের সামর্থ্য অনুসারে কন্যাকে দিয়ে থাকেন।

জাহিয কি সুন্নত বা মুস্তহাব কোনো আমল

জাহিয সুন্নত বা মোস্তহাব কোনো আমল নয়। এটা মোবাহ একটি বিষয়। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক লেখেন, এই উপহার বিয়ের সময় দেওয়া সুন্নত, মুস্তাহাব নয়; নিছক মোবাহ, যদি না কোনো সামাজিক চাপ কিংবা প্রথাগত বাধ্য-বাধকতা থাকে। অন্যথায় তা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হয়ে যায়।

বিয়ের সময়ের এই উপহারকে অনেকে সুন্নত মনে করেন যা একটি প্রচলিত ভুল। এই ভুলের খন্ডন করে এ বিদগ্ধ আলেম লেখেন, কেউ কেউ রোখসতির সময় কন্যাকে কিছু উপহার, কিছু ঘরকন্নার সামগ্রি দেওয়াকে মাসনূন মনে করেন। তারা বলে থাকেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কন্যা ফাতিমা রা.কে রোখসতির সময় কিছু জিনিস দিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমদ (হাদীস : ৬৪৩) ও সহীহ ইবনে হিববানে (হাদীস : ৬৯৪৭)

কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার, উসূলে ফিকহের বিধান মতে শুধু এইটুকু ঘটনার দ্বারা কোনো আমল মাসনূন প্রমাণিত হয় না, শুধু মোবাহ বা বৈধ প্রমাণিত হয়। ঐ কাজ মাসনূন হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে উৎসাহিত করতেন এবং তাঁর অন্য কন্যাদের বিয়েতেও এ ধরনের উপহার দিতেন। তেমনি উম্মুল মুমিনীনদেরকেও তাদের পিত্রালয় থেকে উপহার দেওয়া হত। কিন্তু কোনো রেওয়ায়েতে এমন কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। শুধু উম্মে হাবীবা রা. সম্পর্কে পাওয়া যায়, তাঁর জন্য হাবাশার বাদশা নাজাশী নিজের পক্ষ থেকে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩৩৫০; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/২৯৩)

ফাতেমা র. এর বিয়েয় জাহিয দেওয়ার ঘটনার আরেকটি উন্মোচিত করে এই আলেম লেখেন, ফাতেমা রা.-এর ঘটনার আরেকটি দিকও রয়েছে, যা বিবেচনা করা দরকার। তা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন হযরত আলী রা.-এরও অভিভাবক। সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে, ঐ জিনিসগুলো তিনি পাঠিয়েছিলেন আলী রা.-এর পক্ষ থেকে। কারণ বিয়ের সময় তাঁর ঘরে ঐ ধরনের কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মুসনাদে আহমদ (হাদীস : ৬০৩) সহ বিভিন্ন কিতাবে নির্ভরযোগ্য সনদে এই তথ্য রয়েছে। মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নুমানী রাহ. মাআরিফুল হাদীস (৩/৪৬০-৪৬১) এই ব্যাখ্যাই করেছেন।

 যৌতুক অনেক কবীরা গোনাহের সমষ্টি

যৌতুক একই সাথে অনেক কবীরা গোনাহের সমষ্টি। যৌতুকের ভেতর যেসব কবীরা গোনাহ পাওয়া যায়, এর একটি তালিকা দিয়ে এই আলেম লেখেন, যৌতুক মুশরিক-সমাজের রেওয়াজ।  তাই কোনো মুসলিম কোনো অবস্থাতেই কাফের ও মুশরিকদের রীতি-নীতি অনুসরণ করতে পারে না।

তাছাড়া যৌতুক একটা জুলুমের প্রথা। শুধু জুলুম নয়, অনেক বড় জুলুম। আর তা শুধু ব্যক্তির উপর নয়, গোটা পরিবার ও বংশের উপর জুলুম। যৌতুকের কারণে কনে ও তার অভিভাবকদের যে মানসিক পীড়ন ও যন্ত্রণার শিকার হতে হয় তা তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অথচ কাউকে সামান্যতম কষ্ট দেওয়া ও জুলুম করাও হারাম ও কবীরা গুনাহ।

তৃতীয়ত, নিঃসন্দেহে যৌতুক নেওয়া- আকল বিল বাতল-তথা পরস্ব হরণের অন্তর্ভুক্ত। তদুপরি এটা এক দিক থেকে ঘুষের মত। যোগ করেন এই আলেম।

‘বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। এটি ব্যবসা বা অর্থোপার্জনের উপায় নয়। তেমনি বর-কনেও ব্যবসার পণ্য নয়, যাদেরকে বিক্রি করে পয়সা কামানো হবে। যারা বিয়ের মতো পবিত্র কাজকে সোর্স অফ ইনকাম বানায় তারা আল্লাহর বিধানের অবজ্ঞাকারী। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা যে আকল বিল বাতিল কে হারাম করেছেন তার অর্থই হল, এমন কোনো পন্থায় সম্পদ উপার্জন, যাকে আল্লাহ উপার্জনের মাধ্যম বানাননি। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি হজ্বের মহিমান্বিত মাসের মহিমান্বিত দিবসে খানায়ে কাবার উপর হামলা করার মতো অপরাধ ‘

 

 

পূর্ববর্তি সংবাদমাজারে গরু জবাইয়ের মান্নত করা যাবে কি
পরবর্তি সংবাদকক্সবাজারে জলবায়ু উদ্বাস্তু ৬০০ পরিবারকে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর