দ্বীনদার পরিবারের সাথে আত্মীয়তা: প্রয়োজন প্রস্তুতি ও সংকল্প

মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব ।।

আমাদের সমাজের অনেকে নিজে দ্বীনদার না হলেও দ্বীনী পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে চান। ছেলের বাবা চান দ্বীনী পরিবার থেকে মেয়ে আনতে। মেয়ের বাবাও চান দ্বীনী পরিবারে মেয়েকে পাঠাতে।

এছাড়াও অনেক ছেলে তার মা বাবার অনিচ্ছা কিংবা মৌন সম্মতি নিয়েই দ্বীনী পরিবারে যুক্ত হতে চায়। অনেক মেয়েও তার ব্যক্তিগত আগ্রহেই চায় দ্বীনী পরিবারে প্রবেশ করতে। এসবই খুব ভালো চিন্তা এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এক্ষেত্রে বিভিন্নজনের উদ্দেশ্য থাকে বিভিন্ন রকম।

কেউ শুধুমাত্র এই চিন্তা থেকে দ্বীনদার মেয়ে আনতে চান যে, এই যামানায় অন্য মেয়েদের উপর আস্থা রাখা যায় না। আদব-আখলাক, স্বামীর আনুগত্য, শ্বশুর শাশুড়ির আনুগত্য, ব্যক্তি জীবনে নমনীয়তা, মানবিকতা, ভদ্রতা-শিষ্টতা ইত্যাদি গুণাবলী দ্বীনদার মেয়ের মাঝে বেশি পাওয়া যায়।

অনেকের চিন্তা থাকে, দ্বীনী পরিবারে আত্মীয়তা করলে তারা আমাদের ছেলেকে ঠিক করে দিবে। কারণ, ছেলেটা খারাপ সঙ্গ কিংবা অন্য কোনো কারণে ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে।

কেউ কেউ নিজের ঘরে দ্বীনী পরিবেশ তৈরি করা এবং নিজেদের দ্বীনী ও ঈমানী উন্নতি অর্জন করার বিষয়টিই লক্ষ্য হিসাবে চিন্তা করেন। দ্বীনী পরিবারের সহযোগিতায় নিজেরা অগ্রসর হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

এমন আরও অনেক ভালো মন্দ এবং উচিত অনুচিত লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকে।

কিন্তু সত্যকথা হলো, দ্বীনী পরিবার থেকে উপকৃত হওয়ার যে প্রস্তুতি ও যোগ্যতা প্রয়োজন তা সবার থাকে না। ফলে একসময় উভয় পরিবারের মাঝে নানা রকমের পেরেশানী দেখা দেয়। বিভিন্ন ধরনের সংকট ও তিক্ততা তৈরি হয়। তখন একে অপর থেকে উপকৃত হওয়ার বদলে ক্ষতিগ্রস্তই হয় বেশি। যার পরিণতি বড় বেদনাদায়ক।

আমার চোখে দেখা দুটি পরিবার। তাদের ছেলে জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু বিয়ে করেছে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ে। তন্মধ্যে এক পরিবারের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যতটুকু জানি, তাদের ছেলে ওই মেয়েকে পছন্দ করত। এতটুকুই। এই বিয়েতে আমি মনে মনে খুশি ছিলাম একথা ভেবে যে, মাশাআল্লাহ! তারাও এবার হয়ত দ্বীনাদারীতে এগিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হয়ে গেল ভিন্ন। মহিলা মাদরাসায় কুরআন হাদীস পড়া ওই মেয়ে না পারল নিজের দ্বীনদারী রক্ষা করতে, না পারল ওই পরিবারকে দ্বীনদার বানাতে। এমনকি প্রথমেই তাকে পর্দার বিধানে শিথিল হতে হলো। এরপর আরও যা হলো তার বিবরণ আরও কঠিন।

আরেক পরিবারের অবস্থা হলো, দ্বীনদার বউ তার সন্তানদেরকে সহশিক্ষার স্কুলে পড়াতে রাজি হয়ে গেল। এরপর এক সন্তানের মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ হতে না হতেই পরিবেশের ‘স্বাভাবিক’ প্রভাব দেখে মা বাবা দুজনই ভেঙ্গে পড়ল। তখন তাদের করুণ কান্না দেখে আমাদের চোখ থেকেও অশ্রু ঝরল।

আমি বলছি না, অ-দ্বীনী পরিবারের জন্য দ্বীনী পরিবারে আত্মীয়তার স্বপ্ন দেখা অনুচিত। বরং একথা তো স্পষ্ট এবং স্বীকৃত যে, দ্বীনী পরিবারের সহায়তায় যতটা দ্বীনদারী অর্জন করা যায় অন্য কোনোভাবে তা অর্জন করা সহজ নয়। দ্বীনী পরিবারের বাচ্চারাও যে চিন্তা চেতনায় গড়ে উঠে, অন্য পরিবারের বড়দের পক্ষেও তা অর্জন করা মেহনত সাপেক্ষ হয়। অতএব দ্বীনী পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া নিশ্চিত আনন্দের এবং সৌভাগ্যের। তবে তার আগে দ্বীনী পরিবার থেকে উপকৃত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা অপরিহার্য। দ্বীনী পরিবারে যুক্ত হওয়ার নিয়তকে বিশুদ্ধ ও উন্নত করা অবশ্য কর্তব্য।

পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রায়ই ইসলামী শরীয়তের নীতি বিধান দেখে শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ি। কী নিপুণ নিখুঁত নীতি ব্যবস্থাপনা। ছোট থেকে ছোট এবং বড় থেকে বড় বিষয়ে কী আশ্চর্য চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি। এসব বিষয় যে পরিবার যত বেশি মেনে চলে সে পরিবারে তত বেশি সুখ ও সাফল্য বিরাজ করে।

বিয়ের ক্ষেত্রে শরীয়ত ‘কুফু’ (বর কনে উভয়ের সমজাত, সমশ্রেণিতা ও দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে সমতা) এর বিধান রেখেছে। আবশ্যক করেনি, তবে অনেক গুরুত্বের সাথে উৎসাহ দিয়েছে। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

تَخَيَّرُوا لِنُطَفِكُمْ، فَانْكِحُوا الْأَكْفَاءَ، وَأَنْكِحُوا إِلَيْهِمْ

তোমরা তোমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে উত্তম নারীদের গ্রহণ কর। সমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে বিয়ে কর। বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এ বিষয়ে খেয়াল রাখ।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৯৬৭; মুসতাদরাকে আহমদ, হাদীস : ২৬৮৭

কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

أَفَمَنْ كَانَ مُؤْمِنًا كَمَنْ كَانَ فَاسِقًا لَا يَسْتَوُون

আচ্ছা, যে ব্যক্তি মুমিন, সে কি ওই ব্যক্তির মতো হতে পারে, যে ফাসেক? না, তারা উভয়ে সমান হতে পারে না।-সূরা সাজদা, আয়াত : ১৮

অন্যত্র বলেছেন,

الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ

অপবিত্র নারীগণ অপবিত্র পুরুষদের উপযুক্ত এবং অপবিত্র পুরুষগণ অপবিত্র নারীদের উপযুক্ত। পবিত্র নারীগণ পবিত্র পুরুষদের উপযুক্ত এবং পবিত্র পুরুষগণ পবিত্র নারীদের উপযুক্ত।-সূরা নূর, আয়াত : ২৬

এসব আয়াত ও হাদীস থেকে গ্রহণ করার বিষয় তো অনেক।

নিজেদের হিসাব নেওয়া এবং নিজেদের অবস্থান ও সেখান থেকে উন্নতির বিষয়ে ফিকির করার সবক নেওয়া উচিত। কেবল শখ পছন্দ আর যেনতেন টার্গেট নিয়ে কোনো দ্বীনী পরিবারকে বিপর্যস্ত করা উচিত নয়। ভালো পরিবারের সাথে আত্মীয়তার জন্য নিজেদের ভালো হবার মজবুত সংকল্প করা এবং সেই মানসিকতা নিয়ে দৃঢ়ভাবে পথ চলা উচিত। কমপক্ষে ভালোকে তার ভালোত্ব থেকে নিচে নামানোর মাধ্যম না হওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

পূর্ববর্তি সংবাদল্যাবএইড নারায়ণগঞ্জ শাখার বিরুদ্ধে করোনা রোগীর সাথে প্রতারণার অভিযোগ
পরবর্তি সংবাদযুক্তরাষ্ট্রে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প