‘ইনশাআল্লাহ, আমরা যোহরের নামায সেন্ট সুফিয়ায় গিয়ে আদায় করব’

ইবনে নসীব।।

আজও তুরষ্কের অনেক পিতামাতা আদরের সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ ফাতিহ’ রেখে থাকেন। কেননা এ নামটি ইসলামী ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। খিলাফতে উছমানিয়ার সপ্তম খলীফা সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. ছিলেন একজন মুজাহিদ সুলতান, যাঁর মাধ্যমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কুস্ত্তনতীনিয়া জয় করেন।

১৬ মুহররম ৮৫৫ হিজরী মোতাবেক ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪৫ খৃষ্টাব্দে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. খিলাফতে উছমানিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ বছর, কিন্তু অসম সাহস, অতুলনীয় প্রজ্ঞা, নিপুণ রণকৌশল ও গভীর ঈমানী জযবায় অল্প সময়েই তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

দীর্ঘ ত্রিশ বছর তিনি খিলাফত পরিচালনা করেছেন। তাঁর শাসনামলে যেমন ইসলামের বিজয়াভিযানে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল তেমনি সকল শ্রেণী ও ধর্মের মানুষ ন্যায়বিচার, জানমালের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় ও মানবিক অধিকার লাভ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ইসলামী শাসনব্যবস্থার সুফল।

সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রা.-এর শাসনামল বিভিন্ন দিক থেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তবে যা তাঁকে উম্মাহর হৃদয়ে অমর করে রেখেছে তা হচ্ছে কুস্ত্তনতীনিয়া বিজয়।

ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে কুস্ত্তনতীনিয়া ছিল পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। খৃষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই তা ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নগরী।

কুস্ত্তনতীনিয়া নগরীর তিন দিকে জল একদিকে স্থল। পশ্চিমে বসফরাস প্রণালী, দক্ষিণে গোল্ডেন হর্ণ ও উত্তরে মারমারা উপসাগর। তাই ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে একে তৎকালীন বিশ্বের সুরক্ষিত নগরীগুলোর মধ্যে গণ্য করা হত। এছাড়া নগরীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। গোটা নগরীর চারপাশে ছিল একাধিক দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও সার্বক্ষণিক সশস্ত্র প্রহরা। এসব কারণে কুস্ত্তনতীনিয়া ছিল সে সময়ের বিচারে এক অজেয় দুর্গ।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, সে যুগটা মিসাইল ও যুদ্ধবিমানের যুগ ছিল না। তাই উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলোই তখন নগরীর সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট ছিল।

কুস্ত্তনতীনিয়া জয়ের জন্য সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক রণপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ের সবচেয়ে দূর পাল্লার কামান তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন। প্রস্ত্ততি সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি অভিযান আরম্ভ করেন। তার স্থলবাহিনী নগরীর পূর্ব দিকে অবস্থান নিলে এবং নৌবাহিনীর জাহাজগুলো বসফরাস প্রণালীতে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বসফরাস প্রণালী থেকে  ‘গোল্ডেন হর্ণে’ প্রবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। কেননা গোল্ডেন হর্ণের মুখ লোহার শিকল দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং বাইজেন্টাইন রণতরীগুলো সেখানে অবস্থান নিয়ে গোলা নিক্ষেপ করছিল।

প্রচন্ড যুদ্ধের পরও উছমানী নৌবহর গোল্ডেন হর্ণ পদানত করতে সক্ষম হল না। অন্যদিকে বন্দর সুরক্ষিত থাকায় বাইজেন্টাইন বাহিনী তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল পূর্ব দিকে, সুলতানের স্থল বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য। তাই তাদের শক্তিকে বিভক্ত করার জন্য এবং দুই দিক থেকে একযোগে আক্রমণ পরিচালনার জন্য উছমানী নৌবহরের গোল্ডেন হর্ণে প্রবেশ করা ছিল অপরিহার্য।  প্রায় দুই সপ্তাহ অবিরাম যুদ্ধের পরও নৌপথে বিজয়ের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এই সময়ই সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রা. তাঁর সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলেন, যার কোনো দৃষ্টান্ত সমকালীন যুদ্ধের ইতিহাসে ছিল না। ইংরেজ ঐতিহাসিক গীবন একে ‘মিরাক্ল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. মুজাহিদদের আদেশ দিলেন রণতরীগুলো ডাঙ্গায় তুলে দশ মাইল পথ অতিক্রম করে গোল্ডেন হর্ণে নামাতে হবে। এই দীর্ঘ পথ পুরোটাই ছিল পাহাড়ী উঁচুনিচু ভূমি। এর উপর দিয়ে রণতরীগুলো টেনে নিয়ে যাওয়া ছিল এককথায় অসম্ভব। কিন্তু সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। পুরো পথে কাঠের পাঠাতন বিছানো হল, তাতে চর্বি মাখিয়ে পিচ্ছিল করা হল এবং এর উপর দিয়ে রণতরীগুলো টেনে নিয়ে যাওয়া হল। এভাবে টিলা ও পাহাড়ের উপর  দিয়ে এক রাতের মধ্যে পঞ্চাশটি রণতরী তিনি গোল্ডেন হর্ণে প্রবেশ করাতে সক্ষম হলেন।

সকালে গোল্ডেন হর্ণের মুখে প্রহরারত বাইজেন্টাইন নৌ সেনারা বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে দেখল যে, উছমানী রণতরীগুলো মৃত্যুদূতের মতো তাদের পিছন দিক থেকে ধেয়ে আসছে। এই ঘটনা থেকে একটি প্রবাদ তৈরি হল, যার তরজমা : ‘যখন পানির জাহাজ ডাঙ্গায় চলবে তখন বুঝবে কুস্ত্তনতীনিয়ার পতন অত্যাসন্ন!’

চূড়ান্ত আক্রমণের আগে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. বাইজেন্টাইন সম্রাট কুস্ত্তনতীনকে নগরী সমর্পণের পয়গাম পাঠালেন এবং নগরবাসীর জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেন,  কিন্তু সম্রা্ট তা গ্রহণ করলেন না। সুলতান চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্ত্ততি নিলেন।

ঐতিহাসিক লেখেন, আক্রমণের আগে ‘সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. বাহিনীর অধিনায়কদের তলব করে সকল মুজাহিদকে এই পয়গাম পৌঁছে দেওয়ার আদেশ করলেন যে, কুস্ত্তনতীনিয়ার বিজয় সম্পন্ন হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে এবং তাঁর একটি মু’জিযা প্রকাশিত হবে। অতএব কারো মাধ্যমে যেন শরীয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘিত না হয়। গীর্জা ও উপাসনালয়গুলোর যেন অসম্মান না করা হয়, পাদ্রী, মহিলা, শিশু এবং অক্ষম লোকদের যেন কোনো ধরনের কষ্ট না দেওয়া হয় …।’

৮৫৭ হিজরীর ২০ জুমাদাল উলার রজনী মুজাহিদগণ দুআ ও ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করলেন। ফজরের পর সুলতান চূড়ান্ত আক্রমণের আদেশ দিলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, ‘ইনশাআল্লাহ আমরা যোহরের নামায সেন্ট সুফিয়ার গীর্জায় আদায় করব।’

আল্লাহ তাআলা তাঁর মুজাহিদ বান্দার কথাকে সত্য করেছেন। জোহরের সময় সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহ রাহ. বিজয়ীর বেশে কুস্ত্তনতীনিয়া নগরীতে প্রবেশ করলেন। ইংরেজি তারিখ হিসাবে দিনটি ছিল ২৯ মে ১৪৫৩ ঈ.। সেন্ট রোমান্সের উপর (বর্তমান নাম ঞঙচ কঙচণ) উছমানী পতাকা উড়ছিল। সুলতান ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সিজদায় পড়ে গেলেন।নগরীর অধিকাংশ খৃষ্টান সেন্ট সোফিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। সুলতান তাদেরকে অভয় দিলেন এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা দান করলেন।

এরপর আযান দেওয়া হল। সাড়ে এগারো শত বছর যাবৎ যেখানে ‘তিন খোদা’র উপাসনা হচ্ছিল সেখানে আজ তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারিত হল। সকল ছবি ও মূর্তি সরিয়ে ফেলা হল। মুসলিম বাহিনী জোহরের নামায সেন্ট সোফিয়ায় আদায় করল।

সুলতান ফাতিহ রাহ. একে মসজিদে পরিণত করার ফরমান জারি করলেন। কেননা, প্রথমত কুস্ত্তনতীনিয়ার সম্রাট আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল তাই সুলতান এই গীর্জাকে পূর্বাবস্থায় বহাল রাখতে বাধ্য ছিলেন না। তদুপরি এটি ছিল অর্থডোকস খ্রিষ্টানদের কেন্দ্রীয় গীর্জা। তাই এর সঙ্গে বহু কুসংস্কার ও অলৌকিকতার বিশ্বাস জড়িত হয়ে গিয়েছিল। এই কুসংস্কারের মূলোৎপাটন প্রয়োজন ছিল।

কুস্ত্তনতীনিয়া বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. নগরীর খৃষ্টান অধিবাসীদের জান-মালের পূর্ণ  নিরাপত্তা বিধান করেন এবং তাদেরকে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন।

কুস্ত্তনতীনিয়া বর্তমানে ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত এবং বর্তমান তুরষ্কের অন্তর্গত।

পূর্ববর্তি সংবাদসাহেদের লুটপাটের হাত বিস্তৃত ছিল সরকারের আরো বিভিন্ন দপ্তরে
পরবর্তি সংবাদভারতে করোনায় মৃত ২৫০ অমুসলিমের সৎকার করল মুসলিমরা