নামাযের জন্য কবে উন্মুক্ত করা হবে আয়া সোফিয়া? আর কত প্রতীক্ষা!

তারিক মুজিব ।।

তুরস্কে সম্প্রতি আবারও জোড় দাবি উঠেছে ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়া মুসল্লিদের নামায আদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে। এতদিন নানামুখী রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকলেও এবার দেশটির বিরোধী দলগুলো থেকেও আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদ হিসেবে রূপান্তরের দাবি জানানো হয়েছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে একটি প্যান্ডিং মামলার দোহাই দিয়ে তুরস্কের তুলনামূলক ‘ইসলামি ভাবাপন্ন’ সরকারি দল একে পার্টি এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে এবারও হয়ত অপূর্ণই থেকে যাবে তুরস্কবাসীর আয়া সোফিয়াতে নামায আদায়ের বাসনা।

তবে গ্রিস সরকারকে উদ্দেশ করে দেওয়া তুরস্ক প্রেসিডেন্ট এরদোগানের একটি হুঁশিয়ারিমূলক বক্তব্য থেকে মানুষ এখনও আশান্বিত, আইনি জটিলতা উৎরে খুব দ্রুতই হয়ত আয়া সোফিয়া জাদুঘর থেকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরিত হবে।

এর আগে ২০১৮ সালেও তুরস্কে নামায আদায়ের জন্য আয়া সোফিয়াকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে জোড় দাবি উঠেছিল। তখন প্রেসিডেন্ট এরদোগান আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, আয়া সোফিয়াকে আইনিভাবে মসজিদে রূপান্তিরত করা হবে।

আয়া সোফিয়ার অবস্থান তুরস্কে হলেও এর সাথে বিশ্বমুসলিমের আবেগ ও ভালবাসা জড়িত। কারণ স্থাপনাটি উসমানি সালতানাতের কেন্দ্রভূমি কনস্টান্টিনোপল তথা ইসতাম্বুলে অবস্থিত। যে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সু সংবাদ স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম দিয়েছিলেন। আর আয়া সোফিয়ার দখল ছাড়া কনস্টান্টিনোপল বিজয় অসম্ভব ছিল। তাই স্বাভাবিক কারণে মুসলমানরা এই আয়া সোফিয়ার প্রতি বাড়তি আবেগ ও ভালবাসা লালন করে। এবং তাদের ঐকান্তিক কামনা হলো, দ্রুতই আয়া সোফিয়াকে মুসল্লিদের সিজদা প্রদানের জন্য খুলে দেওয়া হোক।

এর আগে দুই হাজার পনের সালে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার দীর্ঘ পঁচাশি বছর পর প্রথমবারের মতো আয়া সোফিয়াতে কুরআনের তিলাওয়াত করা হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর রমযানে আয়া সোফিয়াতে কুরআন তিলাওয়াতের আয়োজন করা হয়। তুরস্কের বর্তমান হাফেজ প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানও ২০১৮ সালে আয়া সোফিয়াতে এক প্রোগ্রামে কুরআন তিলাওয়াত করেন।

তবে খেলাফত পরবর্তী স্যাকুলার তুরস্কে এ কাজটি অতি সহজে সম্পন্ন হয়নি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ত্যাগ ও কুরবানীর ইতিহাস। সে ইতিহাসের মূল নায়ক তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশের প্রধান প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান।

সত্তরের দশকে এরবাকান তুরস্কে উপপ্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি তুরস্কের জনগণের সামনে উসমানী সালতানাতের হারানো ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরেন। জনগণকে ধর্মীয় চেতনায় জাগ্রত করে তোলেন। বিভিন্ন সমাবেশে আমরা ‘সুলতান ফাতিহের উত্তরসূরী’ এধরণের স্লোগান তৈরী করেন। আয়া সোফিয়ার সামনে তিনি তদানীং দলীয় ছাত্রসংগঠনকে দিয়ে ‘ফাতিহ’ নামাযের আয়োজন করেন। এভাবে পুরো তুরস্কের জনগণের মধ্যে আবারও মসজিদে আয়া সোফিয়ার প্রতি জযবা বাড়তে থাকে। সেই থেকে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার জোর দাবী উঠে। ৭০ এর দশকের যুবকেরাই ৯০ এর দশকে এসে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্টিত। আয়া সোফিয়ার প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়তে থাকে।

তবে রাজনৈতিক নানা সঙ্কটের কারণে তুরস্কে সহসাই আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরিত করা সম্ভব ছিল না। সংসদে আইন পাশ করার জটিলতা ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। তবে বর্তমানে তুরস্কের কয়েকটি বিরোধী দল থেকেও আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করার দাবি উঠানোর ঘটনায় বিশ্বমুসলিম আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।

আয়া সোফিয়া একসময় গ্রীক অর্থোডক্স গীর্জা থাকলেও এর বর্তমান যে দৃষ্টিনন্দন কাঠামো তা উসমানী খলিফাদের আমলেই নির্মিত। মুসলমানরা যখন ইসতাম্বুল বিজয় করে আয়া সোফিয়ার কাঠামোগত অবস্থা তখন খুবই নড়েবড়ে। এমনকি এর দরজাগুলিও ভেঙে নীচে পড়েছিল। ইসতাম্বুল বিজেতা সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এটির মেরামতের নির্দেশ দেন এবং স্থাপনাটিতে চারটি মিনার সংযুক্ত করেন। অবশ্য আয়া সোফিয়া স্থাপনার দেয়াল এবং এর চিত্রকর্ম অক্ষত অবস্থায়ই ছিল। নামায আদায়ের এর চিত্রকর্মগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে সুলতান সালিমের শাসনামলে আয়া সোফিয়া মসজিদের বহিরাবরণকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই কাজের দায়িত্ব পান তৎকালীন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিখ্যাত স্থাপত্যশিল্পী ‘মিমার সিনান’। ইতিহাসে সিনান ছিলেন প্রথম স্থাপত্যশিল্পী যিনি তার নির্মিত স্থাপনাগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষম করে তৈরি করেছিলেন। আয়া সোফিয়া মসজিদকেও একই বৈশিষ্ট্য দেয়ার পর তিনি মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বে আরো দু’টি মিনার সংযোজন করেন।

আয়া সোফিয়া মসজিদের আয়তন প্রায় ছয় হাজার বর্গমিটার। চারটি বিশাল স্তম্ভের উপর মসজিদের মূল গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া, মসজিদে রয়েছে মোট ১০৭টি স্তম্ভ ও নয়টি দরজা। মূল গম্বুজের নীচ দিয়ে মসজিদের ভেতরে সূর্যের আলো পৌঁছানোর জন্য স্থাপন করা হয়েছে ৪০টি জানালা। এসব জানালা দিয়ে মসজিদের সোনালী মোজাইকের উপর যখন সূর্যের আলো নিক্ষিপ্ত হয় তখন চমৎকার এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও দৃশ্যের অবতারণা হয় যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।

তথ্যসূত্র: টিআরটি, হুররিয়্যাত, উইকিপিডিয়া।

পূর্ববর্তি সংবাদস্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, ভারতে ‘মন্দির উৎসবে’ হাজারো ভক্তের ভিড়
পরবর্তি সংবাদপাকিস্তানে করোনায় ব্যাপক ত্রাণ বিতরণ করা আফ্রিদির কোভিড-১৯ শনাক্ত