করোনাকালে বেহাল স্বাস্থ্যখাত ও বড়লোকের হাহাকার!

জহির উদ্দিন বাবর।।

সারা বিশ্বের মতো আমাদের প্রিয় দেশটিও আজ কোভিড-১৯ নামক মহামারিতে বিপর্যস্ত। বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাসটি চরম পর্যায়ে পৌঁছার পর অনেকটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত এটা কোন পর্যায়ে গিয়ে থামে সেটা কেউ জানে না। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে এখনও হয়ত আমরা অনেক উন্নত দেশ থেকে ভালো আছি-এমনটা দায়িত্বশীল কেউ কেউ বলে তৃপ্তির ঢেঁকুরও তোলেন। কিন্তু আমাদের আশঙ্কার যে জায়গাটি সেটি হলো, যে হারে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে, ওইসব দেশের পর্যায়ে পৌঁছলে ধুঁকে ধুঁকে মরা ছাড়া হয়ত আর কোনো উপায় থাকবে না। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যখাত যে কতটা ভঙ্গুর ও ফাঁপা সেটা হয়ত করোনা না এলে বোঝা যেতো না। যখন প্রতিদিন হাজার-তিনেক আক্রান্ত আর ৩০/৪০ জন মৃত্যু হচ্ছে তখনই চারদিকে হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। কোথাও চিকিৎসা পাচ্ছে না কেউ। পরীক্ষা করাতে গিয়ে পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি। শুধু করোনা নয়, কোনো রোগের চিকিৎসাই মিলছে না এই মুহূর্তে। আল্লাহ না করুক, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যদি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো বাড়তে থাকে তাহলে হয়ত এ জাতিকে চরম মাশুল দেয়া লাগতে পারে।

করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় উপায় হলো টেস্টের পরিমাণ বাড়ানো। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারলে সহজেই তাদের থেকে বাকিদের রক্ষা করা যায় এবং আক্রান্তদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এজন্য বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ টেস্টের দিকে জোর দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে শুরু থেকেই টেস্টের ব্যাপারে কী কারণে যেন কর্তৃপক্ষের অনীহা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট নিয়ে কর্তৃপক্ষের আচরণেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। শুরু থেকে বিশেষজ্ঞরা টেস্টের পরিমাণ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছেন। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ কম টেস্ট করিয়ে কম আক্রান্ত দেখানোর দিকেই মনোযোগী ছিল সবসময়। এখন প্রতিদিন ১৩/১৪ হাজার টেস্ট হচ্ছে। এটা ২০/৩০ হাজার হলে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়াতো। যদিও ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে শুধু ঢাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা সাত লাখের বেশি।

করোনায় আক্রান্ত হলেই সবার প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। প্রায় ৮০ ভাগ রোগী নিয়মমতো হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকলেই ভালো হয়ে যান। ২০ ভাগের চিকিৎসা প্রয়োজন। এই ২০ ভাগও ন্যূনতম চিকিৎসাসুবিধা পাচ্ছে না। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় সরকার যেসব হাসপাতাল নির্ধারণ করেছে সেগুলোতেও মিলছে না চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আন্তরিক, কিন্তু জনবল সংকট, উপকরণের অভাব, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি সর্বোপরি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার নানা অভিযোগ আমরা গণমাধ্যম সূত্রে প্রতিদিনই পাচ্ছি।

করোনা আক্রান্ত রোগীদের জটিল অবস্থা তখনই সৃষ্টি হয় যখন তাদের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। সে সময় তাদের আইসিইউ সাপোর্ট বা ভেন্টিলেশন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমাদের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। দেশে প্রতি ১১৫৯ জন ব্যক্তির জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা রয়েছে। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১১৬৯টি। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে কত লাখ রোগীর জন্য একটি আইসিইউ ভাবা যায়! রোগীর চাপের কারণে স্বাভাবিক সময়েই আইসিইউ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। আর এখন যখন চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে তখন আইসিইউ পাওয়া তো সোনার হরিণ হবে এটাই স্বাভাবিক।

এই করোনা ধনী-গরিব কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। গরিবরা আক্রান্ত হচ্ছে, নীরবে ধুঁকছে, অনেকের হয়ত হাসপাতালে যাওয়ার মতো সামর্থ্যও নেই। কিন্তু এই করোনাকালে বড়লোকের হাহাকার আমাদেরকে প্রচণ্ডভাবে স্পর্শ করেছে। যারা সামান্য জ্বর-সর্দি হলে কিংবা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ছুটে যেতেন সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড কিংবা উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে। তারা এখন করোনার মতো জীবনহরণকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও দেশের বাইরে যেতে পারছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা দেশীয় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতদিন স্বাস্থ্যখাতের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে যারা তেমন ভ্রুক্ষেপ করতেন না কিংবা এর গুরুত্ব বুঝতেন না তারা আজ এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি। যেখানে কৃত্রিম অক্সিজেনের সংকট চরমে সেখানে একসঙ্গে এতগুলো বড়লোক আক্রান্ত হলে চিকিৎসাসুবিধা না পাওয়ারই কথা।

দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপতি মোনেম গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মোনেম, এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদ আলমসহ বেশ কয়েকজন শিল্পপতি ও বিশিষ্টজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে হয়ত তারা চিকিৎসার জন্য ছুটে যেতেন সিঙ্গাপুর্, থাইল্যান্ডে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে দেশে ‘গরিবের’ হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাদের। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বর্তমান মন্ত্রিসভার একজন সদস্য, সিলেটের সাবেক মেয়র, বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ অনেক বিশিষ্টজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। সাধারণত তারা কখনও দেশে চিকিৎসা নেন না। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সামর্থ্যবান সবাই একটু রোগ হলেই ছুটে যান বিদেশে। ফলে দেশের স্বাস্থ্যখাতের যে এই ভয়াবহ চিত্র সেটা হয়ত তারা এতোটা টের পেতেন না। আর টের পেলেও এটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ, তারা মনে করতেন আমাদের জন্য তো বিদেশের হাসপাতালগুলো আছেই! গরিবদের জন্য এর চেয়ে উন্নত ব্যবস্থার আর কী দরকার!

আরো পড়ুন: ‘লকডাউনকালে ইসলামী অনুশাসন পালনে পরিবারে বয়ে যেতে পারে শান্তির সুবাতাস’

স্বাস্থ্যখাতের যে ভঙ্গুর দশা সেটার প্রমাণ দিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সম্প্রতি তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। বাসায় আইসোলেশনে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে ভর্তি হন ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। অথচ তার অধীনে থাকা ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলসহ বড় কোনো হাসপাতালের ওপর তিনি আস্থা রাখতে পারলেন না। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে নির্ভর করার মতো চিকিৎসা হয় না পরোক্ষভাবে তিনি সেটা প্রমাণ করলেন। সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলার কারণে সিএমএইচে বাইরের যেকোনো হাসপাতালের তুলনায় ভালো চিকিৎসা মিলবে এটা মনে করেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও। এজন্য সরকারি দলের বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য ছুটে গেছেন সিএমএইচে। সামরিক বাহিনী দেশেই আস্থা রাখার মতো চিকিৎসাসেবা দিতে পারলে সাধারণ হাসপাতালগুলো সেটা কেন দিতে পারছে না এটা কি একবার ভেবে দেখেছেন কর্তাব্যক্তিরা!

স্বাস্থ্যখাতের এই বেহাল দশা কেন? গত এক যুগের বেশি সময় ধরে একই সরকার ক্ষমতায়। নানা খাতের উন্নয়নের গল্প শুনে আসছি আমরা। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যখাতও। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে তো সেই উন্নয়নের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত সরকার স্বাস্থ্যখাতকে তেমন গুরুত্বই দেয়নি। ২০১১-২০১৯ সাল পর্যন্ত বাজেটে গড়ে শতকরা ৪.৫৮ ভাগ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে। এই তথ্যই প্রমাণ করে আমাদের স্বাস্থ্যখাত কতটা অবহেলিত। অথচ অনেক অনুন্নত দেশেও ১৫ ভাগের কম বরাদ্দ থাকে না। তাছাড়া বরাদ্দ যাই হোক সেটাতে লুটপাট না হলে হয়ত পরিস্থিতি আরেকটু ভালো থাকতো। কিন্তু দেশে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি স্বাস্থ্যখাত। বছরখানেক আগে হাসপাতালের পর্দা কেনার নামে কী পুকুরচুরি হয়েছিল সেটা সবার জানা। এমনকি এই করোনাকালেও জরুরি সুরক্ষা সামগ্রী কেনায় দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে গণমাধ্যমে।

আরো পড়ুন: মুমূর্ষু রোগীরা পাচ্ছেন না আইসিইউ সেবা: ড. খালিদের আক্ষেপ ও আহ্বান

স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুর এই দশার কারণে যে বড়লোকেরা আজ ধুঁকছেন তাদেরও দায় আছে। তারা যদি সবাই অন্য খাতের পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতেও বিনিয়োগ করতেন তাহলে হয়ত আজ এতোটা বিপর্যয়ের শিকার হতে হতো না। পাশের দেশ ভারতের বড় বড় শিল্পপতিরা আন্তর্জাতিকমানের হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন তাদের দেশে। সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে একজন সাধারণ নাগরিকও অর্ধেক টাকায় চিকিৎসা করাতে পারেন। এই বাকি টাকাটা দিয়ে দেয় হাসপাতাল বা অন্য কোনো সংস্থা তাদের করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) ফান্ড থেকে। আমাদের শিল্পপতিরা কি এটা পারেন না!

করোনা প্রাদুর্ভাবের পর সিঙ্গাপুরের গল্প শুনেছি। সেখানকার ধনাঢ্য মানুষ, বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ থেকে এতো এতো সহায়তা হাসপাতালে এসেছে যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাত জোড় করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন গ্রুপ করোনাকালে ফটোসেশনের জন্য কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দিয়েছে।   কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির জন্য সেই অর্থে তাদের কোনো প্রচেষ্টা তেমন চোখে পড়ে না। অথচ শিল্পপতিরা চাইলে হাসপাতালগুলোর আইসিইউ ইউনিট সাজিয়ে দিতে পারেন। ট্রলি, বেড, হুইল চেয়ার, টেস্ট কিট, ওষুধ, ভেন্টিলেটর, পিপিইসহ অনেক কিছুই দিয়ে দিতে পারেন। আশা করি এবার তাদের বোধোদয় হবে। বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে দেশের স্বাস্থ্যবব্যব্স্থা উন্নতির দিকে মনোযোগী হবেন। তবে সবার আগে আন্তরিক হতে হবে সরকারকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আন্তরিক না হলে স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুর দশা কখনও কাটবে না।

লেখক: আলেম সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তি সংবাদকরোনায় আরও ৪২ জনের মৃত্যু, ২৪ ঘন্টায় শনাক্ত ২ হাজার ৭৩৫ জন
পরবর্তি সংবাদকরোনার উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশনে কেজরিওয়াল