মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি: একটি নাম, একটি ইতিহাস   

শিহাব সাকিব।।

হযরত মাওলানা মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি রহ.। একটি নাম, একটি ইতিহাস। কিংবদন্তী আলেমে দীন। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের দীর্ঘ দিনের শাইখুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিস।ইলম আমল তাকওয়া তাহারাতের মূর্তপ্রতীক। সময়ের পাবন্দ, কর্মে আত্মনিমগ্ন, ধর্মে অপসহীন সংগ্রামী বীর।

তার জ্ঞানগভীরতা ও ফাকাহাতের স্বীকৃতির দিয়েছেন আরব আজমের আলেম ওলামা ও ইসলামিক স্কলারগণ। ফিকহ ফাতওয়ার উপর তার ছিল সবিশেষ পাণ্ডিত্য। তাফসির, উলুমুল হাদীস সম্পর্কেও তার সম্যক ধারণা ছিল। নাহু সরফ মানতিক ফালসাফাসহ জটিল ও দুর্বোধ্য অনেক বিষয়েই সহজ ও বোধগম্য রচনা উপহার দিয়েছেন জ্ঞানপিপাসুদেরকে।সুতীক্ষ্ম মেধা ও প্রতিভার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছিলেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও পণ্ডিতদের হৃদয়।

সালাফে সালেহিন ও আকাবিরে দেওবন্দের ভারসাম্যপূর্ণ স্বভাব চরিত্র, রুচিপ্রকৃতি, আদর্শ চেতনা ধারণ ও লালন করতেন তিনি।

জন্ম

কীর্তিমান এ মহান পুরুষ ১৩৬০ হিজরিতে গুজরাটের এক সম্ভ্রান্ত দীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ইউসুফ।  দাদার নাম আলি।

শিক্ষাদীক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় ঘরেই। বাবার কাছে। বয়স যখন ছয় যেতে শুরু করেন পাড়ার মকতবে। মকতবের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন স্থানীয় মাদরাসায়। মাধ্যমিক স্তর (শরহে জামি) সমাপ্ত করে ১৩৭৭ হিজরিতে চলে যান সাহারানপুরের বিখ্যাত দীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাজাহিরুল উলুমে। সেখানে যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে তিন বছর পড়াশুনা করে, ১৩৮০ হিজরিতে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী দীনী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে।দারুল উলুম দেওবন্দের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী- ১৩৮২ হিজরিতে দাওরা হাদীস সমাপ্ত করেন। দাওরায়ে হাদীসে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ফিকহ ফতোয়া বিষয়ে উচ্চতর কোর্স করার লক্ষ্যে ইফতা বিভাগে ভর্তি হন। মুফতি মাহদি হাসান শাহজাহানপুরি রহ. এর তত্ত্বাবধানে ২ বছর ফিকহ ফতোয়ার উপর অনুশীলনী করেন।

এই মহান বুযুর্গের শৈশবে কুরআন হিফজ করার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। তাই ফতোয়ার কোর্সের সাথে সাথে তিনি কুরআনে কারিমের হিফজ পূর্ণ করেন।

মাওলানা কারি মুহাম্মদ তায়্যিব, ফখরুদদীন আহমদ মুরাদাবাদি, ইবরাহিম বালয়াবি, শায়খ যাকারিয়া কান্ধলবি, আবদুল কাদের রায়পুরি, নাসির আহমদ খানসহ বিখ্যাত ও যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদের সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি।

পাঠদান

তার পাঠদান ছিল সহজবোধ্য, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও গুছানো। ফলে কোন ধরণের ক্লেশ ছাড়াই ছাত্ররা হৃদয়ঙ্গম করে নিত। কেউ চাইলে খুব সহজেই শব্দে শব্দে নোট করতে পারত। তার প্রতিটি দরস হত তত্ত্ব ও তথ্যে ভরপুর। শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধের মত তার ক্লাশ শুনত। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত তার দরসগুলোর।

১৩৮৪ হিজরিতে দেওবন্দ থেকে উচ্চ শিক্ষার সনদ নিয়ে চলে যান সুরাটে। উচ্চপদস্থ শিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন জামিয়া আশরাফিয়ায়। ৯ বছর সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেন সেখানে।

মুফতি সাইদ আহমদ রহ. এর ইলমি যোগ্যতা ও পাঠাদনের অসাধারণ দক্ষতা নজর কাড়ে দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যতম শুরা সদস্য বরেণ্য আলেম মাওলানা মানযুর নুমানি রহ. এর । তিনি দারুল উলুমের শিক্ষক হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করেন। ফলে ১৩৯৩ হিজরিতে দারুল উলুমের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান পালনপুরি রহ.। তাফসিরে বাইযাবি, তাফসিরে জালালাইন, সহিহুল বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানুত তিরমিযি, শরহু মাআনিল আসার ও মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিতাবের পাঠদান করেন আযহারুল হিন্দ খ্যাত দেওবন্দে।

আল্লাহ প্রদত্ত বুদ্ধিমত্তা পাণ্ডিত্য ও ক্ষুরধার প্রতিভার মাধ্যমে খুব দ্রুত সময়েই তিনি সবার মনে জায়গা করে নেন। হতে থাকে পদোন্নতি। একে একে অলংকৃত করেন শাইখুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসিনের মসনদ।

ইলমি দাওয়াতি সফর

শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি মুফতি পালনপুরি রহ. ইংল্যান্ড আমেরিকা কানাডা আফ্রিকা সৌদিআরব কুয়েত কাতারসহপৃথিবীর বহু দেশে দাওয়াতি ও ইলমি সফর করেছেন। এসব সফর সাধারণত মাদরাসার বিরতিতে করতেন। ছোট বড় অনেক সমাবেশে জনসাধারণ ও আলেম ওলামার উদ্দেশ্যে বয়ান ও নসিহত পেশ করেছেন। বিভিন্ন ইলমি সেমিনারে অংশ গ্রহন করে প্রবন্ধ নিবন্ধ পাঠ করেছেন। সমস্যা সংকট মোকাবেলায় দিকনির্দেশনা পেশ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সেসব বয়ানের সংকলনও তৈরি হয়েছে।

পদ পদবি

শাইখুল হাদীস এবং সদরুল মুদাররিস

মাওলানা নাসির আহমদ খান রহ. এর ইন্তেকালের পর ১৪২৯ হিজরিতে তিনি শাইখুল হাদীস এবং সদরুল মুদাররিস বা প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। আমৃত্যু তিনি এ পদ দুটির যথার্থতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন।

খতমে নবুওয়ত সংগঠনের নাযেমে আলা

দারুল উলুম দেওবন্দে যখন মজলিশে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত প্রতিষ্ঠা করা হয় তাকে বানানো হয় এর নাজেমে আলা। অত্যধিক ব্যস্ততার কারণে একবার অবসর গ্রহণ করতে চাইলেও কতৃপক্ষ তা মানে নি। ইনতেকালের আগ পর্যন্ত এপদে বহাল ছিলেন তিনি।

পুরস্কার

আমাদের পূর্বসূরিরা বরাবরই পুরস্কার, সম্মাননা এড়িয়ে চলেন। তারা দেশ জাতি ও উম্মাহর কল্যাণে নিরবে নিভৃতে কাজ করে যেতেই অধিক ভালবাসেন। এবং বিনিময় চান একমাত্র তাদের রবের কাছে। তবুও কখনও কখনও বাহ্যিক সম্মাননা গ্রহন করতে বাধ্য হন। তেমনি এক ক্রাইসিস ছিল ভারতের ৬৪ তম স্বাধীনতা দিবসে। সেদিন পালনপুরিকে প্রতিভা দেবীসিংহ প্যাটেল সম্মাননা সনদ প্রদান করা হয়।

রচনাবলি

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন কালজয়ী ও তুমুল জনপ্রিয় বেশ কিছু গ্রন্থ। আরবি ও উর্দু ভাষায় রচিত তার গ্রন্থগুলো আলেম ও তালিবুল ইলমদের জন্যে ছিল অনন্য উপহার। তার লেখার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সহজবোধ্যতা ও সাবলিলতা। তিনি কঠিন ও সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ইলমি বিষয়কে খুব সহজে উপস্থাপন করতেন। দারুল উলুম দেওবন্দসহ উপমহাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে তার অনেক কিতাব পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হয়।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো

তাফসিরে হেদায়াতুল কুরআন

আল ফাওযুল কাবির (আরবি ভাষান্তর)

আল আউনুল কাবির লিহাল্লিল ফাওযিল কাবির

ফাইযুল মুনইম শরহে মুকাদ্দিমায়ে সহিহ মুসলিম

যুবদাতুত তহাবি, (তাহারাত অধ্যায়) শরহে মাআনিল আসারের সংক্ষেপ, আরবী

আল মাহফুজাত= মাজমুআতুল আহদিস আল মুনতাখাবা (৩ খণ্ড)

তুহফতুল আলমায়ি শরহে সুনানে তিরমিযি (হযরতের দরসের তাকরির)

তুহফাতুল কারি শরহে সহিহিল বুখারি (তাকরির)

তুহফাতুদ দুরার শরহে নুখবাতুল ফিকার

শরহে ইলালিত তিরমিযির তাহকিক ও শরাহ  (আরবি)

মাশাহির মুহাদ্দিসিন ও ফুকাহা ওয়াতাযকিরা রাওয়িয়ানে কুতুবে হাদীস

তাহযিবুল মুগনি (তাহের পাটনি)

হায়াতুল ইমাম আবি দাউদ

হায়াতুল ইমাম তাহাবি

ইমদাদুল ফাতাওয়ার টীকা (১ম খণ্ড)

কিয়া মুকতাদি পর ফাতেহা ওয়াজিব হ্যা (তাসহিলে তাওসিকুল কালাম লিন নানুতবি)

তাসহিলুল আদিল্লাতুল কামিলা (শাইখুল হিন্দ)

তাসহিলু ইযাহিল আদিল্লা (শাইখুল হিন্দ।)

মাবাদিল উসুল (আরবি)

মুয়িনুল উসুল (উর্দূ)

আপ ফাতাওয়া কেয়সে দি (শরহু উকুদি রাসমিল মুফতির উর্দু শরাহ)

হুরমতে মুসাহারাত

রহমতুল্লাহিল ওয়াসিআহ শরহে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ

হুজ্জাতুল্লহিল বালিগার টীকা (আরবি)

ইসলাম তাগাইয়্যুর পযির দুনয়া মে (প্রবন্ধ সংকলন)

ইলমি বয়ান (২ খণ্ড)

দাড়ি আওর আমবিয়া কি সুন্নত

জলসায়ে তাযিয়াত কা শরয়ি হুকুম

মিফতাহুল আওয়ামিল শরহে মিয়াতে আমিল

আসান নাহু (২খণ্ড)

হাদিয়া শরহে কাফিয়া (উর্দু)

ওয়াফিয়া শরহে কাফিয়া (আরবি)

আসান সরফ (৩ খণ্ড)

আসান মনতিক

আসান ফারসি কাওয়ায়েদ

মিফতাহুত তাহযিব, শরহুত তাহযিব ফিল মানতিক

মাবাদিল ফালসাফা

মুয়িনুল ফালসাফা

ইন্তেকাল

এক বর্ণাঢ্য ইলমি জীবন শেষে ১৪৪১ হিজরির পবিত্র রমজানের ২৫ তারিখ,  ১৯ মে  ২০২০ রোজ মঙ্গলবার সকালে কিংবদন্তী এ আলেম মোম্বাইর এক হসপিটালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। রেখে যান হাজার হাজর গুণগ্রাহী শাগরেদ ও ভক্তকুল। তার ইন্তেকালে বিশ্বের ইলমি মহলগুলোতে নেমে আসে শোকের ছায়া। সৃষ্টি হয় বিরাট এক শুন্যতা।

জানাজা দাফন

করোনা ভাইরাসের সংকটপূর্ণ মুহূর্তে স্বল্প লোকের উপস্থিতিতে জানাজা পড়ে মুম্বাইর জগেশরির বিখ্যাত অশিওয়ারা কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

আল্লাহ তাআলা তার ইলমি খেদমতগুলো কবুল করুন, তাকে ভরপুর মাগফিরাত করুন, তার কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সবরে জামিলের তাওফিক দান করুন। আমিন।

তথ্যসূত্র

১. আল কালামুল মুফিদ, রুহুল আমীন ফরিদপুরি, প্রকাশক, মাকতাবতুল হেযাজ, দেওবন্দ, ভারত, ৩, ৫২৭- ৫২৯।

২. আল মাদখাল, মাওলানা আবদুল মালেক (১৬৪)।

৩. সাওয়ানেহে পালনপুরি, মাওলানা আমীন পালনপুরি।

৪.মাওলানা মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি, মাওলানা যাহিদ রাশেদি, রোযনামায়ে ইসলাম (২০. ০৫. ২০২০)

৫. আল বুদুরুল মুদিয়্যাহ, ৮: ১৯৮ -২০২।

৬. আলমে ইসলাম কে বুলন্দ পায়া মুহাদ্দিস মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি, রিয়াসত আলি কাসেমি।

৭. উইকিপিডিয়া উর্দু, বাংলা।

 

পূর্ববর্তি সংবাদহাতের লেখা সুন্দর করা: “‘হাইওয়ানে কাতিব’ হওয়ারও চেষ্টা করুন”
পরবর্তি সংবাদলিবিয়ায় বাংলাদেশি হত্যা: ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে ‘মূল হোতা’