লকডাউনের সাথে সাথে কি শেষ হলো সচেতনতাও?

ওলিউর রহমান ।।

করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যেই অর্থনীতির চাকা সচল করতে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে খুলে দেওয়া হয়েছে অফিস, কারখানা। চালু করা হয়েছে গণপরিবহন। দীর্ঘ দুইমাসের অবরুদ্ধ পরিস্থিতির পর গতকাল থেকে চলাফেরায় বিধি নিষেধ তুলে নেওয়া হলে রাস্তাঘাট, দোকানপাট এবং প্লাটফর্মগুলোতে যথেষ্ট ভিড় দেখা গেছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত খবর এবং তথ্যচিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ততার নগরী রাজধানী ঢাকা ধীরে ধীরে চিরচেনা রূপে ফিরছে। লকডাউন তুলে দেওয়ার প্রথমদিনে গতকাল রাজধানীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যানবাহন চলাচলের কথা শুনা গেলেও আজ ডেকে ডেকে বাসে যাত্রী তোলার চিত্র সংবাদমাধ্যমসূত্রে আমাদের চোঁখে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সবার মধ্যে যেন স্বস্তি ফিরেছে। দীর্ঘদিনের আটকে থাকা কার্যাদি সম্পন্ন করা যাচ্ছে।

অথচ বৈশ্বিক মহামারী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস বাংলাদেশের দিকে ভয়ঙ্করকমের চোঁখ রাঙানি দিচ্ছে। প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। আজ মৃতের সংখ্যা সাতশো ছাড়িয়ে যাওয়ার দিনে শনাক্তের পরিমান বেড়ে দাঁড়াল বায়ান্ন হাজার। নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানো হলে এ সংখ্যা যে আরও কয়েকগুণ বেশি হতো তা নির্দ্বধায় বলা যায়। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোশতাক আহমেদ আরও কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশে শনাক্তের চেয়ে দশগুণ বেশি করোনা আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা।

দীর্ঘদিন স্থবির হয়ে থাকা অর্থনীতির চাকা সচল করতে লকডাউন তুলে দেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও সাধারণ মানুষের চলাচলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সামনে আরও কঠিন হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীও প্রায় প্রতিদিন তার লাইভ ব্রিফিং-এ নিজের এজাতীয় আশঙ্কার কথা জানান দিচ্ছেন।

বর্তমান করোনা চিকিৎসায় দায়িত্বপালনকারী রাজধানীর আলোক স্প্যশালাইড হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার টি আই খান তৌহিদের সাথে কথা হয় এ বিষয়ে। চলমান পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্যসেবার দুর্গতির কথা তুলে ধরে ‘করোনার সংক্রমণ এড়াতে জনসচেতনাতার কোনো বিকল্প নাই’ বর্তমানের সর্বাধিক চর্চিত এ বাক্যটিই পুনরায় বলেন এই ডাক্তার।

পাশাপাশি টেলিভিশনে দেখানো যত্রতত্র মানুষের জটলা এবং জনসমাগমের চিত্র দেখে করোনার ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে তিনি খুব শঙ্কিত বলে প্রকাশ করেন ডা. তৌহিদ।

‘লকডাউন তুলে নেওয়ার পরবর্তী সময়টা খুবই ডিফিকাল্ট’ পত্রিকায় এ মর্মে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোতে তুলনমূলক ভালো অবস্থানে থাকা জার্মানিতে আমরা দেখেছি, লকডাউন বাতিলের পরবর্তী দিনে দ্বিগুণ হারে করোনা সংক্রমণ বাড়তে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতের দিল্লিসহ নানা জায়গায়ই দেখা গেছে এমন ঘটনা। বাংলাদেশেরও আজকে পরিস্থিতি গত আড়াইমাসের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন।

গত চব্বিশঘন্টায় মাত্র বার হাজার নমুনা পরীক্ষা করে প্রায় তিন হাজার জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। গত দুইদিন রাস্তাঘাটে, দোকানে-বাজারে মানুষের যে অবাধ চলাফেরা এবং সমাগম দেখা গেছে তাতে আশঙ্কা হয়, সামনে হয়ত আরও কম পরীক্ষা করলেও আজকের থেকে আরও বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হবে।

বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা জানাচ্ছে, করোনা পৃথিবী থেকে সহসায় দূর হচ্ছে না। তাই বাংলাদেশে বর্তমান সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যেই লকডাউন তুলে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক; সেই পর্যালোচনা বাদ দিয়ে আমরা জনগণের সচেতনতার কথা বলি। সরকারপ্রধান কয়েকদিন আগে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, আমাদের করোনার সাথে অভ্যস্ত হয়েই জীবন যাপন করতে হবে। এ বক্তব্যের সরল অর্থ করলে দাঁড়ায়, সবাইকে স্ব উদ্যোগে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করেই চলতে হবে।

যেখানে দীর্ঘমেয়াদী সময়ের জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সেখানে লকডাউন তুলে নেওয়ার প্রথমদিনেই মানুষের অসচেতনতার যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা ভীতির এবং শঙ্কার।

রাস্তাঘাটে অবাধ চলাফেরা দেখে একটি প্রশ্ন বারবার আমার মনে উদয় হচ্ছে-লকডাউনের সাথে সাথে মানুষের সচেতনতার পাঠও কি চুকে গেছে…?

পূর্ববর্তি সংবাদবিশ্বব্যাপী করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ২৯ লাখ মানুষ
পরবর্তি সংবাদইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় প্রতিবেদন চেয়েছে হাইকোর্ট