‘করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ভাই-বোনেরা প্লাজমা দান করে অনেক সওয়াব পেতে পারেন’

পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। প্রায় ছয় মাস আগে এ ভাইরাসের উৎপত্তি। দেশে দেশে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ এতে মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত হয়েছে অর্ধ কোটিরও বেশি। এর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। সম্প্রতি পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে করোনা রোগীদের মাঝে ‘প্লাজমা থেরাপি’ নামে এক ধরনের চিকিৎসা প্রয়োগ হচ্ছে। এই চিকিৎসায় একজনের গায়ের রক্তের অংশ আরেকজনকে দিতে হয়। চিকিৎসকরা বলছেন এতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি এ চিকিৎসা পদ্ধতি ও এ বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের দিকনির্দেশনা জানার জন্য ইসলাম টাইমস সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে দেশের বিশিষ্ট ফকীহ, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র রঈস মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাহেবের


 

ইসলাম টাইমস: করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের কথা আলোচনায় আসছে। এটি আসলে কী, ইসলামী শরীয়তের এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা কী?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ: করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের ওপর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের খবর গণমাধ্যমে আসছে। এ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে অনেকে শরয়ী দিকনির্দেশনাও জানতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে দেশী-বিদেশী অভিজ্ঞ ডাক্তারদের বিভিন্ন বক্তব্য এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিবেদন ও জার্নালসমূহের অনুবাদ পড়ে যতটুকু জানতে পেরেছি, এটা পুরোপুরি নতুন কোনো পদ্ধতি নয়, আগেও এর প্রয়োগ হয়েছে। বড় বড় ভাইরাস জনিত রোগ, ইবোলা সার্সসহ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভাইরাসে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর এই প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে অতীতে। এবং এর ফলে অনেক সময় রোগীরা উপকৃত হয়েছেন এমন খবর পাওয়া গেছে। এজন্যই করোনা ভাইরাস চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এ থেরাপির প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

ইসলাম টাইমস: এজাতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি কি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ: এ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধান জানার আগে জানা দরকার এ পদ্ধতিটা আসলে কী। প্লাজমা থেরাপি বলা হয়, কোনো ব্যক্তি ভাইরাস জনিত রোগ থেকে আল্লাহ তাআলার দয়ায় যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন সেই ব্যক্তির দেহে ওই রোগের ব্যাপারে একটা প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হয়। চিকিৎসকরা এই প্রতিরোধশক্তিটাকেই বলেন অ্যান্টিবডি। সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিটির শরীর থেকে রক্তের বিশেষ পদার্থ বা অংশ এই রোগে আক্রান্ত অন্য ব্যক্তির মাঝে প্রবেশ করালে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা হলো, এতে অন্য রোগীও সুস্থ হয়ে যায়। সুস্থ হওয়া ব্যক্তির অ্যান্টিবডি রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রতিরোধ শক্তি তৈরি করে। এটাকে চিকিৎসকরা প্লাজমা থেরাপি বলে থাকেন। সাধারণভাবে কিছু শর্তের সঙ্গে এই প্লাজমা থেরাপি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ।

ইসলাম টাইমস: প্লাজমা থেরাপির বৈধতার শর্ত ও সুরতগুলো যদি বলতেন…

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ: এখানে বিবেচনার কয়েকটি বিষয় রয়েছে, সঙ্গে কিছু শর্তও। এ-জাতীয় অন্যান্য ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তে যেসব শর্ত ও বিবেচনার কথা বলা হয়ে থাকে সেগুলো এখানেও প্রযোজ্য। প্রথম কথা হলো, সাধারণভাবে প্লাজমা দেওয়া-নেওয়া জায়েজ কি-না। এ প্রশ্নটির উত্তর হ্যাঁ বাচক। প্লাজমা দান ও গ্রহণ করা রক্ত দেওয়া-নেওয়ার মতোই একটি বিষয়। ফুকাহায়ে কেরাম রক্তদান করা এবং গ্রহণ করাকে অনেক আগেই বৈধতার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। তবে রক্ত যেমন বিক্রি করা অবৈধ, তেমনি প্লাজমা বিক্রি করাও অবৈধ। অসুস্থ কোনো ব্যক্তি অপারগ হলে তার জন্য রক্ত বা প্লাজমা কেনা বৈধ হতে পারে, কিন্তু বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সাধারণভাবে প্লাজমা দান করা যাবে গ্রহণ করা যাবে, বিক্রি করা যাবে না।

দ্বিতীয়ত, প্লাজমা দান করার বিষয়টির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ডাক্তারের যথাযথ দিকনির্দেশনা ও অনুমোদন লাগবে। প্লাজমা অনেকটা রক্তের মতো, বরং রক্তদানের চেয়েও প্লাজমার ক্ষেত্রে আরো সূক্ষ্ম ব্যাপার রয়েছে। এ জন্য অভিজ্ঞ ও যোগ্য চিকিৎসক যার জন্য যার প্লাজমা উপযোগী মনে করবেন প্লাজমা দাতা তাকে প্লাজমা দান করবেন। দাতা ও গ্রহীতার যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত এবং প্লাজমার অপব্যবহার অথবা অপচয় করার মতো কোনো কাজ করা যাবে না। যোগ্য চিকিৎসকের মতের প্রাধান্যই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ইসলাম টাইমস: প্লাজমা দাতা ও গ্রহীতার মাঝে পুরুষ-মহিলা, আত্মীয়-অনাত্মীয়, মাহরাম- গায়রে মাহরাম ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনো বিভাজন বা সতর্কতার প্রশ্ন কি আছে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ: না, প্লাজমা দান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে এ জাতীয় কোনো বিভাজন ও সতর্কতার প্রশ্ন নেই। দাতা-গ্রহীতার মাঝে পুরুষ- মহিলা, মাহরাম-গায়রে মাহরাম, আত্মীয়-অনাত্মীয় এবং পরিচিত-অপরিচিতের কোন বিভাজন ও পার্থক্য নেই। যোগ্য চিকিৎসক যদি মনে করেন দাতার প্লাজমা গ্রহিতা গ্রহণ করতে পারবে এবং এ বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দেন তাহলে এক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রশ্ন থাকবে না। তবে, প্লাজমা বেচাকেনা করা যাবে না, একথা আমরা আগেও বলেছি। মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ তাআলার বিশেষ দান। চাইলেই কোনো মানুষ সে অঙ্গ বিক্রি করতে পারে না; রক্ত যেমন বিক্রি করতে পারে না। রক্ত যেমন দান করা জায়েজ, প্লাজমাও দান করা জায়েজ, যদি এতে দাতার শরীরের বিশেষ কোনো ক্ষতি না হয়। আমরা যতটুকু জেনেছি, প্লাজমা দান করায় সুস্থ ব্যক্তির শরীরে কোনো ক্ষতি হয় না। চিকিৎসক তাকে দান করার উপযোগী মনে করলে তিনি প্লাজমা দান করবেন। এবং আমরা একথাও বলব, এ দানের বদৌলতে তিনি আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক সওয়াব পাবেন। দান করা সওয়াবের কারণ হবে, বিক্রি করা বা বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ হবে না।

ইসলাম টাইমস: সচ্ছল, সামর্থ্যবান প্লাজমা গ্রহীতা যদি প্লাজমা দাতাকে কোনো উপহার দেন সেটা কি বৈধ হবে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ: করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ধনাঢ্য বা সাধারণ সচ্ছল ব্যক্তি যদি প্লাজমা দাতাকে কোনো উপহার বা হাদিয়া দিয়ে থাকে সেটা ভিন্ন কথা। কোনো শর্ত, কোনো প্রত্যাশা কিংবা কোনো বিনিময়ের ব্যাপার যদি না থাকে তাহলে প্লাজমা গ্রহীতার পক্ষ থেকে দেওয়া এই উপঢৌকন বা হাদিয়া নিজের পক্ষ থেকে দেওয়া স্বতঃস্ফূর্ত উপহারের মতো গণ্য হবে। এটা জায়েজ। এজাতীয় উপহার বিনিময়ের আওতায় পড়বে না, বরং সৌজন্যমূলক উপহার বা উপঢৌকনের আওতায় পড়বে।

ইসলাম টাইমস: করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় চলমান প্লাজমা থেরাপি নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো আহ্বান অথবা পরামর্শ কি আছে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ: এই প্লাজমা থেরাপি যদি করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় স্বীকৃত ও কার্যকর হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে তাহলে আমরা আহ্বান জানাব, যেসব মুসলমান ভাই-বোনেরা করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তাআলার দয়ায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং তাদের শরীর প্লাজমা দানের উপযোগী, তারা যেন অন্য অসুস্থ ভাই-বোনদের আরোগ্যের ক্ষেত্রে প্লাজমা দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিজের ‘উপহার’ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই প্লাজমা দাতা ভাই-বোনদের আজরে জাযীল বা উত্তম বিনিময় দান করবেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আবু তাশরীফ

পূর্ববর্তি সংবাদলিবিয়া হত্যাকাণ্ড: খুনীদের শাস্তি চেয়েছে বাংলাদেশ
পরবর্তি সংবাদনিজের প্রতিষ্ঠিত দল থেকেও বহিস্কৃত হলেন মাহাথির