যেমন ছিল নবীযুগের মাদ্রাসা

মাওলানা জাহিদুল আলম ।।

কিবলা পরিবর্তনের পর যখন মসজিদে নববীকে বাইতুল্লাহের দিকে ফেরানো হয় তখন প্রথম কিবলার দিকের দেয়াল ও তৎসংলগ্ন জায়গাটি গৃহহীন গরীব সাহাবীদের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।এ জায়গাটিই পরবর্তীতে “সুফফা”নামে প্রসিদ্ধ হয়। প্রচন্ড দারিদ্র্য সত্ত্বেও এ শ্রেণীর সাহাবীরা আল্লাহ তায়ালার কালাম ও নবীজীর বাণী শোনার জন্য দিনরাত মসজিদে নববীতে পড়ে থাকতেন। চাষাবাদ বা ব্যবসা-বাণিজ্য কোন কিছুর সাথেই তাঁদের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ইলমেদ্বীন অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। সমাজে তাঁরা “আসহাবে সুফফা” বলে পরিচিত ছিলেন।

হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সত্তরজন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি, তাদের কারো গায়ে বড় চাদর ছিল না। হয়ত ছিল কেবল লুঙ্গি কিংবা ছোট চাদর, যা তারা ঘাড়ে বেঁধে রাখতেন। (নীচের দিকে) কারো নিস্‌ফে সাক বা হাঁটু পর্যন্ত আর কারো টাখনু পর্যন্ত ছিল। তারা লজ্জাস্থান দেখা যাবার ভয়ে কাপড় হাত দিয়ে ধরে রাখতেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৪২)

হযরত ওয়াসিলা ইবনে আসকা’ রা. বলেন, আমিও আসহাবে সুফফার একজন ছিলাম। আমাদের কারো কারো কাছে পুরো একটি কাপড়ও ছিল না। ঘামের দরুন শরীরে সবসময় ময়লা জমে থাকত।(হিলয়াতুল আউলিয়া)

তাঁরাই ছিলেন হাদীসে বর্ণিত أشعث و أغبر তথা ধুলোমলিন,উস্কোখুস্কো চুলওয়ালা এর বাস্তব নমুনা যাদের ব্যাপারে ঘোষণা হয়েছে,যদি এরা আল্লাহর নামে কসম করে কিছু বলে ফেলে তাহলে আল্লাহ অবশ্যই সেটা পূরণ করেন।

হযরত মুজাহিদ রহ.বলেন,হযরত আবু হুরায়রা রা:বলতেন,ঐ সত্ত্বার কসম যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই,ক্ষুধার জ্বালায় প্রায়ই আমি পেট মাটির সাথে মিশিয়ে রাখতাম(যাতে মাটির শীতলতার দরুন ক্ষুধার উত্তাপ কিছুটা লাঘব হয়)।আবার অনেক সময় পেটে পাথর বাঁধতাম যেন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারি”।

মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রহ.বলেন,”যখন সন্ধ্যা হত তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসহাবে সুফফাদের সাহাবায়ে কেরামের মাঝে ভাগ করে দিতেন।(অনেকটা লজিংয়ের মতো)কেউ দুজনকে নিয়ে যেত,কেউ তিনজনকে। হযরত সাদ বিন উবাদা রা: আশিজনকে বাসায় নিয়ে খাবার খাওয়াতেন।”(ওয়াফাউল ওয়াফা)

এছাড়া মসজিদে নববীতে দুটি খুঁটিতে দড়ি বাঁধা ছিল।আনসার সাহাবীগন নিজ নিজ ক্ষেত থেকে শস্য,খেজুর,খাসি এনে সেখানে ঝুলিয়ে রাখত। সুফফাবাসীরা লাকড়ি সংগ্রহ করে সেগুলো রান্না করে খেতেন।মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:এখানকার ব্যবস্থাপনার জিম্মাদার ছিলেন।(ওয়াফাউল ওয়াফা) আসহাবে সুফফাদের সংখ্যায় কম-বেশী হত।

আরেফে জামান সোহরাওয়ার্দী রহ.তাঁর কিতাব “আওয়ারিফে” লিখেছেন”আসহাবে সুফফার সংখ্যা ৪০০তে গিয়ে ঠেকেছিল।” ইমাম আবু আব্দুর রহমান সুলামী,ইবনুল আরাবী,হাকিম,আবু নুয়াইম রহ. আসহাবে সুফফার নাম ও পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। আসহাবে সুফফার উল্লেখযোগ্য কয়েকজন: ১.আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা:। ২.আম্মার বিন ইয়াসার রা:। ৩.আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা:। ৪.মিকদাদ বিন আমর রা:। ৫.খাব্বাব ইবনুল আরাত্ব রা:। ৬.বেলাল বিন রবাহ রা:। ৭.যায়দ ইবনুল খাত্তাব রা:। ৮.আবু যর গিফারী রা:। ৯.আব্দুল্লাহ বিন উমর রা:। ১০.সালমান ফারসী রা:। (সীরাতে মুস্তফা,৪৩৪-৪৩৮. মাওলানা ইদরীস কান্দলভী রহ.)

যুগে যুগে আসহাবে সুফফাগনই দ্বীনি ইলম চর্চাকারীদের আদর্শ বলে বিবেচিত হয়ে আসছেন।সম্পদ অর্জনের পেছনে সময় দিতে না পারার কারণে দারিদ্র্য তাঁদের পিছু ছাড়ত না। কিন্তু এরপরও অন্যান্য ধনী সাহাবীদের তুলনায় তাঁরা সবর ও শোকরের জিন্দেগী যাপন করতেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁদের অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমাদেরকে তাঁদের কাতারে শামিল করে নিন।আমীন।

পূর্ববর্তি সংবাদবিবৃতি: আল্লামা বাবুনগরীকে নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার ভিত্তিহীন রিপোর্টের প্রতিবাদ
পরবর্তি সংবাদসেহরির সময়ও পশ্চিম তীরে অভিযান, ১ ইসরাইলী সেনা নিহত