গ্রন্থ পর্যালোচনা ।। ফুরুউল ঈমান, ঈমানের শাখা প্রশাখা

ইবনে আবদুল কুদ্দুস ।।

নাম: ফুরুউল ঈমান

লেখক: হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানবি রহ.(ওফাত ১৩৬২ হি.)

বিষয়: ঈমান ও আকিদা

ভাষা: উরদু

ভাষান্তর: বাংলা, ইংরেজি (আরও বিভিন্ন ভাষা)

শুরুর কথা

ইসলামের প্রধান স্তম্ভ হল ঈমান। এর রয়েছে অনেকগুলো শাখা প্রশাখা। পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্যে সবগুলো শাখা প্রশাখা নিজের ভেতর ধারণ ও লালন করতে হয়।রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ঈমানের রয়েছে সত্তুরের অধিক শাখা প্রশাখা। সর্বোত্তম হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা। সর্বনিম্ন হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো। আর লজ্জা ঈমানের একটি শাখা।-সহিহ মুসলিম (৩৫)।

ঈমানের এই শাখাগুলোর বিবরণ কুরআন ও হাদীসে বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে। মুহাদ্দিস ও ফুকাহায়ে কেরাম সেই সব শাখা আলাদা আলাদাভাবে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।কাযি আবু আবদিল্লাহ হালিমি (ওফাত ৪০৩ হিজরি) ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বাইহাকি রহ.(ওফাত ৪৫৮ হিজরি)সহ অনেকেই ঈমানের শাখাগুলোর ব্যাখ্যায় স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন।

সেই ধারাবাহিকতায় ভারতের মুসলিমদের জন্যে উরদু ভাষায় ঈমানের শাখাগুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক হাকিমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ.। মুসলিম সমাজের ক্রমবর্ধমান অধঃপতন রোধে অনেক ধরণের সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড আঞ্জাম দিয়েছেন তিনি। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল তার ইসলাহী কিতাবসমূহ।এই ইসলাহি কিতাবগুলোর অন্যতম হল আমাদের আলোচ্য “ফুরুউল ঈমান”। যা তিনি১৩১৫ হিজরির মুহাররম মাসে লিখেছিলেন।

হযরত মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব সাধারণ শিক্ষিতদের জন্যে আকিদা বিষয়ক যে সব কিতাব পড়তে বলেন তন্মধ্যে এই কিতাবটি অন্যতম।

কেন লিখেছেন?

দুইটি মৌলিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে থানবি রহ. এই মূল্যবান গ্রন্থটি রচনা করেন। চলুন তার ভাষায়ই শোনা যাক সে বিবরণ- “দীর্ঘদিন যাবৎ আমার ইচ্ছা ছিলো ঈমানের এ শাখাসমূহকে আমার স্বদেশী মুসলিমদের জন্যে সহজ উর্দুতে লেখার। যাতে তারা জানতে পারে যে ঈমানের দাবি তারা করে, তার কতগুলো শাখা রয়েছে এবং চিন্তা করে দেখে যে তাদের মধ্যে এসব শাখার কতগুলো বিদ্যমান রয়েছে এবং কতগুলো নেই। তাহলে এরদ্বারা নিজের ঈমানের পূর্ণতা ও অপূর্ণতার পরিমাপ করতে পারবে। যে সমস্ত গুণের অভাবে নিজেদের মধ্যে পাবে সেগুলোরঅর্জন এবং পূর্ণতা সাধনের চেষ্টা করবে। এগুলো পূর্ণ না করে পরিপূর্ণ ঈমানের দাবী করতে লজ্জা বোধ করবে। যদিও দীনের মূল বিষয়গুলো মানার দ্বারা নিম্নস্তরের ঈমানের অধিকারি হওয়া যায়। কিন্তু সে ঈমান তেমনই হাত পা চোখ কান ছাড়া মানুষ যেমন।

এসব শাখা আলোচনা করার আরেকটি উদ্দেশ্য হল অমুসলিমরা যেন জানতে পারে ইসলামের শিক্ষা যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ এবং ইসলাম ঐ ব্যক্তিকেই পূর্ণ মুসলমান বলে যার মধ্যে এ সমস্ত উত্তম চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। অসম্পূর্ণ মুসলমানদের দেখে তারা ইসলামের শিক্ষাকে যেন গুরুত্বহীন মনে না করে।”

দীনের পথে চলতে গেলে অনেকের সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় জাগতিক ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা বিষয়। এপ্রসঙ্গে থানবি রহ.লিখেন, “কারো যেন এ সন্দেহ না হয় যে আমি দুনিয়া উপার্জন করতে নিষেধ করছি বা তার যে সব উপায় ও পন্থা আছে যেমন ইংলিশ পড়া, আধুনিক শিল্প আবিষ্কার করা ইত্যাদিকে হারাম বলছি। এটা কখনই আমার উদ্দেশ্য নয়। খুব দুনিয়া কামান, চাকুরি করুন, জাগতিক উপায় উপকরণ অবলম্বন করুন এবং তাতে কৃতিত্ব দেখান। আমার কথা হল দীনকে ধ্বংস ওতুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। দুনিয়া উপার্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধি নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করুন। দুনিয়াকে দীনের উপর প্রাধান্য দিবেন না। জাগতিক জ্ঞান বিজ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে নামাজ রোজা থেকে গাফিল হবেন না। ইসলামি আকিদার উপর পরিপক্ক থাকবেন।

আলেমদের কাছে গিয়ে নিজের আমল আকীদাকে পরিশুদ্ধ করুন। কোন সন্দেহ থাকলে জিজ্ঞাসা করুন।

ঈমান আকিদা আমল আখলাকইসলামি বেশভূষা সব কিছুঠিক রেখে লন্ডন গিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে আসুন, মুন্সেফিগিরি করুন, ডেপুটি কালেক্টর ও জজের পদ অলঙ্কৃত করুন তাহলে আমাদের চোখ শীতল হবে, আমরা আনন্দিত হব।”

কী আছে এতে?

থানবি রহ.এতে তিনটি অধ্যায়ে ঈমানের শাখাগুলোরব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত, দ্বিতীয় অধ্যায়ে যবানের সাথে সম্পৃক্ত আর তৃতীয় অধ্যায়ে অন্যান্য বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্তঈমানের শাখাসমূহের বিবরণ পেশ করেছেন।

হাকিমুল উম্মত রহ. বলেন, “বিজ্ঞ আলেমগণের প্রদত্ত তথ্য অনুপাতে ঈমানের শাখা ৭৭ টি। এর মধ্যে ৩০ টির সম্পর্ক অন্তরের সাথে, ৭টি জিহ্বার সাথে আর বাকি ৪০ অন্যান্য অঙ্গের সাথে। আমি এতিন ধরণের শাখাগুলোকে তিনটি অধ্যায়ে আলোচনা করব।”

প্রত্যেক অধ্যায়ে প্রথমে শাখাসমূহের ধারাবাহিক তালিকা পেশ করেছেন। তারপর কুরআন হাদিস এবং সালাফের উক্তির মাধ্যমে প্রতিটি শাখার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। মাঝে মধ্যে প্রাসঙ্গিক অন্য অনেক বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন এবং নানা অমূলক সংশয় সন্দেহের অপনোদন করেছেন। কখনও সমাজে অবহেলিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয়গুলোর উপর সতর্ক করেছেন।

ভাষান্তর

গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থটি বিশ্বের অনেক ভাষায়অনুবাদিত হয়েছে। বাংলায় একাধিক অনুবাদ রয়েছে এই গ্রন্থটির। সর্বপ্রথম ১৩৫০ হিজরিতে অনুবাদ করেছেন কিংবদন্তি আলেম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. (ওফাত ১৩৮৮ হিজরি)। শাব্দিক অনুবাদ না করে তিনি ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ করেছেন এবং কিছু কিছু স্থানে টীকা যুক্ত করার সাথে নিজের পক্ষ থেকে কিছু ব্যাখ্যা ও বক্তব্য সংযোজন করেছেন। ফলে গ্রন্থটির শোভা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।তার ভাষায় -“আমার পীর মুজাদ্দেদে জামান কুতুবে দাওরান জগদ্বিখ্যাত আলেম ও পীর হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের রেছালারই তর্জমা করিয়াছি। কিন্তু শব্দে শব্দে করি নাই। জায়গায় জায়গায় কিছু ব্যাখ্যা করিয়াছি।” -পৃষ্ঠা: ১৩২।

যে কোন গ্রন্থেরএমন অনুবাদ হলে গ্রন্থের উপকারিতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। পাঠক কঠিন বিষয় খুব সহজেই বোঝে নিতে পারে। এতে অঞ্চল ও ভাষা ভেদে যেসব বিষয় পরিবর্তন হয় তা খুব সহজেই ফুটিয়ে তুলা যায়, শাব্দিক অনুবাদের ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয় না বা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে এর জন্যে অবশ্যই অনুবাদক যোগ্য ও পারদর্শী হতে হবে।

মূল গ্রন্থের সাথে তিনি তার “ইসলাম ও কুফরের ১৪৫ শাখা” ও “কবীরা গুনাহের ১০১ সংখ্যা” নামক আরও দুটি পুস্তিকা যুক্ত করে দিয়েছেন।

এই গ্রন্থ লেখার উদ্দেশ্য ও উপকারিতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “অনেকের ধারণা মুসলামানের ঘরে জন্মগ্রহণ করিলেই বুঝি মুসলমান হওয়া যায়। নিজের কিছু করার দরকার হয় না। কিছু না করিয়া শুধু মুসলাম নাম ধারণ করিলেই বিনা ক্লেশে বেহেশতে যাওয়া যায়। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।কেননা ইসলাম কাহারও ‍পৈতৃক সম্পত্তি নয়। ইসলাম এমন কতকগুলি কার্যের নাম যাহা যে কেহ সম্পন্ন করিবে সেই মানবতার চরম উন্নতির আসনে আসীন হইতে পারিবে।

অনেক অমুসলমান আমাদের ন্যায় ইসলামের কুপুত্র কুলাঙ্গারদের দেখিয়া, কেহ ইসলামের প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও ইসলাম হইতে দূরে দূরে থাকে, আবার কেহ না জানিয়া অনর্থক প্রতিবাদ করিতেও পশ্চাদপদ হয় না। এই সমস্ত ভুল ধারণা এবং প্রতিবাদ নিবারণার্থে আমি এখানে ইসলাম ও ঈমানের খাঁটি স্বরূপ এবং ব্যাপকতা সংক্ষেপে দেখাইতে চাই।”পৃষ্ঠা: ১১, ১৩।

কীভাবে বইটি পড়বেন সে বিষয়ে উপদেশ দিয়ে ফরিদপুরি রহ. লিখেন, “আজকাল লোকের অভ্যাস হইয়াছে শুধু পড়িযা যাওয়ার। কিন্তু প্রিয় পাঠক! আপনি শুধু পড়িয়া চলিয়া যাইবেন না, চিন্তা করিয়া অমূল্য উপদেশগুলি ভিতরে ঢুকাইতে চেষ্টা করিবেন, নিজের জীবন গঠন চরিত্র সংশোধন এবং আমল দুরস্ত করিবার চেষ্টা করিবেন।” পৃষ্ঠা: ১৩১।

এই গ্রন্থের আরেকটি বাংলা অনুবাদ করেছেন মাওলানা জালাল উদ্দীন হাফিযাহুল্লাহ। তিনি শাব্দিক ও মূলানুগ তরজমা করেছেন। তার অনুবাদটি প্রকাশ করেছে অভিজাত ইসলামি প্রকাশনা সংস্থা মাকতাবাতুল আশরাফ ঢাকা।

এই বইয়ের ইংলিশ অনুবাদ করেছেন ড. রফিক আহমদ। নাম দিয়েছেন The Branches of Iman(Furu-ul Iman)।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, আমল ও প্রচার প্রসার করার এবং এগুলোর উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

০২. ০৯. ১৪৪১ হিজরি।। ২৫. ০২. ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।

 

পূর্ববর্তি সংবাদনির্দিষ্ট সময়ের পরে করোনা আপনাআপনিই বিদায় নেবে : ট্রাম্প
পরবর্তি সংবাদসোমালিয়ায় মসজিদে তারাবীহ পড়া অবস্থায় সাবেক খেলোয়াড়কে গুলি করে হত্যা