সাহরী : জীবনে ছড়ানো প্রভাত রেখা

মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব ।।

মানুষের মন মানসিকতা, রুচি চিন্তা, আগ্রহ অভ্যাস, ঝোঁক দুর্বলতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় কোনো কোনো কাজকে সহজ মনে হয়। কোনো কোনো কাজকে মনে হয় কঠিন। কোনো কাজের প্রতি থাকে আবেগ ও আকর্ষণ, কোনো কাজের প্রতি অনীহা। এটা অনেকটা প্রাকৃতিক। অনেকটা মানুষের গড়ন, গঠন, পরিবেশ ও অভ্যস্ততা-অনভ্যস্ততার কারণে। ফলে আল্লাহ তাআলা মানুষের উপর যেসব ইবাদাত আবশ্যক করেছেন এবং যেসব কাজকে নেক আমল হিসাবে নির্ধারণ করেছেন তার অনেকগুলো পালনে সে আনন্দ উপলব্ধি করে। কোনো কোনোটা পালনে অনুভব করে কিছুটা চাপ। কোনো কোনোটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, কোনো কোনোটা আদায়ে থাকে দায়িত্ব পালনের ভূমিকা। এগুলোর প্রত্যেকটির জন্য রয়েছে বিভিন্ন ফযীলত ও সওয়াব। আরও গভীর বাস্তবতা হলো, প্রত্যেকটির জন্য যেমন রয়েছে আখিরাতের জাযা ও প্রতিদান তেমনি রয়েছে দুনিয়াবীও কিছু ফায়দা ও উপকারিতা। ইখলাস থাকলে বিভিন্ন ইবাদাত ও নেক আমলের জাযা প্রতিদান ও ফায়দা উপকারিতার কথা জানতে শুনতে কোনো সমস্যা নেই। বরং ফায়দা উপকারিতা জানা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে আমলটির প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। গুরুত্বের সাথে আমলটি করতে প্রেরণা ও শক্তি অনুভূত হয়। তবে হ্যাঁ, কোনো কোনো নেক আমলের ফায়দা জানা না থাকলেও মানবীয় আকর্ষণের ফলে তার প্রতি খুব আগ্রহ থাকে। নিয়মিত এবং অধিক পরিমাণে আমলটি করতেও বিন্দুমাত্র ক্লান্তি বোধ হয় না। রমযান মাসের ইফতার ও সাহরী তেমনি দুটি নেক আমল।

সারাদিন রোযা রেখে ক্লান্ত পিপাসার্ত হয়ে ইফতারী সামনে নিয়ে বসা, পরম আগ্রহে ঠাণ্ডা শরবতের ভরা পেয়ালায় তৃপ্তির চুমুক দেয়া, রোযার মতো মহৎ একটি ইবাদাত পালনের অলৌকিক আনন্দ উপলব্ধি করা- সে বিবরণ তুলে ধরা সত্যিই অসম্ভব। তেমনি শেষ রাতে, সমস্ত চরাচরকে ঘুমে রেখে, আল্লাহ তাআলার মহান একটি হুকুম পালনের প্রস্তুতি হিসাবে বরকতময় দস্তরখানে শরিক হওয়া এবং নির্ধারিত সময়ের ভিতরে আহার সমাপ্ত করার তড়িৎ আয়োজনে নিজেকে ব্যস্ত রাখার পুলকময় মুহূর্তটুকু বাস্তবিক পক্ষেই বর্ণানাতীত।

সাহরীকে আল্লাহ তাআলা ফরয করেননি। যেন শেষ রাতের এই নিদ্রাঘন মুহূর্তে ঘুম না ভাঙলে কারো কষ্টে পড়তে না হয়। যেন স্বাভাবিকভাবেই তার রোযা হয়ে যায়। তবে সাহরীর বরকত ও আনন্দকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে জানিয়েছেন,

تَسَحَّرُوا،فَإِنَّ فِي السُّحُورِ بَرَكَةً

তোমরা সাহরী খাও। কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে।-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৫

অন্য হাদীসে আছে, নিশ্চয় সাহরী বরকতময় খাবার। অতএব এক ঢোক পানি হলেও তোমরা সাহরী খাওয়া পরিত্যাগ করো না। যারা সাহরী খায়, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দুআ করেন।-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১০৮৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৪৭৬ ও ৩৪৬৭

সাহরী খেতে হয় সুবহে সাদিকের আগে। যে সময়টা তাহাজ্জুদের সময় হিসাবে পরিচিত। সারা বছর আল্লাহর নেক বান্দাগণ এসময় ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং সর্বোচ্চ ফযীলতের নফল নামায তাহাজ্জুদ আদায়ে মগ্ন হন। দীর্ঘ সময় দুআ মুনাজাত ও রোনাযারিতে অতিবাহিত করেন। কিন্তু সাধারণ মুমিনগণ নিয়মিত এ নামায আদায় করতে পারেন না, অনেকটা অলসতা এবং কিছুটা ক্লান্তি ও পর্যাপ্ত ঘুমের অজুহাতে। তবে রমযান মাসে এ সময় সাধারণ ও নেককার সকল মুমিন মুসলমান জেগে উঠেন এবং বরকতময় সাহরীতে অংশগ্রহণ করেন। সেইসঙ্গে দুই চার রাকাত তাহাজ্জুদ নামাযও আদায় করেন। কিছু সময় কাটান জায়নামাযে। দুআ মুনাজাত করেন। প্রাণ ভরে আল্লাহকে ডাকার সুযোগ পান। কোরআন মাজীদে মুত্তাকীদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,(অনুবাদ ) নিশ্চয় মুত্তাকীগণ জান্নাতে (উদ্যানরাজি) ও ঝর্ণাসমূহের মধ্যে থাকবে। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা কিছু দেবেন তারা তা উপভোগ করবে। নিশ্চয় তারা এর আগেই সৎকর্মশীল ছিল। তারা রাতে খুব কম ঘুমাতো। সাহরীর সময় ইসতিগফার করতো।-সূরা যারিয়াত, আয়াত ১৫-১৮

রমযান মাস এই মুত্তাকী হওয়ার ফযীলতপূর্ণ মাস। তাকওয়া অর্জনের শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাসে রোযার মাধ্যমে যেমন তাকওয়ার অনুশীলন হয়, তেমনি সাহরীর মাধ্যমে লাভ হয় অসীম বরকত। সেইসঙ্গে মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ গুণ-তাহাজ্জুদ নামাযে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য থাকে অবারিত সুযোগ। যে নামায সম্পর্কে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

أَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ ، صَلَاةُ اللَّيْلِ

ফরয নামাযের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামায হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩

অতএব তাকওয়া অর্জনের এ মাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এই নফল নামায, কোরআনে বর্ণিত মুত্তাকীদের এই বৈশিষ্ট্য এবং জীবনকে নূরময় করার গুণ-তাহাজ্জুদগুযার হওয়ার এ সাধনা সবার করা উচিত। সাহরীতে জাগার এ অভ্যাস বছরব্যাপী অব্যাহত রাখার সংকল্প করা উচিত।

ঘুমভাঙ্গা সাহরীর অবারিত এ সুযোগে প্রভাময় হয়ে উঠুক প্রতিটি মুমিনপ্রাণ। সাহরীর বরকতে বরকতময় হোক সবার জীবন। তাহাজ্জুদের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত হোক পুরো চরাচর। তাকওয়ার দৌলত লাভ করুক মুমিনকুল। রমযানের সুবহে সাদিক সবার জীবনে বয়ে আনুক স্থায়ী কল্যাণ ও অফুরান বরকতের প্রভাত রেখা।

পূর্ববর্তি সংবাদবন্দরে সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণ : ঘুমন্ত ২ শিশু নিহত
পরবর্তি সংবাদতেহরানে শক্তিশালী ভূমিকম্প