যুগে যুগে শাসকের দরবারে নির্ভীক আলেম সমাজ

শাসক এবং আলেম সমাজ। প্রত্যেক যুগের আলোচিত এক অধ্যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে কেমন ছিল শাসকদের সাথে আমাদের আসলাফের আচরণ পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীর তুলে ধরেছেন তার বিশেষ কলামের মাধ্যমে  ইতিহাসের সেই সোনালী আখ্যান। ইসলাম টাইমসের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল। ডেইলি জং থেকে লেখাটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন- নুরুদ্দীন তাসলিম ।

 

এক প্রবল দাপটধারী শাসক সে যুগের বিশিষ্ট আলেমকে রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু সেই আলেম এই প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করলেন। ফলে সে আলেমকে কারাবন্দি হতে হল।

সেই দুনিয়া বিমুখ আলেম ছিলেন ইমাম আবু হানিফা রহঃ। তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা সেই শাসক ছিল দ্বিতীয় আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আব্দুল্লাহ ইবনে মানসুর।

ইমাম আবু হানিফা রহঃ শাসকের দরবার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। খলিফা মানসুর ইমাম আবু হানিফা রহঃকে নিজের প্রধান বিচারপতির পদ প্রস্তাব করলে ইমামে আজম রহঃ নিজেকে সে পদের অযোগ্য বলে দাবি করলেন। এতে খলিফা ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কারণ সে যুগে প্রধান বিচারপতিকে খলিফার নায়েবের মর্যাদা দেওয়া হতো।

খলিফা ঔদ্ধত্য স্বরে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো। একথার প্রতি উত্তরে ইমাম আবু হানিফা রহঃ- এর জবাব ছিল, আমার দাবি মিথ্যা হলে সত্যিই আমি এই পদের অনুপযোগী।  এই উত্তর ইমাম আজম রহঃ-এর জেল জীবনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। এরপর তাঁর ছাত্র আবু ইউসুফ রহঃকে প্রধান বিচারপতি বানানো হল।

জেলে ইমাম আবু হানিফা রহঃ- এর উপর নির্মম নির্যাতন করা হতো, যেন তিনি খলিফার প্রস্তাব মেনে নেন। কিন্তু তিনি সে যুগের শাসকের ইচ্ছার সামনে মাথা ঝুঁকাননি। ফলে জেল থেকে তাঁর জানাজা বের হয়েছিল। বাগদাদে তাঁর জানাজায় জনস্রোত নেমেছিল। আল- মানসুর ইমাম সাদেক রহঃ কেও  জোর পূর্বক নিজের আনুগত্য শিকার করতে বাধ্য করেছিল। তিনি এতে সায় না দিলে  তাকেও কারাবন্দি করেছিলেন আল মানসুর। কেউ কেউ বলেন আল-মানসুরের নির্দেশে ইমাম জাফর সাদেক রহঃকে বিষ পান করানো হয়েছিল।

ইমাম মালেক ইবনে আনাস রহঃ ও এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। যখন মদীনায় খলিফা মানসুরের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হল, খলিফার আনুগত্যের শপথ নেওয়া সবার জন্য আবশ্যক। ইমাম মালেক রহঃ নির্দ্বিধায় ফতোয়া দিয়েছিলেন, খলিফার আনুগত্যের উপর বাধ্য করা জায়েজ নেই। এই ফতোয়া তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। একারণে তাকে গ্রেফতার করে জনসম্মুক্ষে চাবুক মারা হল।

যে সময় ইমাম আবু হানিফা,জাফর সাদেক, ইমাম মালেক রহঃ স্বৈরাচারী শাসকের সামনে মাথা উঁচু করে সত্য বলছিলেন, তখন খলিফার দরবারে এমন আলেমও ছিলেন যারা খলিফার তোষামোদি করে তার প্রিয় হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন।

কিন্তু খলিফার তোষামোদি করা সেই আলেমদের ইতিহাস আজ ভুলে গেছে। বাদশার সামনে উচ্চস্বরে সত্য বলে হাসি মুখে কারা বরণ করে নেওয়া, জনসম্মুখে চাবুকের বারি খাওয়া আলেমেরাই ইতিহাসে বরণীয় হয়েছেন।

সত্যের কণ্ঠস্বর হয়ে ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকা আলেমদের কাতারে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।

আব্বাসি  খলিফা আল মামুনের দরবারি কিছু আলেম কুরআনকে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি অভিহিত করাসহ আরো বেশ কিছু ভ্রান্ত মতবাদ উদ্ভাবন করেছিল। ইমাম আহমদ রহঃ অপকটে তার বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কুরআনকে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি মনে করা কুফর।

খলিফা আল মামুন ইমাম আহমদ রহঃ-এর কথাকে নিজের জন্য অপমান মনে করে তাকে জেলে বন্দি করলেন।

কিছুদিন পর খলিফা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ ও তার সাথী মুহাম্মদ ইবনে নূহ রহঃকে আবার দরবারে ডাকলেন। যখন তারা বেড়ি পরা অবস্থায় খলিফার কাছে যাচ্ছিলেন,  তখন খলিফার এক কর্মচারি তাদের দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, কুরআন আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি খলিফার এই মতাদর্শ না মানলে আজ আপনাদের শিরচ্ছেদ করে ফেলবে।

একথা শুনে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ দোয়া করলেন , হে আল্লাহ সত্যিই যদি কুরআন তোমার সৃষ্টি না হয়ে তোমার কালাম হয়ে থাকে, তাহলে এই স্বৈরাচারী মামুনের সাথে আমাদের যেন আর দেখা না হয়। ইমাম হাম্বল রহঃ-এর এই দোয়ার পরে সে রাতেই খলিফা আল মামুন মারা যায়।

আল মামুনের মৃত্যূর পরে তার ভাই মুতাসিমবিল্লাহ ক্ষমতায় বসেন। এসময় মুহাম্মদ ইবনে নূহ রঃ-এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। খলিফা মুতাসিমবিল্লাহ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ ও দরবারি আলেমদের মাঝে মুনাযারার ব্যবস্থা করেন।

মুনাযারায় দরবারি আলেমেরা হেরে গেলে তারা খলিফাকে বলে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল শুধু আমাদের নয় মহিমান্বিত খলিফাকেও কাফের অভিহিত করেছেন।

এতে খলিফা রাগান্বিত হয়ে ইমাম আমদ ইবনে হাম্বল রহঃকে বিবস্ত্র করে চাবুক মারেন। এই অত্যাচারের সামনে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের অবিচলতা দেখে মুতাসিমবিল্লাহ দিশেহারা হয়ে যায়। চাবুকের আঘাতে আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

এ অবস্থায় না আবার তিনি ইন্তেকাল করেন এই ভয়ে খলিফা তাঁকে ছেড়ে দেন। এই সময়টা ছিল রমজান মাস। আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ রোজা রেখেছিলেন তাঁকে অর্ধমৃত অবস্থায় ইসহাক ইবনে ইবরাহিমের ঘরে নিয়ে আসা হয়। জ্ঞান ফিরলে তাঁকে বলা হয় আপনার শরীর থেকে প্রচুর রক্ত ঝরছে, আপনি রোজা ভেঙ্গে ফেলুন। কিন্তু এ অবস্থায় আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ জোহর আদায় করেন এবং বলেন হযরত ওমর ফারুক রাঃ আহত অবস্থায় নামাজ পড়েছিলেন।

তিনি সন্ধ্যায় ইফতার করেন এবং সেই জল্লাদদের ক্ষমা করে দেন কিন্তু মানুষকে গোমরাহকারী দরবারি আলেমদের ক্ষমা করেননি। তার জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। সে জানাজা দেখে হাজার হাজার খৃষ্টান মুসলমান হয়ে যায়।

ইমাম শাফী রহঃ থেকে নিয়ে ইমাম মূসা কাযিম রহঃ, আব্দুর রহিম মুহাদ্দেসে দেহলভী রহঃ, মুজাদ্দেদে আলফে সানী রঃ এবং যুগে ‍যুগে অনেক মুজতাহিদ আলেম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে যুগের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন, নির্মম নির্যাতন সয়েছেন।

এ কারণেই ইতিহাস এই আলেমদের কথা সোনালী অক্ষরে সংরক্ষণ করেছে। বিপরীতে দরবারি তোষামোদকারী আলেমরা ঘৃণাভরে উপেক্ষিত হয়েছেন।

একবার খলিফা হারুনুর রশিদ ইমাম মালেক রহঃকে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য বার্তা পাঠালেন। ইমাম মালেক রহঃ উত্তর পাঠালেন, এলেমের সাক্ষাতে নিজেকে উপস্থিত হতে হয়, এলেম কারো কাছে যায় না।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী রহঃ তার ‘আনফাসুল আরেফীন’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, একবার মোগল বাদশা আলমগীর আব্দুর রহিম মুহাদ্দেসে দেহলভী রহঃ- এর সাথে দেখা করতে চাইলেন। জবাবে তিনি লিখেছিলেন, আল্লাহওয়ালারা এব্যাপারে একমত যে, যেই ভিখারি বাদশাদের দরবারে উপস্থিত হয় না সেই উত্তম।

ইতিহাস সেসব আলেমদেরই অনুসরণীয় বলে গ্রহণ করেছে, যারা ক্ষমতাসীনদের দরবারে তোষামোদী করেননি, বরং ক্ষমতাসীনরা নিজেই তাদের কাছে ভিড়েছেন।

পূর্ববর্তি সংবাদরোযার মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে রোযা রাখছেন ব্রিটিশ অমুসলিম এমপি
পরবর্তি সংবাদ‘জন আকাঙ্ক্ষা’ থেকে নতুন নামে যাচ্ছে জামাতের সংস্কারপন্থী দল!