লকডাউন ঠিক আছে, ফাস্টিং ডাউনের কী হবে!

শরীফ মুহাম্মদ ।।

করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ‘ঘরে থাকা’ কর্মসূচি চলছে দেশে দেশে। অফিস-আদালত, কল কারখানা, পরিবহন সহ খেটে খাওয়া মানুষের উপার্জনের সব পথ প্রায় বন্ধ। জরুরি জীবনোপকরণ, ওষুধ, খাদ্য এরকম কয়েকটি খাত ছাড়া বাকি সব খাতের দরজায় এখন তালা ঝুলছে।

এ পরিস্থিতি থেকে বড় দেশ- ছোট দেশ কেউ বাইরে নেই। কিন্তু যেসব দেশের অর্থনীতি মজবুত, যেখানে দারিদ্র কম সেখানে এজাতীয় পরিস্থিতির চূড়ান্ত ভোগান্তির পরিমাণ কম। কিন্তু যেসব দেশে দরিদ্র মানুষ বেশি, নিত্যদিন খেটে রোজগার করে ঘরে চাল-ডাল কিনে নিয়ে যায়, কর্মহীন দিনের পর দিন, প্রায় তিন সপ্তাহ, পার হয়ে যাওয়ার পর তাদের চুলো জ্বলবে কীভাবে, এই প্রশ্নটি এখন অনেক বড় হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশে ‘প্রায় লকডাউন’ একটি পরিস্থিতি বিরাজমান। তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে এভাবে। আরো কতদিন যাবে এটা এখনই বলা মুশকিল। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কবে কমে আসবে অথবা নিঃশেষ হবে, ঠিকঠাক কেউ বলতে পারছে না। ধরুন আরও এক মাস, দেড় মাস, দুমাস…। এ অবস্থায় রোজগার বন্ধ কয়েক কোটি গরিব মানুষের পেটের ক্ষুধা তো বন্ধ থাকবে না! একদিকে ভাইরাসের মৃত্যুভয়, আরেকদিকে তিলে তিলে ক্ষুধায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি! কোনো সংকটকেই তো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কী করা তবে! বিকল্প কোনো পথ কি নেই? সমন্বিত চিন্তার কোনো সুযোগ কি নেই?

লকডাউন পরিস্থিতি স্থগিত করা কিংবা কিছু আয় রোজগার ও মেলামেশার অবস্থা চালু করা, করোনা ভাইরাসের এই প্রখর সংক্রমনের সময়টায় খুব ঝুঁকিপূর্ণ, এটা তো বোঝাই যাচ্ছে। তারপরও ক্ষুধা ও দারিদ্র্য এবং কোটি কোটি মানুষের না খেয়ে বাঁচা-মরার সংকট সামনে নিয়ে কিছু একটা ভাবা দরকার আছে বলে মনে হয়। বিত্তবান কোনো কোনো দেশ, যেখানে কোনো একদিনে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ১২০০/১৫০০ লোক মারা যাচ্ছে, সেখানেও সম্প্রতি লকডাউন শিথিল করে কিছু কর্ম পরিবেশ তৈরীর ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। তুরস্কে করোনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। সেখানে ৬৫ বছরের বেশি আর ২০ বছরের কম বয়সী নাগরিকদের ঘর থেকে বের হতে মানা করা হয়েছে, অন্যদের জন্য কিছু সতর্কতাসহ কাজের পরিবেশ খুলে দেওয়া হয়েছে। এতেও যে ঝুঁকি থাকছে না এমন নয়, তারপরও এটা করা হয়েছে।

অবশ্য বিবেচনার বড় একটি বিষয় হলো, করোনা ভাইরাস নিয়ে যেসব দেশে নাগরিকদের ভেতরে নিজস্ব সচেতনতা তৈরী হয়ে গেছে, সেসব দেশে তীব্র মৃত্যুঝুঁকির মধ্যেও সীমিত পরিসরে লকডাউন শিথিল করার ঝুঁকিটা তুলনামূলক কম। অপরদিকে যেসব দেশে নাগরিকদের মাঝে কথিত ‘সামাজিক দূরত্ব’ এবং জীবাণুর সংস্পর্শ থেকে বেঁচে চলার সচেতনতা একদমই কম, সেসব দেশে লকডাউন শিথিল করার ঝুঁকি অনেক বেশি। কিন্তু সমস্যাটা ওই জায়গাতেই। স্বাস্থ্য সচেতনতার অনুপস্থিতি ও বিপুল দারিদ্র্যের বসবাসটা প্রায় এক সঙ্গেই ঘটছে। এজন্য সহজেই আমাদের মতো দেশগুলোতে শিথিলতার সিদ্ধান্ত নেওয়া, এটা মনে হয় বেশ কঠিন। এরপরও তীব্র দারিদ্রের কষাঘাত ও ক্ষুধার কষ্টের চিত্রটা সামনে এলে কথা কিন্তু থাকেই।

কাজ-কর্মহীন প্রায় ২৫ টি দিন পার হয়ে গেছে। নিত্যদিনের রোজগার করা মানুষ, প্রতিদিন যার আয় ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা, সেই মানুষটির সর্বোচ্চ সঞ্চয় থাকে দশ দিন চলার মতো। এদিক-সেদিকের ত্রাণের পুটলায় আরো হয়তো চলল দশ দিন। এরপর তাদের কীভাবে চলছে? কীভাবে চলবে সামনের আরো অজানা এক মাস- দেড় মাস?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা -হু লকডাউন দিনদিন কঠোর করতে বলছে। ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কার ভয়াবহতার দিক থেকে এ আহ্বান হয়তো পুরোপুরি ঠিক আছে। কিন্তু কোনো কোনো দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের বেঁচে থাকার উপায় নিয়ে হু তো কিছু বলবে না। ক্ষুধার্ত মানুষের বাঁচা-মরার এরিয়া নিয়ে তার কাজ নয়। কিন্তু অন্যদের তো এটা নিয়ে ভাবতে হবে। নিয়ন্ত্রিত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এগলি -ওগলির কিছু ত্রাণ নিয়ে এদেশের কয়েক কোটি মানুষের ক্ষুধা মিটে যাবে, এমন কল্পনা করার দিন মনে হয় নেই।

মন্দা হয়তো অনেক দিক থেকেই আসবে। বিশ্বমন্দার কারণে রপ্তানি বাজার ও শ্রমজগত এবং প্রবাসী রেমিটেন্সে হতাশা নেমে আসতে পারে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে এদেশের দু কোটির চেয়েও বেশি মানুষের উপরে। ফুটপাত বন্ধ, ছোট কলকারখানা বন্ধ, গাড়ি-ঘোড়া লঞ্চ বন্ধ-এর নগদ প্রভাব পড়ছেই এখন দেশের খেটে খাওয়া মানুষের পরিবারে। সংকট কিছুটা দীর্ঘ হলে বহু প্রাইভেট সেক্টরে, বহু বেসরকারি ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয় ও বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রেও টানাটানি তৈরি হতে পারে। এসব থেকে উত্তরণ কোন কোন পন্থায় ঘটতে পারে, এখনই একটু ভাবনা চিন্তা করা দরকার। আবার হতে পারে, এইসব ক্ষুধার চিন্তার চেয়েও করোনার ভয়াল থাবার দুশ্চিন্তাটাকেই বড় করে দেখা উচিত। ভাবনারই বিষয়।

করোনা ভাইরাস, লকডাউন, প্রায় লকডাউন, এর পাশাপাশি ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট এবং এ পরিস্থিতির মেয়াদ নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে এজাতীয় ভাবনা, বিকল্প ভাবনা, তুলনামূলক ভাবনা এখন চলতে পারে। তবে এ কথাও মিথ্যা নয় যে, করোনার ঝুঁকি এবং অসতর্কতার ঝুঁকি আমাদের সমাজে মারাত্মক। জীবনের প্রয়োজনে দেওয়া কোনো শিথিলতা যেন বাঁধভাঙা স্রোতের সৃষ্টি না করে, যেন মৃত্যুর মিছিল তৈরি না করে, এদিকটির প্রতিও বিবেচনা দরকার। শিথিলতা কিছু আনলে সেটা শ্রেণি, কাজ ও সময় বিভক্ত করেও আনা যেতে পারে। কাজ ও চলার পরিবেশেও মানুষের সচেতনতা এবং দূরত্ব যেন বজায় থাকে সেদিকে প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কঠোর ব্যবস্থা থাকতে পারে। যেসব দেশে সীমিত পর্যায়ে শিথিলতা আনা হয়েছে, সেসব দেশের শিথিলতা ও সতর্কতার বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই চোখ রাখতে হবে।

প্রাণঘাতী রোগ এবং ক্ষুধা ও ক্ষুধা ঘটিত মৃত্যু- এ দুয়ের মাঝে যথার্থ এবং সমন্বিত কার্যকর কোনো বিবেচনা সক্রিয় করতে পারলেই এ জাতীয় বিকল্প চিন্তা এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে; তা না হলে নয়। কোনো অপরিকল্পিত অগোছালো চিন্তা থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলার মতো কোনো প্রস্তাব আমরা দিতে পারি না। আল্লাহ তাআলা সবাইকে হেফাজত করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদঅবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ও স্টাফদের বেতন দিতেই ট্রেনটি সিলেট গেছে : রেলমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদআইইডিসিআর প্রকাশিত তথ্যে যেসব জেলায় করোনা ছড়ায়নি এখনও