স্মৃতির শ্লেট: বাবু প্রমোদ শীলের প্রতি আক্ষেপমাখা স্মৃতির হাহাকার

শরীফ মুহাম্মদ ।।

পুরনো কালো ফ্রেমের পাওয়ারি চশমা। গায়ে তার ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি ও ঢোলা সাদা পায়জামা । শেভড করা মুখ, কখনো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ছোট বাজারে আব্বার দোকানে গেলেই তার সঙ্গে দেখা হতো। ৭৯-৮০-৮১ সালের কথা বলছি। আমার শৈশব তখন সবেমাত্র কৈশোরে পা ফেলতে যাচ্ছে।

আব্বার চেয়ে বয়সে একটু বড় হবেন। দোকানে আব্বার যেকোনো কাজে সহযোগী। গদ্দিতে বসা, বেচা বিক্রি করা, খরিদ্দার সামলানো, পাওনা টাকা আদায়, প্রতিবেশী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে ‘তাগাদা’য় বের হওয়া। কখনো কখনো আব্বা সময় করতে না পারলে বাসার বাজারটাও সেরে ফেলা। এমনকি জামিয়া ইসলামিয়ায় যখন নুরানী পড়ি, কোনো কোনো সময় আমাকে মাদরাসায় দিয়ে আসা এবং নিয়ে আসার কাজটিও তিনি করতেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়া, কাপড় জুতা কেনা-এসবেও তাকে আমার অভিভাবক হিসেবে পাঠাতেন আব্বা।

এতদিন পর আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, রিকশায় করে কোথাও নিয়ে যাওয়া বা আসার সময় এই লোকটি আমাকে উপদেশ দিতে থাকতেন, আমি যেন খুব ভালোভাবে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করি, তাহলে আব্বা খুশি হবেন। আমি যেন ভদ্র হই, শান্ত হই এবং যোগ্য হয়ে উঠি, তার মতো করে নানান কথা তিনি আমাকে বলতেন।

চলার পথে আগলে আগলে রাখতেন তিনি আমাকে। মাদ্রাসা থেকে আনতে গিয়ে কিংবা পথে চলতে গিয়ে নামাজের সময় হয়ে গেলে বলতেন, ‘তুমি নামাজ পড়ে আসো, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।’
মাঝে মাঝে আমার শিশু মনে খুব অস্বস্তি হতো, আমাকে নিতে এসেছে যেই লোক সবাই দেখছে, সে নামাজ না পড়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য ছাত্ররা কি বলবে দেখলে! অথচ তার অবস্থাটা আমি জানি, অন্যরা তো জানে না।

তিনি আব্বাকে ডাকতেন, ‘ভাই’। আব্বা তাকে ডাকতেন ‘বাবু’। আমি কখনো ডাকতাম, বাবু, কখনো, কাক্কা। তিনি ছিলেন বাবু প্রমোদ শীল। ময়মনসিংহে আমার শহুরে শৈশবে আব্বার সহকারি হিসেবে তার অনেক ছায়া পেয়েছি। পাঁচ-ছয় বছর তিনি আমাদের দোকানে ছিলেন। এর আগে ছোট বাজারেই লোকনাথের ছাতার দোকানে ২০-২৫ বছর কাটিয়েছেন। যখন কিছুটা দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে গেলেন ছেলে চন্দন শীলের সংসারে, কাঁচিঝুলিতে এসে উঠলেন।

মাঝে মাঝে বাসা থেকে শহরে আসা যাওয়ার পথে দেখতাম, কাঁচিঝুলিতে তার ছেলের সেলুনের দোকানের সামনে একটি টুলে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। আমাকে রিকশায় দেখলে ব্যাকুল হয়ে ডাক দিতেন। হারিয়ে যাওয়া আপনজন ফিরে পেলে মানুষ যেমন আকুল হয়ে উঠে, তিনি আমাকে দেখে ঠিক সেইভাবে নানা প্রশ্ন করতে থাকতেন। আব্বার কথা জিজ্ঞেস করতেন, ভাই-বোনের কথা জিজ্ঞেস করতেন। আম্মার কথা জিজ্ঞেস করতেন। আমার দাদা-দাদুর কথা জিজ্ঞেস করতেন। তখন আমি বাড়ন্ত কিশোর। লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যেতাম। একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি আমাকে বিদায় দিতেন।

এই বাবু প্রমোদ শীল, দোকানে আব্বার কর্ম-সহযোগী, আমার প্রতি যত্নবান ও স্নেহশীল মানুষটি ১৯৯০ সালের দিকে মারা যান। আমরা তখন খবর পাইনি। খবর পেয়েছি বেশ পরে। তার মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর তার বড় ছেলে চন্দন শীলও মারা যায়। কাচিঝুলিতে কত যাওয়া হতো, এখনো তো হয়। হঠাৎ হঠাৎ আমার স্মৃতির মধ্যে জেগে উঠেন পুরনো কালো ফ্রেমের চশমা পরা সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দেওয়া বাবু প্রমোদ শীল। আমার প্রতি তার অবদান, তার স্নেহ ও অভিভাবকত্বের জন্য তার স্মৃতির প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই।

দ্বীন ও ঈমানের প্রশ্নে চলে যাওয়া এই মানুষটির জন্য মাগফিরাতের দোয়া করার কোনো সুযোগ আমার নেই, কিন্তু তার অবদানের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা জানানোর পথ আমার জন্য বন্ধ নেই। অনন্ত পরকালীন মুক্তির বিবেচনায় বাবু প্রমোদ শীলের প্রতি আফসোস ও আক্ষেপমাখা এই স্মৃতিচারণের সঙ্গে আজ ছোট্ট একটি সুখকর প্রসঙ্গও উল্লেখ করতে চাই।

তার পরিবারের এখন কে কোথায় কী অবস্থায় আছে, জানার জন্য কাঁচিঝুলির এক বন্ধুকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি জানালেন, তার বড় ছেলে চন্দন শীল তো মারা গিয়েছে, কিন্তু অন্য এক ছেলে ইসলাম গ্রহণ করে এখন মসজিদে আসা-যাওয়া করছে। কাঁচিঝুলিতেই ওই ছেলের সেলুনের দোকান। বাবু প্রমোদ শীলের ইসলামে দীক্ষিত সন্তানের বয়স আমাদের মতই হবে।

জীবনে পরিবর্তন একটি বড় ব্যাপার। জীবনে প্রজন্ম একটি বড় ব্যাপার। জীবনে পালাবদল একটি বড় ব্যাপার।

তায়েফে নির্মমভাবে নির্যাতিত হওয়ার পর যখন তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার অনুমতি চাইলেন ফেরেশতা, মানবতার নবী রাসূলে কারীম (সা.) সেই কাফেরদের ধ্বংস না করার মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছিলেন:
لعل الله يخرج من اصلابهم من يعبد الله و لا يشرك به شيئا
‘হয়তো আল্লাহ তাআলা এদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন লোকজন সৃষ্টি করে দেবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না।’

হে হৃদয়সমূহের পরিবর্তনকারী, আপনি আমাদের হৃদয়কে আপনার আনুগত্যের ওপর দৃঢ় করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদবিপর্যয়ের মুখেও ফিলিস্তিনিদের করোনা চিকিৎসায় বাঁধা দিচ্ছে দখলদার ইসরায়েল
পরবর্তি সংবাদশবে বরাতে নিজ ঘরে ইবাদত করার আহ্বান ইত্তেফাকুল উলামা মোমেনশাহীর