স্মৃতির শ্লেট: দেশ ও উম্মাহর পক্ষে সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তির জীবন্ত কিংবদন্তী অধ্যাপক আবদুল গফুর

শরীফ মুহাম্মদ ।।

অধ্যাপক আবদুল গফুর। মোহাম্মদ আবদুল গফুর। বাংলাদেশের এক জীবন্ত কিংবদন্তী। ভাষা সংগ্রামী। লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং দেশ ও উম্মাহর পক্ষে সতত সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তির এক নাবিক। ১৯২৯ সালে তাঁর জন্ম। ৯১ বছরের এই বৃদ্ধ মানুষটি দীর্ঘ ক্লান্তি ও শ্রান্তির পরও আল্লাহ তায়ালার অসীম দয়ায় এখনো স্বাভাবিক জীবনে সক্রিয়।

বহুদিন পর গতকাল ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। সেই ভরাট কণ্ঠ, সেই স্বাভাবিক বাক্যাচার!

ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর স্বর্ণপ্রসবী মেয়াদে- ১৯৭৯ সাল থেকে প্রায় এক দশক ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা পরিচালক। ভাষা আন্দোলন চলাকালে তমদ্দুন মজলিস-এর পত্রিকা ‘সৈনিক’ সম্পাদনায় নিযুক্ত এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ইনকিলাব-এর ফিচার সম্পাদক। আর এ সূত্র ধরেই ১৯৯৪ সালে তাঁর টেবিলের সামনে আমার যাতায়াতের শুরু। পরিচিতি, আন্তরিকতা, স্নেহ এবং তাঁর সান্নিধ্যের সৌরভে স্নাত হওয়া। প্রায় এক দশক এ যাতায়াত ছিল ধারাবাহিক।

প্রচার ও প্রভাবের দিক থেকে আজকের প্রথম আলোর চেয়ে ইনকিলাব-এর অবস্থান তখন কম ছিল না।

আমি ছিলাম তখন মতিঝিল মাদ্রাসায়। ইনকিলাব অফিস পায়ে হাটা ৮ মিনিটের পথ। সন্ধ্যার পর প্রায়ই চলে যেতাম। আমার সৌভাগ্য, তাঁর সামনে গিয়েছি এবং ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়া বহু বহু বৈঠকে বসার সুযোগ পেয়েছি। যেটাকে ছোট্ট পরিসরে সাহিত্য ও চিন্তার আড্ডাই বলা যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট ছোট্ট করে তিনি কথা বলতেন, বলতে থাকতেন, আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম। আমি কাঁচা আবেগের বাক্স উপুড় করে দিতাম, তিনি হজম করতেন। দেশ ও উম্মাহর জন্য কিছু করার দরদ ও উত্তাপ তাঁর কাছে গেলে অনুভব করতাম।

কত গল্প যে হতো! সাম্প্রতিক ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক এবং ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গও চলে আসতো। তমদ্দুন মজলিস, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী আবুল হাশিম, ড. কাজী দীন মুহম্মদ, সৈয়দ আলী আহসান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ফরিদপুরের মাওলানা আব্দুল আলী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী সদর সাহেব, মাওলানা আব্দুর রহীমসহ বিভিন্ন মনীষীর গল্প উঠে আসতো। বিভিন্ন বৈঠকে বিভিন্ন প্রসঙ্গে।

আমার বিয়ের পর দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে বললেন, তাঁর বিয়ের পর সম্ভবত বাসর রাতে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন-তোমার একজন সতীন আছে।’ তাঁর উদ্বিগ্ন স্ত্রী সেই সতীনের নাম পরিচয় জানতে চাইলে তিনি হেসে বলেছিলেন, তার নাম তমুদ্দিন মজলিস। সংসার করার সঙ্গে সঙ্গে এই সংগঠনের সঙ্গেও সময় ও জীবন পার করতে হবে।

একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবী আবুল হাশিমের ছেলে হচ্ছেন আজকের প্রবীণ বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন ওমর। এই বদরুদ্দীন ওমর ‘সৈনিক’ পত্রিকায় একটি লেখা দিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের আগে আগে। ওমর তখন তরুণ লেখক ও বাম রাজনীতিক। লেখক হিসেবে নাম লিখেছিলেন বদরুদ্দীন মোহাম্মদ ওমর। বদরুদ্দীন ওমরের নামটা বাস্তবে এরকমই ছিল। কিন্তু মেকাপের প্রয়োজনে নামটাকে একটু ছোট করে ‘সৈনিক’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল বদরুদ্দীন ওমর। সেই থেকে বদরুদ্দীন মোহাম্মদ ওমর হয়ে গেলেন বদরুদ্দীন ওমর।

অধ্যাপক আবদুল গফুর বলেছেন, নামবদলের এ ব্যাপারটি পিতা আবুল হাশিম ভালোভাবে নেননি। তার ছেলে যে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এটা তিনি জানতেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন নামের মধ্য থেকে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি সে ইচ্ছা করে বাদ দিয়েছে। এ নিয়ে সন্তান বদরুদ্দীন ওমরের প্রতি মৃত্যু পর্যন্তই তার কিছুটা রাগ ও অভিমান ছিল। এর প্রভাব পড়েছে অন্যভাবে। পরবর্তী জীবনে অধ্যাপক আব্দুল গফুরের সঙ্গে বদরুদ্দিন ওমরের দেখা হলে ওমর বলতেন, ‘গফুর ভাই আপনার কারণে আব্বা আমাকে ভুল বুঝে গেছেন। নাম তো আমি নিজে থেকে পাল্টাইনি’।

একবার তিনি বলেছেন, ষাটের দশকে তমুদ্দিন মজলিস এর পক্ষ থেকে ওমর রা. দিবস পালন এবং হযরত ওমরের জীবনের উপর আলোচনা সভা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কীভাবে কী করা যায়, এ নিয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলোচনার অংশ হিসেবে তারা কয়েকজন লালবাগ মাদ্রাসায় গেলেন এবং মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.- এর সঙ্গে বৈঠক করলেন। হযরত ফরিদপুরী রহ তাদের সব গল্প শুনে বললেন, ‘এটাতো ভালো উদ্যোগ। আপনারা লালবাগ শাহী মসজিদে চলে আসুন। আলোচনা সভা এখানে হবে, আমি ব্যবস্থা করব।’
এরপর তমদ্দুন মজলিসের ওমর রা. দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো লালবাগ শাহী মসজিদের সামনের আঙিনায়।

অধ্যাপক আবদুল গফুর ফরিদপুরের রাজবাড়ীর মানুষ। পারিবারিকভাবে তাঁরা ফুরফুরার মরহুম পীর মাওলানা আব্দুল কাহহার সিদ্দিকী রহ. দ্বারা প্রভাবিত। তিনি আমাকে বলেছেন, তাঁর জীবনে তিনি দুজন সাধক আলেমের প্রতি গভীরভাবে মুগ্ধ। একজন ফরিদপুরের মাওলানা আব্দুল আলী, একজন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী।

এরকম আরো বহু বহু গল্প হয়েছে এবং হতো। তমুদ্দিন মজলিস ও ভাষা আন্দোলনের গল্প অনেক হয়েছে। সম্ভবত ২০০৩ অথবা ২০০৪ সালে ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য তিনি ‘একুশে পদক’ পেয়েছেন। ইসলাম এবং ধারাবাহিক স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর তাঁর বেশ কয়েকটি গবেষণাদীপ্ত গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর জীবনের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও মূল্যায়ন এক বিশাল দাস্তান। যার অল্প কিছু উঠে এসেছে তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘আমার কালের কথা’ গ্রন্থে।

আমার সৌভাগ্য বিবেচনা করি, তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশনায় নব্বইয়ের দশকে ইনকিলাব-এর বিশেষ সংখ্যাগুলোতে অনেক লেখা লেখার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর সান্নিধ্য লাভ এবং তাঁর পাতায় লিখতে পারা ছিল লেখাচর্চার জীবনে আমার জন্য একটি সোনালি পর্ব। ‘সবুজ গম্বুজের ছায়া’ বইটি প্রকাশের সময় তিনি অভিমতমূলক কিছু বাক্য আমার জন্য লিখেছিলেন। সুধারণা ও স্নেহপ্রসূত তাঁর সেই আন্তরিকতায় আমি কৃতজ্ঞ হই বারবার।

বয়োবৃদ্ধ জাতির এই প্রবীণ অভিভাবক বর্তমান এই করোনাকালে বাসায় বিশ্রাম করছেন। স্বাভাবিক সময়ে এখনো তিনি সপ্তাহে একদিন উপস্থিত হন দৈনিক ইনকিলাবে। জীবন ও চিন্তা সজীব। আদর্শ সৎ এক পিতা। নিঃসন্দেহে বয়সের ভারে এখন অনেক ক্লান্ত। এই জাতির মূল্যায়ন করার ক্ষমতা কম, যোগ্যতা ও মানসিকতা আরো কম। হুজুগ, স্লোগান আর দলবৃত্ততার সংকীর্ণতা ছাড়া শ্রদ্ধা ও সম্মানের কোনো রাজপথ আমরা সহজে চিনতে চাই না। পরিনামে এটা ভালো না।

৯১ বছর বয়সী জাতির এই অভিভাবক অধ্যাপক আবদুল গফুর-এর জন্য আমাদের দোয়া, আমাদের সালাম। বরকতময় জীবন এবং নাজাতওয়ালা আখেরাত আল্লাহ তা’আলা তাঁকে দান করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদএবার লকডাউন করে দেওয়া হলো গাজীপুর মহানগর
পরবর্তি সংবাদকিশোরগঞ্জে করোনা উপসর্গ নিয়ে দুই জনের মৃত্যু