শরীফ মুহাম্মদ ।।
সমাজের চোখে একজন অকিঞ্চিৎকর মানুষ। আগিলা আমলের মুনশি। শিক্ষা, প্রতিপত্তি, সম্মানের আসন কিংবা কোনো নাম ডাক তাঁর ছিল না। তারপরও তাঁর একটি ভিন্ন জায়গা ছিল মানুষের মনের আঙিনায়।
তিনি আব্দুল খালেক মুনশি। এলাকার লোকেরা তাঁকে ডাকতো, খালেক মুনশি। ময়মনসিংহের কাঠগোলা বাজারের পাশে পুরাতন জামে মসজিদের দীর্ঘকালীন মুয়াজ্জিন ও খাদেম ছিলেন। মসজিদের সঙ্গে তাঁর লেগে থাকার মেয়াদ ছিল কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ বছর। তার আগে তাঁর বাবা বাজিত মুনশি ছিলেন এই মসজিদের মুয়াজ্জিন। সে আমাদের দেখা- জানার আগের যুগের কথা।
বড় রাস্তার ওই পাশে নদীর পাড়ে আব্দুল খালেক মুনশির বাড়ি। ছোটকাল থেকে তাঁকে এক রকমই দেখে এসেছি। মাথায় গোল টুপি, পেছনটা ভাঁজ হয়ে থাকা সাধারণ গ্রামীণ জুব্বা। সবুজ কিংবা তামাটে রংয়ের কাপড়। কখনো তিঁত পড়া, কখনো আধা ময়লা হয়ে থাকা।
পুরনো মসজিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ধরনটা এক শব্দে বলা মুশকিল। মুয়াজ্জিন-খাদেম, চাঁদা উত্তোলনকারী, মসজিদ এবং গোরস্তানের যাবতীয় দরকারি কাজেরও তদারককারী। ব্যবস্থাপনা কমিটি তো ছিলই, কিন্তু পুরনো মসজিদের কোন বিষয় মানেই আব্দুল খালেক মুনশির বিষয়-এমন একটা বোধ এলাকায় প্রচলিত ছিল।
এই আব্দুল খালেক মুনশিরই বড় একটি পরিচিতি ছিল অন্যরকম। আমাদের বয়স যখন নয়-দশ, তখন থেকেই শুরু। এলাকায় সবচেয়ে আগে মাইক লাগানো হয় পুরনো মসজিদে। সে মাইকে আজান হয়। আর পুরো এলাকার দুই-তিন গ্রাম জুড়ে কেউ কখনো মারা গেলে মৃত্যুর ঘোষণাটা ওই মাইকে জানানো হয়। এই জানানোর কাজটি করতেন আব্দুল খালেক মুনশি। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় তিনি ঘোষণা করতেন: একটি শোক সংবাদ!
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল, আযানের সময় ছাড়া পুরনো মসজিদের মাইকে আব্দুল খালেক মুনশির ভাঙ্গা গলার আওয়াজ শুরু হতেই যে যেখানে থাকতো উৎকর্ণ হয়ে উঠতো। কথা বলতে বলতে মানুষ থেমে যেত। কার মৃত্যুর ঘোষণা জানি আসছে! ভেসে আসতো, ‘একটি শোক সংবাদ’!
শোক সংবাদের ঘোষণা দিয়েই মুনশির কাজ শেষ হতো না। মাইয়্যেতের আত্মীয়দের হাতে খাটিয়া তুলে দিতেন। তাদেরকে গোরস্তানে নিয়ে যেতেন। কোথায় কবর খুঁড়তে হবে, কবর কে কে খুঁড়ে দেবে, কাফনের কাপড় কোত্থেকে আনতে হবে, গোসল করানোর জন্য কাকে কাকে সহযোগী হিসেবে পাওয়া যাবে-সব তিনি ঠিক করে দিতেন। বাঁশ- চাটাই সংগ্রহের উপায় বলে দিতেন। জানাজা-দাফনের সময় সঙ্গে থাকতেন। দাফনের পর কবরের সুরক্ষার জন্য বাঁশের বেড়া লাগানো, তদারকি করা এসবও তিনি আঞ্জাম দিতেন।
আব্দুল খালেক মুনশি যেন ছিলেন গোরস্তানের নকিব। মৃত্যু-শোকের সহানুভূতিশীল সঙ্গী। আপনজনের মৃত্যু দুঃখে কাতর মানুষের মন খারাপ সময়ের সহযোগী।
মসজিদের সামনে, বাড়ি থেকে মসজিদে যাওয়ার পথে কিংবা কাঠগোলা বাজারে টিপ টিপ পায়ে হাঁটা আব্দুল খালেক মুনশির দিকে কিছুটা দায় ও কৃতজ্ঞতা এবং সমীহের চোখে তাকিয়ে দেখতো না, এমন মানুষ এলাকায় ছিল না, বলা যায়।
কয়েক হাজার মানুষের পরকাল যাত্রার সঙ্গী, ৯০ বছর বয়সী আব্দুল খালেক মুনশিও একদিন মারা গেলেন। সেদিন মাইকে তাঁর মৃত্যুর ঘোষণা দিলো অন্য এক জন। পুরো এলাকাটা যেন থমকে গেল।
২০০৭-এর ১ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন।
আব্দুল খালেক মুনশি কে ছিলেন? এই সময় ও সমাজে মানুষকে গণনা করার বেশ কিছু পরিমাপক আছে, পদ্ধতি আছে। ধর্মীয়ভাবেও বিশেষ শিক্ষিত ছিলেন না তিনি। দৃশ্যমান কোন জায়গা তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল না।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ওই মসজিদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জানাজার নামাজটি হয়েছে তাঁর। জেলা শহরের সবচেয়ে বড় আলেম, এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধনি ও গুণীজন থেকে নিয়ে এলাকার সবচেয়ে ‘কমদামী’ শ্রমিক ও ভিক্ষুকটিও তাঁর জানাজায় এসে হাজির হয়েছেন।
আব্দুল খালেক মুনশি রহ.। এক দরিদ্র শাহেনশাহ। কতবার কত জায়গায় দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে, কথা হয়েছে। বাহ্য চোখের জীবনে আমাদের মনে হতে চায়নি, মানবদরদী দুর্লভ এক মহীরুহের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি। ইতিহাসের কাগজে তাঁর নাম থাকবে না হয়তো। কিন্তু হাজার হাজার শোকগ্রস্ত অন্তরের শ্লেট থেকে তাঁর নাম কিছুতেই মুছে ফেলা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা এইসব দুঃখসঙ্গী, সরল, দরিদ্র ও অকিঞ্চিৎকর মানুষের জন্যই ইনশাআল্লাহ জান্নাতের দরজা খোলা রেখে দিয়েছেন।