প্রসঙ্গ করোনা ভাইরাস : জামিয়া বিন্নুরী টাউনের কয়েকটি দিকনির্দেশনা

প্রশ্ন : আজকাল যে করোনা ভাইরাস নামে একটি মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, এক্ষেত্রে আমাদের মুসলমানদের জন্য শরীয়তে কী দিক-নির্দেশনা রয়েছে? করোনা ভাইরাসসহ অন্যান্য সংক্রামক এবং মরণব্যধি থেকে মুক্তির মাসনূন দোআ বা অযীফা কী?

উত্তর : যে কোনো মহামারি এবং মরণব্যধি ছড়িয়ে যাওয়ার কারণ গুনাহের আধিক্য এবং আল্লাহ্র হুকুমের নাফরমানি। যার কারণে আল্লাহ আযাব নাযিল হয়। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
فَاَنْزَلْنَا عَلَی الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا رِجْزًا مِّنَ السَّمَآءِ بِمَا كَانُوْا یَفْسُقُوْنَ.
‘সুতরাং তারা (বনী ইসরাঈল) যে নাফরমানি করে আসছিল তার শাস্তিস্বরূপ আমি এ জালিমদের উপর আসমান থেকে শাস্তি অবতীর্ণ করলাম। (ঐ শাস্তিটি ছিল মহামারি।-বয়ানুল কুরআনের টীকা) -সূরা বাকারা (২) : ৫৯

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আমাদের দিকে অভিমুখী হয়ে বললেন, হে মুহাজিরদের দল! পাঁচটি বিপদে যখন তোমরা আক্রান্ত হবে- আমি আল্লাহ্র নিকট পানাহ চাচ্ছি, যাতে তোমরা এ বিপদগুলোতে আক্রান্ত না হও :
এক. কোনো সমাজে যখন প্রকাশ্যে অশ্লীলতা শুরু হয়, তখন তাদের মধ্যে মহামারিসহ এমন সব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, যা তাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে ছিল না।

দুই. যে সমাজ মাপে কম দেয়, তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও বাদশাহদের (শাসকদের) যুলুম-নির্যাতনে নিপতিত করা হয়।

তিন. যে সমাজ নিজেদের সম্পদের যাকাত আদায় করে না, তাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি চতুষ্পদ জন্তু না থাকত তাহলে কখনো তাদের ওপর বৃষ্টি হতো না।

চার. আর যে সমাজ আল্লাহ এবং আল্লাহ্র রসূলের সঙ্গে কৃত অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে, আল্লাহ তাআলা এমন লোকদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দেন, যারা তাদের শত্রু। এরপর তারা এদের সম্পদকে ছিনিয়ে নেয়।

পাঁচ. এমনিভাবে যখন মুসলমান শাসকরা আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী শাসন করা ছেড়ে দেয়, বরং আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত বিধানে নিজেদের পছন্দ-মাফিক কিছু বিধানকে গ্রহণ করে (আর বাকিটা বর্জন করে, তখন আল্লাহ তাআলা ঐ জাতিকে গৃহযুদ্ধ এবং) পরস্পরে বিভেদ ও অনৈক্যে লিপ্ত করে দেন।

সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪০১৯ (মূল হাদীসের পাঠ-)
عن عبد الله بن عمر، قال: أقبل علينا رسول الله – صلى الله عليه وسلم – فقال: “يا معشر المهاجرين، خمس إذا ابتليتم بهن، وأعوذ بالله أن تدركوهن: لم تظهر الفاحشة في قوم قط حتى يعلنوا بها، إلا فشا فيهم الطاعون والأوجاع التي لم تكن مضت في أسلافهم الذين مضوا. ولم ينقصوا المكيال والميزان، إلا أخذوا بالسنين وشدة المؤونة وجور السلطان عليهم. ولم يمنعوا زكاة أموالهم، إلا منعوا القطر من السماء، ولولا البهائم لم يمطروا. ولم ينقضوا عهد الله وعهد رسوله، إلا سلط الله عليهم عدوا من غيرهم، فأخذوا بعض ما في أيديهم. وما لم تحكم أئمتهم بكتاب الله ويتخيروا مما أنزل الله، إلا جعل الله بأسهم بينهم. (قال الشيخ شعيب الأرنوط : حسن لغيره)

চিন্তা করার বিষয়- আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব আমলের নির্দেশ দিয়েছেন, আজ উম্মতের মধ্যে যখন ঐ গুনাহগুলো ব্যাপক বিস্তার লাভ করছে, তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে বিভিন্ন রকম আযাব আসা শুরু হয়েছে। অতএব, এ থেকে মুক্তির উপায় হল আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া, তওবা-ইস্তেগফার করা, নিজের গুনাহের জন্য খুব অনুতাপের সঙ্গে আল্লাহর সামনে কাকুতি-মিনতি করা, আল্লাহর হক এবং বান্দার হক আদায় করা, মাদ্রাসা-মসজিদকে আবাদ করা এবং বেশি বেশি সদকা ও দান-খয়রাত করা। একজন মুসলমান হিসেবে এসব মহামারি থেকে বাঁচার জন্য বাহ্যিক উপায়-উপকরণের পাশাপাশি এ প্রকৃত কারণের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া কর্তব্য। ইবাদত-বন্দেগীতে আরো উদাসীনতার তো প্রশ্নই আসে না।
আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভয়ভীতি, আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। একে অন্যকে অভয় দেওয়া এবং সাহস যোগানো চাই। অযথা সন্দেহ-অনুমান ও দুশ্চিন্তা না করা চাই। নিছক রোগের ভয়ে ইবাদত-বন্দেগি ত্যাগ করবে না। বাহ্যিক বৈধ উপকরণ ও মাধ্যম গ্রহণ করে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে।

করোনাসহ অন্যান্য মহামারি ব্যধি থেকে মুক্তির দোআ
সকাল-সন্ধ্যা (ফজর এবং মাগরিবের পর) তিনবার করে নিন্মোক্ত দোআগুলো পাঠ করবে-
১) أعوذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق.
২) بسم الله الذى لا يضر مع اسمه شىء في الأرض ولا في السماء وهو السميع العليم.

এ আমলসমূহের প্রতি যত্মবান হলে ইনশাআল্লাহ করোনা ভাইরাসসহ সকল মহামারি, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক রোগ-ব্যধি থেকে মুক্তিলাভ হবে।
فقط والله أعلم.

দারুল ইফতা : জামিয়া উলূমে ইসলামিয়া আল্লামা মুহাম্মাদ ইউসুফ বিন্নুরী টাউন
ফতোয়া নং- ১৪৪১০৭২০০৭৫৩

প্রশ্ন : আজকাল করোনা ভাইরাসের ভয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে শরীয়তের বিধান কী জানতে চাচ্ছি।

উত্তর : এ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া ‘করোনা ভাইরাস’ নামের মহামারি এবং এ থেকে বাঁচার সতর্কতামূলক পদক্ষেপ সংক্রান্ত শরীয়তের বিধি-বিধান বুঝার সুবিধার্থে নিন্মোক্ত পয়েন্টগুলির বিশ্লেষণ সঙ্গত মনে হচ্ছে :

এক. প্রাণঘাতি মহামারি ব্যধির কারণ এবং হিকমত।

দুই. রোগ সংক্রমণের বিশ্বাস সম্পর্কে শরীয়ত নির্দেশিত সীমারেখা।

তিন. কোনো শহরে করোনা ভাইরাস (মহামারি) ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার অধিবাসীদের করণীয়

চার. মৃত্যুভয়ের ব্যাখ্যা।

এক. মহামারির কারণ এবং হিকমত

প্রাণঘাতি মহামারি বিস্তারের প্রধান কারণ আল্লাহ্র হক এবং বান্দার হক আদায়ে অবহেলা এবং আল্লাহ্র আযাবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে প্রকাশ্য গুনাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া এবং গুনাহের প্রতি দুঃসাহস। যখন কোনো জাতি প্রকাশ্যে দ্বীনী হুকুম-আহকামের প্রতি সম্মিলিত উদাসীনতায় আক্রান্ত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাদেরকে কোন এক পন্থায় ভয় দেখিয়ে নিজের দিকে মনোযোগী করেন। এ পন্থাগুলোর মধ্যে মরণব্যধির বিস্তারও অন্যতম।
তারপরও যদি কেউ এ ধরনের পরিস্থিতিতে ইসলামী বিধি-বিধানের প্রতি যত্মবান হয়, তবে তার জন্য এ আযাবও আল্লাহর রহমতে পরিণত হবে। এজন্য দুনিয়াতে কষ্ট ও বালা-মুসিবত নেককার মুমিনের উপর যেমন আসে। গুনাহগার মুমিন ও কাফেরের উপরও আপতিত হয়। কারো জন্য বিপদ ও বালা-মুসিবত মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হয়। কারো জন্য গুনাহ মাফের উসিলা হয়। আর কারো জন্য হয় আখেরাতের আযাবের পূর্বে দুনিয়ার শাস্তি। যাতে কাফের ও গুনাহগার এটা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করে এবং আল্লাহ তাআলার দিকে অভিমুখী হয়।

রোগ-বালাই রহমত হওয়ার লক্ষণ হল, রোগ-বালাইয়ের ফলে আল্লাহ তাআলার দিকে মানুষ আরো বেশি ঝুঁকবে। আমলী জীবনে সংশোধন এবং উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চলে আসবে। তবেই এটি রহমত হবে। আর যদি অভিযোগ-শেকায়েত, উদ্বেগ-অস্থিরতা এবং আল্লাহর থেকে মনোযোগ সরে গিয়ে শুধু পার্থিব উপকরণ এবং দুশ্চিন্তামুখী হয়ে যায়, তাহলে এটা পরীক্ষা বা আযাবের লক্ষণ। এ বিষয়গুলো কুরআন মাজীদের শিক্ষা, আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণিত।

দুই : রোগ সংক্রমণের বিশ্বাস  সম্পর্কে শরীয়ত নির্দেশিত সীমারেখা

প্রকাশ থাকে যে, এ পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা অগণিত বস্তুকে উপায়-উপকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমস্ত উপকরণ নিজের শক্তি প্রদর্শনে আল্লাহর হুকুমের অধীন। একারণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় এরূপ আমল করেছেন, যার দ্বারা এ বিষয় দুটি স্পষ্ট হয়ে যায়।

একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক কুষ্ঠরোগী (কুষ্ঠরোগের ব্যাপারে জনশ্রুতি রয়েছে, এটি ছোঁয়াচে।) আসলে নবীজি তার সঙ্গে বসে খাবার খান। যা দ্বারা বুঝা যায়, রোগ-ব্যধি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার বিশ্বাস সঠিক নয়। আরেকটি ঘটনায় এক কুষ্ঠরোগী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বাইআত হতে আসলে নবীজি হাত স্পর্শ না করেই তাকে বাইআত করে নেন। বরং তাকে দূর থেকেই পয়গাম পাঠিয়ে দেন যে, আমি তোমাকে বাইআত করে নিলাম। যা থেকে বুঝা যায়, সতর্কতার পর্যায়ে রোগের বাহ্যিক উপসর্গ থেকে বেঁচে থাকা জায়েয।

এ বিশ্লেষণ থেকে জানা গেল, বাহ্যিক মাধ্যম-উপকরণ হিসেবে ছড়িয়ে যাওয়া রোগ-কবলিত স্থান অথবা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরত্বে থাকা জায়েয। কিন্তু এ বিশ্বাস থাকতে পারবে না যে, এধরনের স্থানে গমন করলে অথবা অবস্থান করলে, অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে গেলে রোগ সংক্রমিত হওয়া নিশ্চিত।

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ. বলেন :
اہل مسلک ثانی نے یہ کہا کہ عدوی کی نفی سے مطلقا نفی کرنا مقصود نہیں ، کیوں کہ اس کا مشاہدہ ہے۔۔۔ مگر اہل مسلک ثانی نے اس کو خلاف ظاہر سمجھ کر یہ کہا کہ مطلق عدوی کی نفی اس سے مقصود نہیں بلکہ اس عدوی کی نفی مقصود ہے جس کے قائل اہل جاہلیت تھے اور جس کے معتقدین سائنس اب بھی قائل ہیں، یعنی بعض امراض میں خاصیت طبعی لازم ہےکہ ضرور متعدی ہوتے ہیں، تخلف کبھی ہوتا ہی نہیں، سو اس کی نفی فرمائی گیئ ہے۔۔۔ الخ
অর্থ : দ্বিতীয় মতের প্রবক্তাগণ একথা বলেছেন, ছোঁয়াচে নেই বলতে একদম নেই উদ্দেশ্য নয়। কারণ, বিষয়টি দেখা সত্য…। বরং হাদীসে রোগের ঐ সংক্রমণকে নাকচ করা উদ্দেশ্য, যা জাহেলি যুগের মানুষদের বিশ্বাস ছিল। এবং বিজ্ঞান-ভক্তরা এখনো যার প্রবক্তা। অর্থাৎ কিছু কিছু রোগের সত্তাগত অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হল, অবশ্যই সংক্রমিত হবে। এর ব্যতিক্রম কখনো ঘটবেই না। তো এ বিশ্বাসটি নাকচ করে দেয়া হয়েছে…। (-ইমদাদুল ফাতায়া ৪/২৮৭)

আর যদি কোনো অঞ্চলে কোনো মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে, যে স্থানে মহামারি রোগ ছড়িয়ে পড়বে, সেখানে যেতে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। আর যে-স্থানে লোকজন রয়েছে এবং মহামারিও ছড়িয়ে পড়েছে, ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতেও নিষেধ করেছেন। এ রেওয়ায়েত সহীহ সনদে প্রমাণিত। বুখারী শরীফে রয়েছে- (হাদীস নং- ৩৪৭৩)
>حدثنا عبد العزيز بن عبد الله قال حدثني مالك عن محمد بن المنكدر وعن أبي النضر مولى عمر بن عبيد الله عن عامر بن سعد بن أبي وقاص عن أبيه أنه سمعه يسأل أسامة بن زيد ماذا سمعت من رسول الله صلى الله عليه وسلم في الطاعون؟ فقال أسامة : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : الطاعون رجس أرسل على طائفة من بني إسرائيل أو على من كان قبلكم فإذا سمعتم به بأرض فلا تقدموا عليه وإذا وقع بأرض وأنتم بها فلا تخرجوا فرارا منه. قال أبو النضر : لا يخرجكم إلا فرارا منه. ( صحيح البخارى، باب من انتظرحتى تدفن)

একই রকম বর্ণনা বিদ্যমান আছে সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাঊদ, সুনানে তিরমিযি প্রভৃতি হাদীসের কিতাবাদীতে।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম কয়েকটি শিক্ষা উদ্ঘাটন করেছেন-

ক. যেখানে মহামারি বিস্তারলাভ করেছে, সেখানে গমন করা মহামারি বিষয়ে আল্লাহর তাআলার কুদরতের প্রতি দুঃসাহস দেখানোর নামান্তর। আর যেখানে বিদ্যমান রয়েছে, সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ তাকদীর বা ভাগ্য থেকে পলায়ন করা। যাতে কোন ফায়দা নেই। তাই এ দুই আচরণের কোনটি সঠিক নয়।

খ. উপদ্রুত এলাকায় যাওয়ার পর যদি মহামারি -মাধ্যম হওয়ার কারণে- সংক্রমিত হয়ে যায় অথবা মৃত্যু চলে আসে, তাহলে মানুষ মনে করবে- লোকটি মহামারির কারণে মারা গিয়েছে। অথচ তার মৃত্যুর সময় পূর্ব-নির্ধারিত ছিল। আর মহামারিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ঐ এলাকা থেকে বের হলে এবং তার রোগটি-সংক্রমণের মাধ্যম হওয়ার কারণে- অন্য এলাকার কাউকে আক্রান্ত করলে, প্রথম জাহেলি যুগের এ বিশ্বাস পুনরায় মানুষের মনে দানা বাঁধবে যে, রোগ-ব্যধি সত্তাগতভাবেই সংক্রমিত হয়। অথচ এসব আল্লাহ নির্দেশে ঘটে থাকে। তা-না হয় প্রথম ব্যক্তির রোগ কার থেকে সংক্রমিত হয়ে এসেছে?!

যাই হোক, এ নিষেধাজ্ঞার সারকথা হল, কেউ এ মহামারি থেকে পালাতে চাইলে সেটা নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি কোন প্রয়োজনের তাগিদে আক্রান্ত এলাকার কোন বাসিন্দাকে বাইরে যেতে হয় এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, জীবন-মৃত্যু আল্লাহ পাকের হাতে, সে যে কোন স্থানে রোগ-বালাই এবং মহামারিতে আক্রান্ত হতে পারে, তাহলে প্রয়োজনের খাতিরে সে এলাকা ত্যাগ করতে পারবে। এমনিভাবে মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যদি কারো কাজ থাকে (উদাহরণস্বরূপ, ডাক্তার, মেডিকেল টিম অথবা অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের উদ্দেশ্যে যেতে হয়) এবং আল্লাহর সত্তার উপর পূর্ণ আস্থা থাকে যে, রোগ-ব্যধি দানকারী একমাত্র আল্লাহ; তাহলে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উক্ত এলাকায় যেতে পারবে।

গ. কোনো শহরে করোনা ভাইরাস (মহামারি) ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার অধিবাসীদের উপর এর শরঈ প্রভাব।
যদি কোন শহরে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে (আল্লাহ হেফাযত করুন!) তাহলে যারা এতে আক্রান্ত হবে, তারা তো শরীয়তের দৃষ্টিতে রোগী। কিন্তু যারা করোনা ভাইরাসে নিশ্চিতরূপে আক্রান্ত হননি এবং তাদের নিজেদের ঘরে বা মহল্লায় এতটা মহামারি ছড়ায়নি- যদ্দরুন তাদের মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের আশংকা নেই; তাহলে এধরনের লোক রোগী নয়। অতএব, তাদের জন্য রোগীদের ক্ষেত্রে বর্ণিত সুযোগ ও অবকাশ নেই। বরং এ লোকেরা সুস্থ মানুষ। সুতরাং এ বিশ্লেষণ থেকে এটাও স্পষ্ট হল, যে শহরে করোনা ভাইরাস আদৌ ছাড়ায়নি; সেখানকার বাসিন্দারাও সুস্থ। রোগী নয়।

চার. মৃত্যু ভয়ের ব্যাখ্যা

শরীয়তের বিধি-বিধানে ঐ ভয় ধর্তব্য, যা প্রবল ধারণা থেকে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোন মৃগিরোগী যদি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পারে যে, রোযা রাখলে তার মৃগীর আক্রমণ হবে। তাহলে এক্ষেত্রে তার জন্য মৃগীর যন্ত্রণার আশংকায় রোযা না রাখার অনুমতি থাকবে। সাধারণত এধরনের ভয় কোনো লক্ষণ থেকে, অভিজ্ঞতার আলোকে, অথবা বিশেষজ্ঞ মুসলমান দ্বীনদার ডাক্তারের মত দ্বারা জানা যায়।
কিন্তু যে ভয় কোনো লক্ষণ, অভিজ্ঞতা অথবা দ্বীনদার অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতামত ছাড়া এমনিই অন্তরে সৃষ্টি হয়, অথবা কোনো অমুসলিমের কথা থেকে তৈরি হয়- যার সত্যায়ন মুসলমান দ্বীনদার ডাক্তার না করে, তবে এ ভয় শরীয়তে ধর্তব্য নয়। বরং এধরনের ভয় অনুমান-নির্ভরতা এবং অমঙ্গলের বিশ্বাসে আক্রান্ত করে দেয়। যা শরীয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
বাকি রইল এ প্রশ্ন যে, অভিজ্ঞ ডাক্তারদের বক্তব্য অনুযায়ী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে এ রোগের লক্ষণগুলো কয়েকদিন পর প্রকাশ পায়। তাই যে ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে সুস্থ- তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করা, মুসাফাহা ও হাত মেলানো ইত্যাদি থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা চাই। কারণ, এতে অন্যদেরও করোনাতে আক্রান্ত হবার এক রকম আশংকা থাকে।
তো এর উত্তর বুঝার পূর্বে এটা জানা থাকতে হবে যে, ডাক্তারদের মতামত শুধু মুকাল্লাফদের (শরীয়ত কর্তৃক আদিষ্টের) অবস্থাকে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে দলিল। ফিকহের বিধি-বিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দলিল নয়। উদাহরণস্বরূপ, শরীয়ত ঐ রোগীর জন্য তায়াম্মুমের সুযোগ রেখেছে, যার (স্বাস্থ্যের) পক্ষে পানি ক্ষতিকর। কোনো মুকাল্লাফ বা শরীয়ত কর্তৃক আদিষ্ট ব্যক্তির জন্য পানি ক্ষতিকর হবে কি না? এ দুটি দিক নির্ধারণে তো ডাক্তারদের মতামত ধর্তব্য হবে। যদি কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার বলে দেয়, এ ব্যক্তির জন্য পানি ব্যবহার ক্ষতিকর, তবে তার জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয হবে। কিন্তু কোনো মুকাল্লাফ সম্পর্কে ডাক্তার সুনির্দিষ্টভাবে না বলে যদি শুধু একথা বলে যে, ‘পানি ব্যবহার তার জন্য ক্ষতিকর হওয়া নিশ্চিত নয়; আশংকা আছে, তাই সে তায়াম্মুম করুক’- তো ডাক্তরের এ মতের কারণে ফিকহের বিধানে পরিবর্তন করা যাবে না।
উপরিউক্ত আলোচনার পর প্রশ্নটির উত্তর হল, যদি করোনা ভাইরাসের স্পষ্ট লক্ষণের ভিত্তিতে অথবা কোনো নির্ভরযোগ্য টেস্টের মাধ্যমে কারো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া জানা যায়, তাহলে এমন ব্যক্তি থেকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে দূরে থাকা তো জায়েয; কিন্তু যদি কোনো লক্ষণ, অভিজ্ঞতা অথবা দ্বীনদার-বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বক্তব্য দ্বারা তার রোগে আক্রান্ত হওয়ার দিক নির্দিষ্ট না হয়, তাহলে ডাক্তারের কথার কারণে ঐ ব্যক্তি থেকে সতর্ক-পদক্ষেপ গ্রহণ করা অনুমান-নির্ভরতার মধ্যে গণ্য হবে; সতর্ক-পদক্ষেপ নয়। কারণ, ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে বাহ্যিকভাবে সুস্থ ব্যক্তির সুস্থ হওয়াটা নিশ্চিত বিষয়। আর অনুমান বা সন্দেহ দ্বারা নিশ্চিত বিষয় বাতিল হয় না।

পাঁচ. জামাতের সঙ্গে মসজিদে নামায পড়তে না পারার ওযর
শরীয়তে মসজিদে জামাতের সঙ্গে নামায পড়তে না পারার একটি ওযর এটাও যে, মানুষের এমন অবস্থা হওয়া- যার কারণে অন্য মানুষ অথবা ফেরেশতাদের কষ্ট হয়। এজন্যই যে ব্যক্তি নামাযের পূর্বে দুর্গন্ধযুক্ত জিনিস খায়, তার জন্য মসজিদে যাওয়া উচিত নয়। ফুকাহায়ে কেরাম ঐ রোগীকেও এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যার প্রতি মানুষের স্বভাবজাত ঘৃণা হয়, যেমন কুষ্ঠরোগী। এ বিশ্লেষণের আলোকে করোনা ভাইরাস-আক্রান্ত রোগীরও মসজিদে যাওয়া উচিত নয়। মসজিদে নামায না পড়ার ব্যাপারে তাকে অপারগ ধরা হবে।
‘কেফায়াতুল মুফতী’তে আছে
… ان صورتوں میں خود مجذوم پر لازم ہے کہ وہ مسجد میں نہ جائے اور جماعت میں شرکت نہ ہو اور اگر وہ نہ مانے تو لوگوں کو حق ہے کہ وہ اسے دخول مسجد اور شرکت جماعت سے روک دیں اور اس میں مسجد محلہ اورمسجدغیر محلہ میں فرق نہیں ہے، محلہ کی مسجد سے بھی روکا جاسکتا ہے تو غیر محلہ کی مسجد سے بالاولی روکنا جائز ہے
অর্থ : এধরনের পরিস্থিতিতে স্বয়ং কুষ্ঠরোগীর জন্য আবশ্যক হল, সে মসজিদে যাবে না এবং জামাতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। যদি এ নির্দেশনা সে অমান্য করে, তবে মানুষের অধিকার রয়েছে তাকে মসজিদে প্রবেশে এবং জামাতে শরীক হতে বাধা দেবে। এক্ষেত্রে মহল্লার মসজিদ ও মহল্লার বাইরের মসজিদে কোন পার্থক্য নেই। মহল্লার মসজিদে যখন বাধা দিতে পারবে তখন অন্য মসজিদ থেকে তো অবশ্যই বাধা দেওয়া বৈধ। (৩/১৩৮, দারুল ইশাআত প্রকাশিত)

এরপরও যে মহল্লায় করোনা ভাইরাসের মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করেনি, সেখানে করোনার ভয়ে জামাতে নামায ছেড়ে দেওয়া শরঈ অপারগতা নয়। বরং অনুমান-নির্ভরতা, যা নিষিদ্ধ।
আর যে মহল্লায় করোনা ভাইরাসের মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, সেখানকার মহল্লাবাসীদের জন্য মসজিদে নামায না পড়ার অবকাশ তো থাকবে, কিন্তু ঐ মহল্লার কিছু লোককে তারপরও মসজিদে জামাতের সঙ্গে নিয়মিত নামায পড়তে হবে। আর যদি মসজিদে জমাতে নামায পুরো মহল্লাবাসী ছেড়ে দেয়, তাহলে পুরো মহল্লার সকলে গুনাহগার হবে। কারণ, মসজিদকে তার আমল দ্বারা আবাদ রাখা ফরযে কিফায়া।

ফতোয়া নং- ১৪৪১০৭২০০৬৯৬
দারুল ইফতা : জামিয়া উলূমে ইসলামিয়া আল্লামা বিন্নুরী টাউন

ভাষান্তর : মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
ঈষৎ পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত

 

 

পূর্ববর্তি সংবাদকরোনা: বিশ্ব কাঁপানো মার্কিন রণতরী থেকে বাঁচার আকুতি
পরবর্তি সংবাদনেতানিয়াহুর উপদেষ্টার পর এবার করোনায় আক্রান্ত হলেন ইসরায়েলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার স্ত্রী