করোনাভাইরাসের যুগে বিশ্বাসের ভারসাম্য

ড. আলী আস-সাল্লাবী ।।

অনুবাদ: শামসুল হক সিদ্দিক ।।


ভাগ্যে বিশ্বাস শরীয়ত অনুমোদিত কারণ-মাধ্যম অবলম্বনকে নিষেধ করে না। বরং কারণ-মাধ্যমগুলোও কার্য বা ফলাফলের মতোই নির্ধারিত। কজেই যদি কেউ ভাবে, আল্লাহ তাআলা কেবল ফলাফল নির্ধারিত করে রেখেছেন, ওই ফলাফলের কারণ-মাধ্যমগুলো নির্ধারণ করেননি, তবে ভাগ্যের মর্ম সম্পর্কে সে অজ্ঞতায় নিপতিত। আল্লাহর ওপর সে মিথ্যা আরোপ করছে; কেননা কারণ-মধ্যমগুলোও ফলাফলের মতোই নির্ধারিত। ‘চিকিৎসা কি ভাগ্য ফিরিয়ে দিতে পারে? রাসূলুল্লাহ (স.) কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, চিকিৎসাও আল্লাহ- নির্ধারিত ভাগ্যের অংশ। রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবিদের জীবন কারণ-মাধ্যম অবলম্পনের ধারায় পরিচালিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. এর জীবনচরিত কারণ-মাধ্যম, পথ ও পদ্ধতি অবলম্বনের প্রকৃষ্ট সাক্ষী।

বর্তমানে আমরা সবাই করোনাভাইরাস নামক মহামারী নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই মহামারীটি আল্লাহ তাআলাই নির্ধারিত করে রেখেছেন। আবার এ থেকে পরিত্রাণের জন্য কারণ-মাধ্যমগুলোও আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত যা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক। সকল মানুষের শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ সা. ছিলেন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলকারীদের ইমাম। তিনি কারণ-মাধ্যম অবলম্বন করতেন। তিনি যেসব যুদ্ধ করেছেন তা কারণ-মাধ্যম অবলম্বনের সর্বোচ্চ ইচ্ছার প্রমানবহ। আর এ কারণ-মাধ্যমগুলো আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্ধারণের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। রাসূলুল্লাহ সা. সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। সৈন প্রস্তুত করেছেন। খোঁজখবর নিতে অগ্রদূত পাঠিয়েছেন। সুরক্ষার বর্ম পরিধান করেছেন। মাথায় হেলমেট পরেছেন। গিরি পথের মুখে তিরান্দাজদের বসিয়েছেন। মদীনার সীমান্তে পরিখা খনন করে মদীনাকে সুরক্ষিত করেছেন। আবি সিনিয়ায় হিজরত করে যেতে বলেছেন। মদীনায় হিজরত করে যেতে বলেছেন। নিজেও হিজরত করেছেন। হিজরতের পথে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। বাহন প্রস্তুত করেছেন। পথ দেখানোর জন্য গাইড নিয়োগ দিয়েছেন। জাবালে ছাওরের গুহায় আত্বগোপন করে থেকেছেন। জিহাদ অথবা উমরার সফরে বের হলে রসদ সঙ্গে নিয়েছেন। অথচ তিনি ছিলেন তাওয়াক্কুলকারীদের সরদার।

তাওয়াক্কুল ও কারণ-মাধ্যম সাংঘর্ষিক নয়

যারা বলেন তাওয়াক্কুল ও কারণ-মাধ্যম অবলম্বন বিপরীতমূখী দুই জিনিষ, তারা অজ্ঞতার ফলেই এরূপ বলেন। আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি ও নির্দেশ বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই তারা এমনটি বলেন; কারণ আল্লাহ এই মহাজগতের সকল সৃষ্টি কার্যকারণ উপাদান সন্নিবিষ্ট করেই সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষের জন্য কারণ-মাধ্যম নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যার দ্বারা তারা আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ পাবে। অতএব যারা মনে করবে, আল্লাহর নির্ধারিত কারণ-মাধ্যম ছাড়া কেবল তাওয়াক্কুলের মাধ্যমেই নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে সফল হবে, তারা ভুলের মধ্যে আছে।

তাওয়াক্কুল এবং কারণ-মাধ্যম অবলম্বনে ভারসাম্য রক্ষা করা

এ বিষয়ে মূল কথা হলো, আল্লাহ তাআলা যেসব কারণ-মাধ্যমের কথা বলেছেন, এবং যেগুলো ব্যবহারের অনুমতি তিনি দিয়েছেন, সেগুলো মানুষ ব্যবহার করবে। তবে তার বিশ্বাস থাকবে যে, আল্লাহ তাআলাই এই কারণ-মাধ্যমগুলো সৃষ্টি করেছেন। আর এ কারণ-মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে যে ফলাফল বা উপকারিতা আসে তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মের মাধ্যমেই আসে। তবে আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে ওই ফলাফলকে স্থগিত করে দিতে পারেন। আর তখন কারণ-মাধ্যম অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকবে। অতএব আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কারণ-মাধ্যম অবলম্বনের পর যাতে নির্ধারিত ফলাফলটি আসে, এটাই হলো মূলত আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের জায়গা।

আলেমগণ তাওয়াক্কুল ও কারণ-মাধ্যম অবলম্বনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির ব্যাপারে যা বলেছেন তা ঘেঁটে দেখলে আমরা পাই যে, তাদের অধিকাংশই বলেছেন, তাওয়াক্কুল লাভের জন্য আল্লাহ ওয়াদায় মুমিনের আস্থা থাকতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহর সিদ্ধান্ত আবশ্যিকভাবে ফলিত হবে। তবে রিজিক অন্বেষণে আল্লাহর দেয়া নিয়ম-পন্থা অবলম্বন করতে হবে। শত্রু থেকে সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখতে হবে, দরোজা লাগিয়ে রাখতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু এসব প্রস্ততি সত্ত্বেও কার্যকারণের ওপর তার অন্তর তৃপ্ত থাকবে না, বরং সে বিশ্বাস করবে, এগুলো নিজ থেকে কোনো উপকার অথবা ক্ষতি করতে পারে না। বরং আল্লাহর ক্রিয়াই হলো কার্য ও কারণ। সবকিছুই তার ইচ্ছাতেই ঘটে। কাজেই যদি কারণ-মাধ্যমের ওপর ভরসা চলে আসে, সেটাই হবে তাওয়াক্কুলের জন্য ক্ষতিকর।

কার্যে কারণের প্রভাব

কিছু কারণ-মাধ্যম এমন যা সবাই প্রকৃতিগতভাবেই বুঝতে পারে। যেমন স্বামী-স্ত্রীর মিলন সন্তানলাভের কারণ। জমিনে বীজ বোনা ফসল উৎপন্নের কারণ। খাদ্যগ্রহণ পরিতৃপ্তির কারণ। পানি পান তৃষ্ণা মেটানোর কারণ।

আর কিছু কারণ এমন আছে যা নিয়ে কেউ- কেউ বিতর্ক করতে পারে। অর্থাৎ সবার কাছে তা সমানভাবে পরিষ্কার না। যেমন আল্লাহর দেয়া দীন ও শরীয়ত অবলম্বন করে চলা দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্য লাভের কারণ। আর যারা এর উল্টো চলবে তাদের ভাগে আছে দুনিয়া ও আখিরাতের অকল্যাণ। দোওয়া-প্রার্থনা কষ্টযাতনা দূর করা এবং কাম্য বস্ত পাওয়ার মাধ্যম, এ বিষয়টি নিয়েও মানুষ বিতর্ক করতে পারে।

কিছু কারণ-মাধ্যম এমন আছে যেগুলো অধিকাংশ মানুষের কাছে অস্পষ্ট। যেমন সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের পশ্চাৎগত কারণসমূহ। বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতন, সম্মান-অসম্মান, প্রাগ্রসরতা, পশ্চাদপদতা, স্বচ্ছলতা ও অভাব, জয়-পরাজয় ইত্যাদি। এ সব বিষয়ের পেছনেও সুনির্ষ্টি কারণমালা আছে যা এই ফলাফলগুলো বয়ে আনে। এই ফলাফলগুলো তাদের কারণসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। ঠিক প্রাকৃতিক বিষয়গুলোর মতোই। যেমন পানির জমাট বাঁধা, অথবা বাষ্পীভূত হওয়া। বৃষ্টিপাত ঘটা। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত এসব বিষয়ের কারণসমূহ পাওয়া গেলে, এর ফলাফলগুলোও অবশ্যই সংঘটিত হবে। তবে প্রাকৃতিক ঘটনা ও সামাজিক ঘটনার মধ্যে পার্থক্য শুধু এইটুকু, প্রাকৃতিক ঘটনার কারণগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নিরীক্ষণযোগ্য। আর সামাজিক ঘটনার কারণ বহু, মিশ্র, এবং এর ফলাফলসমূহ কখন সামনে আসে তা নিশ্চিতভাবে বলা দুষ্কর, যদিও ওই ফলাফলগুলো যে ঘটবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

এই কার্যকারণ নীতির ব্যাপারে কোরআন-হাদিসের বহু টেক্সট আছে। যার খোলাসা হলো, আল্লাহ তাআলা যা নির্ধারণ কর রেখেছেন, যাকিছুর ফয়সালা তিনি করে রেখেছেন, তা কারণ-মাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত করেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। অতএব যে ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফল অর্জন করতে চায়, তাকে ওই ফলাফল পর্যন্ত যওয়ার যে কারণ-মাধ্যম আছে তা অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে।

কার্যকারণ নীতি অস্বীকার করা বিজ্ঞানের সকল বাস্তবতাকে অস্বীকার করার নামান্তর

পবিত্র কোরআন থেকে আমরা প্রমাণ পাই, শরয়তীবিধানমালার কারণগুলোও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট হুকুম আসার সূত্র। অতএব সকল বিষয়, হোক তা শরীয়তসংলগ্ন, অথবা মহাজাগতিক, সবই কারণের সাথে বাঁধা। কাজেই কারণ-মাধ্যম ব্যতীত কোনো জিনিষ অর্জন করতে যাওয়া ন্যাক্কারজনক বিষয়। কেননা কারণগুলোকে অস্বীকার করার অর্থই বিজ্ঞানের সকল বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।

কারণগুলো যে কারণ তা অস্বীকার করা নির্বুদ্ধিতার আলামত। এরূপ যে করে সে শরীয়তকেও আঘাত করে; কেননা কারণ-মাধ্যম ব্যবহারের কথা স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই বলেছেন। বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে মৃত জমিন পুনরায় জীবিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহ তাআলা আকশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যার মাধ্যমে তিনি মৃত জমিনকে পুনরায় জীবিত করেন। (আল বাকারা: ১৬৪)। আল্লাহ তাআলা যে কারণ ও মাধ্যমে কাউকে সত্যের পথ দেখান তাও তিনি বলে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে,‘ এর মাধ্যমে তিনি যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন’ (আল মায়েদা:১৬)।

অতএব মুমিন কারণ-মাধ্যম অবলম্বন করে; কেননা আল্লাহ তাআলাই তাকে কারণ-মাধ্যম অবলম্বন করার আদেশ দিয়েছেন। আর আল্লাহ তাআলাই ওই কারণ-মাধ্যমগুলোর যে ফলাফল বয়ে আনে তা নির্ধারণ করে দিয়েছন। উপরুন্ত আল্লাহর রহমত, ইনসাফ, হিকমত ও ইলমের প্রতি তৃপ্তহৃদয় থাকাই হলো সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। শয়তানের কুক্রমন্ত্রণা থেকে বাঁচার উপায়।

সাহাবিগণ বিষয়টি ভালো করে বুঝতেন। তারা জানতেন, ভাগ্যের প্রতি ইমানের অর্থ কারণ-মাধ্যমকে ছেড়ে দেয়া নয়। এ কারণে খলিফা ওমর (রাযি.) ভাগ্যে বিশ্বাসের অর্থ কারণ-মাধ্যম অবলম্বন না করা বিষয়ক আবু উবায়দাহ (রাযি.) এর যে ধারণা ছিল তা খণ্ডন করে দেন। প্রসিদ্ধ আমাওয়াস প্লেগের সময় ওমর (রাযি.) যখন সিরিয়ার উপকূল থেকে ফিরে যেতে চাইলেন, আবু উবায়দা রাযি. বললেন, ‘আল্লাহ- কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য থেকে আপনি কি পালিয়ে যাবেন? এই প্রশ্ন শোনে হযরত ওমর আশ্চর্য হলেন। আবু উবায়দা (রাযি.) কে বললেন,‘তুমি আমাকে এ প্রশ্নটা করলে?,’ হ্যাঁ, একভাগ্য থেকে অন্য ভাগ্যে পালাচ্ছি। তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন,‘ ধরো, তুমি উটের পাল নিয়ে একটি উপত্যকায় গেলে। ওই উপত্যকার আছে দুটি অংশ। একটি উর্বর, যেখানে আছে ঘাস। অপরটি বিরান ভূমি। তুমি যদি উর্বর অংশে উট চরাও সেটাতেও আল্লাহ-নির্ধারিত কার্যকারণ (কাদর) অনুসারিত হবে। আর যদি বিরান ভূমিতে চরাও সেটাতেও আল্লাহ-নির্ধারিত কার্যকারণ অনুসারিত হবে।

অতএব হযরত ওমর (রাযি.) ও হযরত আবু উবায়দা (রাযি.) উভয়েই জানতেন, ভাগ্য হলো যা ঘটবে সে বিষয়ে আল্লাহর পূর্বজ্ঞান। তবে হযরত ওমর (রাযি.) মনে করতেন, কারণ-মাধ্যমকে ফলাফলের সাথে যুক্ত করার ক্ষেত্রে ভাগ্যের কোনো দখল নেই। কাজেই প্লেগ থাকা সত্ত্বেও সিরিয়ায় প্রবেশ করা হবে মৃত্যুর কারণ। আর সিরিয়া থেকে ফিরে যাওয়া হবে প্লেগ থেকে বেঁচে যাওয়ার কারণ। এ জন্যই হযরত আবু উবায়দার প্রশ্নে আশ্চর্য হয়ে তিনি বলেছেন, ‘তুমি আমাকে এ প্রশ্নটি করলে?’ শুধু তাই নয়, বরং তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, বললেন সিরিয়াতে যাওয়াও আল্লাহ- নির্ধারিত ভাগ্য। আবার মদীনায় ফিরে যাওয়াও আল্লাহ- নির্ধারিত ভাগ্য। অর্থাৎ উভয়টাই আল্লাহর কাছে জানা। কাজেই কোনো কাজ করা বা না করার পূর্বে ভাগ্যকে বিবেচনায় আনা যাবে না। কাজকে ভাগ্যের সাথে যুক্ত করা যাবে না। ভাগ্যের অজুহাতে কারণ-মাধ্যম অবলম্বন ছেড়ে দেয়া শুদ্ধ হবে না। অতএব ভাগ্যের ওপর ভরসা করে বর্তমান সময়ের মহামারী করোনাভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার কারণ-মাধ্যমগুলো ব্যবহার না করা কিছুতেই শুদ্ধ হবে না।

পূর্ববর্তি সংবাদযুবরাজের পর এবার করোনায় আক্রান্ত হলেন ব্রিটেনের রানিও
পরবর্তি সংবাদকরোনা উপসর্গ নিয়ে বগুড়ায় একজনের মৃত্যু