সন্তানের পরিচর্যায় যেসব নারী ইবাদতের সময় কম পান তাদের জন্য কিছু পরামর্শ

প্রশ্ন: আমাদের ৫ সন্তান। তন্মধ্যে দুইজন ছোট। তাদের নার্সিং করতে গিয়ে আমার স্ত্রী প্রায়ই কুরআনের তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, নফল নামায ইত্যাদি ইবাদত করতে পারে না। এই বিষয়ে তার খুব মন খারাপ থাকে। আমি তাকে বলেছি, তুমি সন্তানাদি নার্সিং করার কারণে নফল ইবাদতের সওয়াব পাবে। এ ব্যাপারে আমার স্ত্রীর সান্তনার জন্য কুরআন-হাদীসের আলোকে কিছু বললে উপকৃত হব।

উত্তর: শিশু সন্তানের পরিচর্যা ও প্রতিপালন, তাদের সঠিক তালীম-তরবিয়ত করা পিতামাতার দায়িত্ব। বিশেষত আয়-উপার্জন এবং সাংসারিক তাকিদে পিতার অধিকাংশ সময় বাহিরে অবস্থানের কারণে মায়ের ভূমিকা এক্ষেত্রে বেশি। এ দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক তার প্রতি অর্পিত। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

كُلّكُمْ رَاعٍ وَكُلّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيّتِهِ، وَالأَمِيرُ رَاعٍ، وَالرّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ، فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيّتِهِ.

তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে নিজ অধীনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।… পুরুষ তার পরিবারের উপর দায়িত্বশীল। স্ত্রী স্বামীর ঘর ও সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল। তোমরা সকলে দায়িত্বশীল। সকলে নিজ অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২০০)

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-

ورعاية الرجل أهله سياسته لأمرهم وإيصالهم حقوقهم ورعاية المرأة تدبير أمر البيت والأولاد والخدم والنصيحة للزوج في كل ذلك.

পুরুষের দায়িত্ব হল পরিবারকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা এবং তাদের হক আদায় করা। আর স্ত্রীর দায়িত্ব হল, ঘরের কাজকর্ম আঞ্জাম দেয়া, সন্তান পরিচর্যা করা, সেবক-সেবিকাদের পরিচালনা করা এবং সকল বিষয়ে স্বামীর মঙ্গল কামনা করা। (ফাতহুল বারী ১৩/১১৩)

শরীয়ত কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালনের দ্বারা সন্তানের মা অবশ্যই বড় সওয়াবের অধিকারী হবেন। এসব কাজে মা যতক্ষণ ব্যস্ত থাকেন পুরো সময়ই নেকী ও সওয়াবের মধ্যে কাটে। হাদীস শরীফে উত্তম নারীর বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

خَيْرُ نِسَاءٍ رَكِبْنَ الإِبِلَ صَالِحُ نِسَاءِ قُرَيْشٍ، أَحْنَاهُ عَلَى وَلَدٍ فِي صِغَرِهِ، وَأَرْعَاهُ عَلَى زَوْجٍ فِي ذَاتِ يَدِهِ.

আরবের নারীদের মধ্যে উত্তম নারী হল কুরাইশের নারী। তারা সন্তানের প্রতি অধিক স্নেহপরায়ণ এবং স্বামীর সম্পদ হেফাযতের প্রতি অধিক যত্নশীল। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৮২)

সহীহ মুসলিমে হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন-

جَاءَتْنِي مِسْكِينَةٌ تَحْمِلُ ابْنَتَيْنِ لَهَا، فَأَطْعَمْتُهَا ثَلَاثَ تَمَرَاتٍ، فَأَعْطَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا تَمْرَةً، وَرَفَعَتْ إِلَى فِيهَا تَمْرَةً لِتَأْكُلَهَا، فَاسْتَطْعَمَتْهَا ابْنَتَاهَا، فَشَقّتِ التّمْرَةَ، الّتِي كَانَتْ تُرِيدُ أَنْ تَأْكُلَهَا بَيْنَهُمَا، فَأَعْجَبَنِي شَأْنُهَا، فَذَكَرْتُ الّذِي صَنَعَتْ لِرَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَقَالَ: إِنّ اللهَ قَدْ أَوْجَبَ لَهَا بِهَا الْجَنّةَ، أَوْ أَعْتَقَهَا بِهَا مِنَ النّارِ.

এক দরিদ্র মহিলা তার দুটি সন্তান নিয়ে আমার নিকট আসল। আমি তাকে তিনটি খেজুর দিলাম সে তাদের দুজনের প্রত্যেককে একটি করে খেজুর দিল আর একটি খেজুর সে নিজে খাওয়ার জন্য মুখের কাছে নিল তখন তার দুই মেয়ে তার কাছে আরো চাইল। সে তার খেজুরটি দুইজনের মাঝে ভাগ করে দিল। তার এ বিষয়টি আমাকে অনেক মুগ্ধ করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ঘটনাটি বললে তিনি বললেন আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দিয়েছেন। অথবা তিনি বলেছেন এর বিনিময়ে আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩০)

আবু উমামাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক মহিলা তার দুটি সন্তানসহ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসে। সে একটি সন্তানকে কোলে এবং অপরটিকে হাতে ধরে নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

حَامِلَاتٌ، وَالِدَاتٌ، رَحِيمَاتٌ، لَوْلَا مَا يَأْتِينَ إِلَى أَزْوَاجِهِنّ، دَخَلَ مُصَلِّيَاتُهُنّ الْجَنّةَ.

গর্ভধারিনী, সন্তান জন্মদানকারিণী এবং সন্তানের প্রতি মমতাময়ী তারা যদি স্বামীদের কষ্ট না দেয় তবে তাদের মধ্যে যারা নামাযী তারা জান্নাতে যাবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২০১৩)

অনুরূপ বর্ণনা জামে মা‘মার ইবনে রাশিদে নির্ভরযোগ্য মুরসালসূত্রে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস নং ২০৬০২

সুতরাং আপনার স্ত্রীর সন্তান পরিচর্যা ও প্রতিপালন এবং তাদের সেবা করার গুণটি উত্তম গুণ। এর পেছনে তিনি যে সময় ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন এতে তিনি বড় সওয়াবের অধিকারী হচ্ছেন। এর পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, যিকর-আযকারের প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং তা না করতে পারার আক্ষেপ খুবই প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে তার করণীয় হবে, দৈনন্দিনের ফরয ওয়াজিব এবং সুন্নাতে মুআক্কাদা নামাযসমুহ আদায় এবং সাংসারিক ব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে যদি উক্ত নফল ইবাদত-বন্দেগী কিছু করা সম্ভব হয় তাহলে করবে আর সময় সুযোগ না থাকলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বরং সন্তান লালন পালনের জন্য তিনি সওয়াব পেতে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।

প্রকাশ থাকে যে, সন্তানের পরিচর্যা প্রতিপালন এবং ঘর সংসারের কাজ সাধারণত মহিলাদের কাজ হলেও পুরুষ যখন ঘরে অবস্থান করবে সময় সুযোগমত তাদের কাজে সহযোগিতা করা উচিত। বিশেষত নিজের ব্যক্তিগত কাজ তো নিজেরই করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে অবস্থানকালে গৃহস্থালীর বিভিন্ন কাজকর্ম নিজে করতেন। যেমন একটি হাদীসে এসেছে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে কী কাজ করতেন? তিনি বললেন-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَخْصِفُ نَعْلَهُ، وَيَخِيطُ ثَوْبَهُ، وَيَعْمَلُ فِي بَيْتِهِ كَمَا يَعْمَلُ أَحَدُكُمْ فِي بَيْتِهِ.

তিনি নিজ কাপড় সেলাই করতেন, জুতা সেলাই করতেন, ঘরের কাজকর্ম করতেন যেমন তোমরা ঘরের কাজকর্ম করে থাক। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫৩৪১)

পূর্ববর্তি সংবাদকরোনা প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে মাওলানা তারেক জামিলের কাছে ইমরান খানের দোয়া প্রার্থনা
পরবর্তি সংবাদরাজবাড়ীতে ঘুমন্ত ইমামকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখম