সরেজমিন: কোথায় যাবে ঘর পোড়া রূপনগরের হাজার হাজার বস্তিবাসী?

তারিক মুজিব ।।

সকালে নেটে ঢুকে দেখলাম আবারও মিরপুরের কোনো বস্তিতে আগুন লেগেছে। আমাদের অফিসের কাছের বস্তিটিতে আগুন লেগেছে কি না ভেবে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে উঠি। খোঁজ নিয়ে দেখি, আগুন লেগেছে রূপনগরের আবাসিক মোড়ের দিকের একটি বস্তিতে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২০ টি ইউনিট কাজ করছে শুনে বুঝলাম ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ হবে। লোকমুখে শোনা যায়, বস্তিতে বড় ধরনের আগুন লাগা মানে, প্রকারান্তরে উচ্ছেদ অভিযান চলা। মনটা ব্যথিত হয়ে উঠল। এতগুলো লোক যাবে কোথায়?

আবাসিক মহল্লার ফাঁকে ফাঁকে মিরপুরে বস্তির সংখ্যা কম নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদী ভাঙ্গন, বন্যা, ঝড়ে ঘরবাড়ি হারানো বিপন্ন মানুষগুলোর প্রধান আশ্রয় ছিল মিরপুরের বস্তি। কিন্তু উদ্বাস্তু এসব মানুষের বস্তি জীবনও আগুন এবং উচ্ছেদ অভিযানের কবলে বরাবরই অনিশ্চিত।

গত এক বছরে দেখেছি, কয়েকমাসের ব্যবধানে চলন্তিকা বস্তিতে দুইবার আগুন, বাওনিয়াবাদ এবং আজকের রূপনগর আবাসিক মোড় বস্তিতে ভয়াবহ রকমের অগ্নিকাণ্ড। মাস দুয়েক আগে দেখি, তীব্র শৈত্য প্রবাহের সময় এক রাতেই বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দুয়ারীপাড়া বিস্তীর্ণ বস্তি।

আগুন এবং উচ্ছেদ অভিযান বস্তিবাসীর জীবনে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।

বিকেলে গেলাম দেখতে ভস্মিভূত বস্তিটির এখন কী হালচাল। আবাসিক মোড় পেরোতেই দেখি, ফুটপাতে একটু পর পর ছোট ছোট জটলা। সাথে চাদরে প্যাঁচানো পুটলা। উল্টো দিকের রাস্তায় কয়েকটি ভ্যান দেখলাম পুটলা সমেত এগিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, দুই কিমি দূরের কালশীর দিকে যাচ্ছে তারা। নতুন কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে।

গলি পেরিয়ে সামনে যেতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবকমতো একজন বাধা দিতে চাইলেন। আমাদের সংবাদমাধ্যমের সূত্র ব্যবহার করে পরিচয় দিলে তিনিই আগ বাড়িয়ে পুড়ে যাওয়া ঘরদোর দেখাতে লাগলেন। জং ধরা টিন পুড়ে ছাই হয়ে আছে। আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের ২০ টি ইউনিটের তিন ঘন্টা সময় লাগাতেই বোঝা গিয়েছিল, পরিস্থিতি কতদূর ভয়াবহ। এ আগুনে ২০০ ঘর পুড়ে গেছে বলে একাধিক লোকের সাথে কথা বলে জানা গেলো।

পায়ে লোহা লক্কর বিঁধার ভয়ে আমি খুব বেশিদূর এগুলাম না।

স্বেচ্ছাসেবক লোকটির নাম কাসেম। তিনি এ বস্তিরই বাসিন্দা। ‘কতদিন ধরে আছেন বস্তিতে’ জানতে চাইলে সরল উত্তর দিলেন,-ম্যালা দিন। বরিশাল থেকে নদী ভাঙনের কারণে সর্বস্বান্ত হয়ে ঢাকায় এসেছেন ২০০০ সালের দিকে। রিকশা চালান।

আগুন কীভাবে লাগল? কথাটা শুনে কিছুটা ক্ষেপে গেলেন যেন কাসেম। ‘বস্তিতে আগুন লাগার কোনো কারণ থাকে না’। কিছুটা ঝাঁঝাঁলো তার উত্তর।

এক মহিলাকে বিলাপ করতে শুনলাম- ‘আমার সব শেষ, আমার সব শেষ।’ আগুন লেগেছিল সকালে। মনে হল, মহিলাটি তখন থেকেই বিলাপ জারি রেখেছে।

ছোট ছোট কয়েকটি বাচ্চাকে দেখলাম আগত দর্শনার্থীদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে। ব্যাপারটি খারাপ লাগলো খুব। একটি শিশুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের কী কী পুড়েছে? সুমন নামের ছেলেটি জানালো, বাবা রিকশা চালায়, মা ১২ নাম্বার গার্মেন্টসে কাজ করে। আগুন লাগার সময় ঘরে কেউ ছিল না। সব পুড়ে গেছে।

একটি জটলার কাছে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম, এখন কোথায় যাবে তারা? তবে সংকোচের কারণে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। এটার উত্তর তো আসলে তারাও জানে না। নতুন কোনো বস্তিতে হয়তো ঘড় ভাড়া নিবে। এরপর সেখানেও আগুন লাগবে। তারপর অন্য কোথাও যাবে। তাদের তো এমনই ভাসমান জীবন।

কয়েক জায়গায় দেখলাম, বড় বড় ডেগে রান্না হচ্ছে। হয়তো আজকের রাতটি যারা এখানেই খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে দিবে তাদের খাবারের সামান্য আয়োজন।

পাশের একটি মাদরাসার কয়েকজন ছাত্র জানালেন, সকালে তারা বস্তির মানুষদের জিনিসপত্র বের করার কাজে সহযোগিতা করেছেন।

বস্তিতে আগুন লাগা নৈমিত্তিক ঘটনা। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য দেখলাম, তিনি বস্তিতে আগুন লাগার পেছনে প্রভাবশালী মহল জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন। কে জড়িত, কে জড়িত না তা দেখা প্রশাসনের দায়িত্ব। দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় গিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক কাঁদা ছুড়াছুড়ি ক্ষতিগ্রস্থদের নিয়ে উপহাস মনে হয় আমার কাছে।

দুইদিন আগে সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল, মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না। আমরা দেখার প্রতীক্ষায় আছি, রূপনগরের বস্তিবাসীর কোথায় হয় আশ্রয়, কোথায় হয় ঠিকানা।

পূর্ববর্তি সংবাদরূপনগরের অগ্নিকান্ডে প্রভাবশালী মহল জড়িত : মির্জা ফখরুল
পরবর্তি সংবাদ২৫ মার্চ ১ মিনিটের জন্য অন্ধকার থাকবে দেশ