একটি রুটির আত্মকথা

উম্মে হাবীবা তামান্না ।।

‘একদিন ছোট্ট একটি মেয়ে খাওয়ার জন্য (আমার একটি টুকরো) এক টুকরো রুটি হাতে নিল। তখন আমি (রুটির টুকরোটি) বলে উঠলাম, একটু পরে খাও হে মেয়ে! তুমি তো এখন বেশি ক্ষুধার্ত নও। কারণ একটু আগে আমার জাতভাইদেরকে খেয়েছ। সুতরাং আমাকে একটু পরে খাও। ততক্ষণে আমি তোমাকে আমার কাহিনী শোনাই। আমার কাহিনী অনেক আশ্চর্যজনক এবং মজাদার।

মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সে সাথে সাথেই বলল, হাঁ হাঁ বল তোমার কাহিনী।

আমি তখন বললাম, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় আমি এমনি এমনিই তৈরি হয়ে তোমার হাতে এসে পৌঁছে গেছি। তুমি কি কখনো শুনেছো যে, রুটি ক্ষেতে জন্মে অথবা আসমান থেকে নামে। তুমি তো খাও কত আরামে। তোমার কাছে খাবার আসে কত সহজে। আর আমি কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করতে থাকি তোমার জন্য। এক মুসিবত থেকে আরেক মুসিবতে, এক কয়েদখানা থেকে আরেক কয়েদখানায়, শুধু তোমার জন্য। এরপর একসময় পৌঁছি তোমার হাতে।

আমার কাহিনী শুনতে চাও! তাহলে শোন।

আমি ছিলাম একটি গমের দানা। আমার জাতভাইদের সাথে একটি বস্তায় ছিলাম। বস্তায় ক’দিন থাকার পর একজন লোক এল এবং আমাকে আমার সাথীদের সাথে নিয়ে গেল। তারপর আমাদেরকে যমীনে বুনল। সেই ক্ষেতের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে তখন আমি দুনিয়া দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার নিকট সূর্যের আলো পৌঁছত। বাতাস লাগত আমার গায়ে। কয়টা দিন খুব আনন্দে ছিলাম আমি। কিন্তু হঠাৎ একদিন বৃষ্টি নামল। আর আমি মাটির ভেতর ঢুকে গেলাম। তারপর অনেকদিন এমন অবস্থায় ছিলাম। আমার দেহ বড় হতে লাগল। সাথে সাথে আমার চামড়াও  ফেটে যেতে লাগল। একসময় চামড়া ফেটে গেল এবং তা থেকে কিছু শিকড় বের হল। তারপর কিছু ছোট ছোট পাতা মাটি বিদীর্ণ করে বের হল। সেগুলো যমীনের উপর প্রকাশ পেল। কয়েকদিনের মধ্যে আমি কাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি শীষ হয়ে গেলাম। তারপর সূর্যের তাপে সেটা হলুদ হল।

আমি মাটির উপর দাঁড়িয়ে থেকে আমার বন্ধুদেরকে দেখতাম, তাদের সাথে কথা বলতাম, বাতাসে দোল খেতাম। কী সুন্দর ছিল দিনগুলো। কিন্তু কথায় আছে সুন্দর দিন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমার বেলায়ও তাই হল। একদিন কয়েকজন লোক কতগুলো কাস্তে নিয়ে এল। তারপর আমাদেরকে তারা কেটে নিয়ে গেল এবং খোলায় রাখল। সেখানে আমাদের উপর কঠিন কয়েকটি দিন গেল। কতগুলো ষাঁড় এসে আমাদেরকে সেখানে পা দিয়ে মাড়াই করল। মাড়াইয়ের ফলে আমি শীষ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। সেখান থেকে কয়েকজন লোক আমাদেরকে নিল এবং বাতাসে উড়ালো। তখন খোসাগুলো উড়ে গেল আর দানাগুলো রয়ে গেল।

এই দিনের চেয়েও কঠিন ছিল ওই দিন, যেদিন একজন লোক আমাকে নিয়ে গেল পাথর দিয়ে বানানো গোলাকার একটি বস্তুর নিকট। তার মধ্যে ছিদ্র আছে। আমি তার রুক্ষ এবং ঘরঘর আওয়াজ শুনছিলাম। ঐ লোকটি আমাকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করল এবং একেবারে পিষে ফেলল। তুমি বোধহয় সেই বস্তুটির নাম জানো। সেটার নাম হচ্ছে পেষণযন্ত্র বা যাঁতা। পিষার ফলে যখন আমি আটা হয়ে উঠলাম তখন আমাকে রুটিওয়ালারা নিল এবং খামির বানানোর পাত্রে রাখল। তারপর আমাকে পরিষ্কার পানিতে ডুবাল এবং হাত দিয়ে মলল। তখন আমি খামিরা হয়ে গেলাম। তা থেকে আমাকে রুটি বানালো। এরপরেই আসল আসল মুসিবত। আমাকে তারা বিছিয়ে রাখল একটি উত্তপ্ত লোহার উপর। যাকে তোমরা তাওয়া বল। আমার তখনকার জ্বালা এবং ব্যাথার কথা আর কী বলব হে মেয়ে! আমি আগুনের তাপে বাঁকা হয়ে গেলাম এবং সংকুচিত হয়ে গেলাম। তবুও তারা আমাকে দয়া করল না এবং আমার প্রতি সদয় হল না। এত কিছু হয়েছে শুধু তোমার জন্য। আমি কষ্ট পেয়েছি তোমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য।

তোমার মজার জন্য এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় পরিবর্তিত হয়েছি তুমি আরাম করে খাওয়ার জন্য এবং তৃপ্ত হওয়ার জন্য। সুতরাং আমার প্রতি না হোক, তোমার রবের প্রতি কি তোমার এ কথা বলা উচিত নয়-

اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنِيْ وَسَقَانِيْ وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ

অর্থ : সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার, যিনি আমাকে খাইয়েছেন এবং পান করিয়েছেন এবং আমাকে বানিয়েছেন মুসলিমদের একজন ।

(আল কিরাআতুর রাশিদা অবলম্বনে)

পূর্ববর্তি সংবাদমক্কীনগর মাদরাসায় হলো দরস সমাপনী অনুষ্ঠান
পরবর্তি সংবাদনোয়াখালীতে বিআরটিসি বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত