ভদ্র মহিলার ঠিকানাহীন চিঠি : পশ্চিমা নারীর আবেগমাখা উত্তর

শায়খ আলী তানতাবী ।।

আমার কাছে একটি চিঠি এল। লিখেছেন এক ভদ্র মহিলা। চিঠিতে নাম ঠিকানা নেই। তবে ভাষা ও উপস্থাপন থেকে বোঝা যাচ্ছে বিদুষী নারী। সেখানে তিনি তার মত করে কিছু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, আর কিছু প্রস্তাবনা ও পরামর্শ তুলে ধরেছেন। তার একটি বক্তব্য ছিল এরকম-

‘‘আপনি একজন আরব নারীর প্রতি লক্ষ করুন, কত সংকীর্ণ জীবন সে যাপন করে। আর একজন পশ্চিমা নারীকে দেখুন, তার জীবন কত প্রশস্ত। লক্ষ করুন, একজন পশ্চিমা নারী কত স্বাধীন ও মুক্ত, আর আরব নারী কতটা পরাধীন ও বন্দী।’’

চিঠির এ পর্যন্ত এসে আমি থেমে গেলাম। তার এ বক্তব্য নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, তার পত্রের উত্তর দিব ইনশাআল্লাহ। তার সামনে তুলে ধরব তার (এবং তার মত অন্য অনেকের) ভাবনার ভুলটা কোথায়। পরক্ষণেই মনে পড়ল তার নাম ঠিকানা তো আমার জানা নেই, তাহলে কীভাবে সম্ভব। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, (কোনো পত্রিকায়) একটি প্রবন্ধ আকারে তার পত্রের উত্তর দিব।

এই ভদ্র মহিলা এবং তার মত আরো যারা এমন ধারণা পোষণ করেন, বরং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তারা বোঝেন না বা স্বীকার করেন না যে, তাদের এই ধারণা নিছক ভাবনা-কল্পনা, বাস্তবতার সাথে যার কোনোই মিল নেই। ড. শায়েখ বাহজাহ আলবায়তারকে এক আমেরিকান নারী যা বলেছিল, সেটিই তাদের এ ভুল ধারণার সবচেয়ে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ ও সারগর্ভ উত্তর।

ড. বাহজাহ আমাকে বলেছেন, তিনি আমেরিকাতে একটি কনফারেন্সে মুসলিম নারী ও নিজ সম্পদে তার একক অধিকার-বিষয়ে আলোচনা করছিলেন; -মুসলিম নারীর সম্পদে রয়েছে তার একচ্ছত্র অধিকার। তার সম্পদে স্বামী বা পিতা কারোরই হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। কোনো নারী প্রাপ্তবয়স্কা হওয়ার পরও যদি সে দরিদ্র হয় তাহলে তার ব্যয়ভার বর্তাবে তার পিতা বা ভাইয়ের উপর। যদি পিতা বা ভাই কেউ না থাকে সেক্ষেত্রে (পর্যায়ক্রমে) নিকটাত্মীয়দের উপর। বিবাহ পর্যন্ত অথবা তার স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তারা তার ব্যয়ভার বহন করবে। তারপর যখন বিবাহ হবে তখন তার সকল দায়-দায়িত্ব ন্যস্ত হবে স্বামীর উপর। যদিও স্বামী সম্পদহীন সাধারণ শ্রমিক হয় আর স্ত্রীর অঢেল সম্পদ থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আমাদের জানা আছে, কিন্তু তাদের (পশ্চিমাদের) এ বিষয়ে কিছুই জানা নেই।

একথা শুনে এক প্রসিদ্ধ আমেরিকান লেখিকা দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘‘আপনি যেমনটি বলছেন, নারীর জীবন যদি আপনাদের সমাজে এমন সুখেরই হয়, তাহলে আমাকে নিয়ে চলুন, আমি সেখানে ছয় মাস থাকব তারপর আমাকে হত্যা করে ফেলুন। (অর্থাৎ, ছয় মাস এমন সুখের জীবন কাটানোর পর মরতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।)’’

ড. বাহজাহ তার একথা শুনে আশ্চর্য হলেন। তার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন এবং এমন মন্তব্যের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তিনি নিজের এবং সেখানকার নারীদের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে বললেন, একজন আমেরিকান নারী বাহ্যত দেখা যায় স্বাধীন, আসলে সে পরাধীন। মনে হয় সে সম্মানিত, আসলে সে লাঞ্ছিত। ছোট ছোট বিষয়ে দেখা যায় তারা নারীকে সম্মান দেখাচ্ছে, কিন্তু বড় বড় বিষয়ে তারা তাকে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত করে। গাড়ি থেকে নামার সময় হাত ধরে নামাচ্ছে, ঘরে বা কোথাও প্রবেশের সময় তাকে আগে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। কখনো কখনো ট্রামে (এক প্রকার যানবাহন) পুরুষ দাঁড়িয়ে গিয়ে নারীকে বসতে দিচ্ছে অথবা নারীর চলার জন্য রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে নারীর সাথে অনেক হীন আচরণ করা হয়, যা অসহনীয় ও ভাষায় প্রকাশ করার অযোগ্য।

এখানে একটি মেয়ে যখন প্রাপ্তবয়স্কা হয়, পিতা তার থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তার জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। পিতা আপন কন্যাকে বলে, যাও এখন কামাই করে খাও। আজ থেকে আমার কাছে তোমার আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তখন বেচারি নিরুপায় হয়ে একাই জীবন সাগরে ঝাঁপ দেয়। সে জানেনা সে সাগরের গভীরতা। জানে না ঢেউ-স্রোতের প্রবলতা। জানে না তার কুমির-হাঙরের হিংস্রতা। এমনকি সে এ-ও জানে না জীবন সাগরের উজান-ভাটা কী জিনিস? কীভাবে সে মোকাবেলা করবে এসবকিছুর। কিন্তু তার পরিবারের তাতে কিছুই যায় আসে না। সে শ্রমের বিনিময়ে খাবে, না শরীরের বিনিময়ে, তা তাদের ভাববার বিষয় নয়। তারা তাকে জিজ্ঞেস করবে না, সে আপন হাতের কামাই খাচ্ছে নাকি…! আর এটা শুধু আমেরিকার কথা নয়, গোটা পশ্চিমা বিশ্বের চিত্র। প্রফেসর ড. ইয়াহইয়া আশশাম্মা‘ আমাকে আজ থেকে ৩৩ বছর আগে (তিনি প্যারিস থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফেরার পরপরই) বলেছেন, তিনি একটি বাসায় গেলেন, সে বাসার একটি কক্ষ ভাড়া নেয়ার জন্য। তিনি বাসায় ঢোকার সময় দেখলেন, একটি মেয়ে চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছে। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা জানালো, সে এ বাড়িরই মেয়ে। সে স্বাধীনভাবে একা থাকার জন্য আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে। ড. ইয়াহইয়া বললেন, তাকে যে আমি কাঁদতে দেখলাম! তখন তারা বলল, হাঁ, সে এসেছিল আমাদের বাসার একটি রুম ভাড়া নেয়ার জন্য, কিন্তু আমরা তাকে ভাড়া দিতে রাজি হইনি। তিনি বললেন, কেন? তারা বলল, কারণ সে ২০ ফ্রাঙ্ক দিতে চাচ্ছে। কিন্তু অন্যের কাছে ভাড়া দিলে আমরা পাবো ৩০ ফ্রাঙ্ক!

পাঠক! আপনার যদি বিশ্বাস না হয় (বিশ্বাস না হওয়ারই কথা। কারণ এমন ঘটনা একজন আরব বা মুসলিমের কাছে অবিশ্বাস্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত) আপনি ডক্টর সাহেবকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। তিনি আপনাকে নিশ্চিত করবেন যে, তিনি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকায় থেকেছেন আমাদের এমন অনেক বন্ধুই এজাতীয় ঘটনা শুনিয়েছেন, যারা তাদের সাথে মিশেছেন এবং কাছ থেকে তাদেরকে দেখেছেন।

একজন মুমিন নারীর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তার ইজ্জত-আব্রু। জীবনের বিনিময়ে হলেও সে এর হেফাযত করে। কিন্তু একজন পশ্চিমা নারী! সামান্য রুটির জন্য সে তার সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু ইজ্জত-আব্রু বিলিয়ে দিচ্ছে। কোনো পাঠক হয়ত পড়ে থাকবেন; বিশিষ্ট লেখক-সাহিত্যিক তাওফীক হাকীম পশ্চিমা এক নারীর বিষয়ে লিখেছেন, যে নাকি নিজেকে তার (তাওফীক হাকীম) হাতে সঁপে দিয়েছিল। তার সাথে বসবাস করেছিল স্ত্রীর মত। বিনিময়ে সে পাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই ও দু’বেলা রুটি। পরবর্তীতে ঐ নারীর প্রতি বিরক্ত হয়ে সে তাকে তাড়িয়ে দেয়।[1]

প্রিয় বোন! মুসলিম নারী নিজেকে হেফাযত করেছে ; হেজাব গ্রহণ করেছে। ফলে সে সম্মানিত ও দামী হয়েছে। পর্দার বিধানকে আপন করেছে, অন্যায় সম্পর্ক থেকে বিরত থেকেছে। ফলে পুরুষই তাকে খোঁজ করে ফিরছে, তার জন্য পয়গাম পাঠাচ্ছে। মোটা অংকের মোহর পরিশোধ করে তাকে জীবনসঙ্গীনী বানাচ্ছে। আর পশ্চিমা নারী নিজেকে প্রদর্শন করেছে ও সহজলভ্য করেছে। ফলে সে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়েছে। কারণ, সহজলভ্য প্রতিটি বস্তই মূল্যহীন।

প্রথম যুগের আরব কবিদের অবস্থা ছিল, তাদের সামনে যদি নারীর হাতের তালু ও কব্জিটুকুও প্রকাশ পেত তাহলে তাদের হৃদয়ে তরঙ্গ খেলে যেত, দেহ-আত্মায় প্রেমের স্পন্দন জেগে উঠত, যবান কবিতা-সচল হত, শব্দ-ছন্দের ঝর্ণা প্রবাহিত হত। কারণ, আরব নারী থাকত হেজাবে ঢাকা, পরপুরুষের দৃষ্টির আড়ালে। আর পশ্চিমা নারী! সী-বীচে তার উপর-নিচ সব থাকে উন্মুক্ত। পুরুষ তার পায়ের গোছার দিকে তাকায়, কিন্তু তা তার মনে কোনো প্রভাব ফেলে না। হৃদয়কে নাড়া দেয় না। স্পন্দিত হওয়ার কোনো উপকরণ সেখানে সে খুঁজে পায় না। নারীর পায়ের গোছা আর চেয়ারের পায়া যেন একসমান!

আর এ কারণেই তাদের সমাজে বিয়ের বাজার মন্দা। বিবাহ তো আজীবনের বন্ধন। নারী-পুরুষ সে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর মাধ্যমে তারা তাদের বিশেষ চাহিদা পূরণ করে। আর সেটিই বিবাহের প্রথম আকর্ষণ। এখন সে সমাজে যখন বন্ধন থেকে মুক্ত থেকেই চাহিদা মেটানো যায়, তখন কেন একজন পুরুষ বিবাহনামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাবে, নিজেকে সে ঝামেলায় জড়াবে? (এমনই একটি কথা তাদের অনেকে বলে থাকে -‘‘যখন সহজে দুধ কিনতে পারছ, তাহলে কেন খামোখা গোটা গাভী কিনতে যাবে?’’)

আজ পশ্চিমা নারী বিবাহের মত পবিত্র বন্ধন থেকে বঞ্চিত। ফলে সে হারিয়েছে পরিবার ও তার ভরণ-পোষণের দায়িত্বশীলকে। বঞ্চিত হয়েছে জীবিকার নিরাপত্তা থেকে, মাথার উপরের নিরাপদ ছায়া থেকে। ফলে জীবন ধারণের জন্য সে গ্রহণ করেছে সব ধরণের পেশা, হীন থেকে হীনতর কাজ। সে আজ কারখানার শ্রমিক, রোদে খাটা কৃষক, পথের ঝাড়ুদার! আমাদের বন্ধুরা যারা ইউরোপে থেকেছেন, তারা সেখানে নারীদেরকে পাবলিক টয়লেটও পরিষ্কার করতে দেখেছেন। (আমি নিজেও ১৯৭০ ও ১৯৭৬ সনে নিজ চোখে তা দেখেছি।) আর কিছু নারী আছে যারা জুতা পালিশের কাজ করে। একটি বাক্স বহন করে এবং সারাদিন ফুটপাথে থাকে। এদের কাউকে কাউকে দেখা যায় সাথে বই, কাস্টমারের ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোনো লোক এসে তার দিকে পা বাড়িয়ে দিলে সে বই ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে জুতা পালিশে। এই তো পশ্চিমা নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতার সাতকাহন। এদিকে মুসলিম নারী নিজগৃহে অবস্থান করে, আর পুরুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে।

একজন মুসলিম নারী যখন বিবাহের বয়সে উপনীত হয় তখন পুরুষ তার জন্য প্রস্তাব পাঠায় এবং তার পর্যন্ত পৌঁছতে মোটা অংকের মোহর পরিশোধ করে। স্বামী প্রদত্ত এ সম্পদ নারীর একার, এর একমাত্র মালিক সে। এতে তার অনুমতি ব্যতীত আপন পিতা, ভাই বা স্বামী কারো হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার নেই। আর পশ্চিমা নারী! তার নিজেকেই ছুটতে হয় পুরুষ সঙ্গীর খোঁজে। তারপর ঐ পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে পঞ্চাশ হোঁচট খেতে হয়। কখনো কখনো এমন তীব্র হোঁচট খায় যে, এক হোঁচটেই সবকিছু খোয়াতে হয়, এমনকি জীবনটা পর্যন্ত! এতকিছুর পর যদিওবা তার পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তাকে গুণতে হয় মোটা অংকের অর্থ। যেন স্ত্রী স্বামীকে মোহর দিয়ে বিবাহ করছে! এরপর থাকলো স্ত্রীর সম্পদ। সেখানেও তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চলবে না। স্বামীও হস্তক্ষেপ করবে তার সম্পদে। আর মুসলিম নারীর সম্পদ! একমাত্র তার, কারো হস্তক্ষেপ চলবে না তার সম্পদে।

প্রিয় বোন! তুমি হয়ত বলবে, এটা অনেক আগের কথা। আমাদের এখানেও এখন বিবাহের বাজার মন্দা এবং অবিবাহিতা নারীর সংখ্যা অনেক। কথা ঠিক। কিন্তু ভেবে দেখেছ, কেন এমন হল?

কারণ, আমরা এখন পশ্চিমাদের অনুকরণ শুরু করেছি। ঐসকল বিষয়ে তাদের অনুকরণ করছি, যেগুলো থেকে মুক্তির পথ তারা খুঁজছে এবং তাদের ঐসকল বিষয় গ্রহণ করতে শুরু করেছি, যেগুলো থেকে তারা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। কারণ, ঔপনিবেশিকরা গত শতাব্দীতে – যখন আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম এবং গাফেল ছিলাম – আমাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, তারাই উন্নত, তারাই অগ্রগামী। তারা যা করছে সেটাই সঠিক। ফলে প্রতিটি বিষয়ে আমরা তাদের অন্ধ অনুকরণে মেতে উঠেছি; তাদের মত হতে পারাকেই পরম মোক্ষ লাভ মনে করছি!

কিন্তু আরব (আরবের মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি) কি সকল বিষয়ে এমন অন্ধ অনুকরণ মেনে নিতে পারে? তা কি তাদের আত্মসম্মানে বাধে না?

আত্মসম্মানবোধ তো আরবদেরই বেশি থাকার কথা। একারণেই তো অসম্মানের ভেবে তারা আপন কন্যাকে জ্যান্ত পূঁতে ফেলত (যদিও সেটা ছিল আত্মসম্মানবোধ প্রকাশের এক ঘৃণ্য উপায়)। সে আরবরা কি এটা মেনে নেবে যে, অনুষ্ঠানে অপরিচিত কোনো লোক এসে বলবে, ‘ইসমাহ লী’ দয়া করে একটু দেবেন কি! কী দিবে? সিগারেট ধরানোর জন্য দিয়াশলাই? কয়টা বাজে দেখার জন্য হাত ঘড়িটা এগিয়ে ধরবে? না, বরং আপন স্ত্রীকে, ঐ লোকটার সাথে নাচার জন্য; তার বক্ষ ঐ পুরুষের বক্ষের সাথে মেলানোর জন্য, তার চেহারা ঐ অপরিচিত মানুষটির চেহারার কাছাকাছি নিয়ে, তার পা ওর পায়ের কাছে নিয়ে হাতে হাত ধরে নাচার জন্য!

কোনো আরব বা কোনো মুসলিম কি এটা মেনে নেবে? না, আত্মমর্যাদাশীল কোনো পুরুষই তা মেনে নেবে না। বরং প্রাণীকুলের মধ্যে নিকৃষ্ট খিনযীর ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীও এটা মেনে নেবে না!

এটাই হল পশ্চিমা নারীর হালচিত্র। এবার বলুন, পশ্চিমা নারী এমন কী ভালোর মাঝে আছে, যা আমরা আমাদের নারীদের জন্য কামনা করতে পারি?

ড. বাহজাহ আলবায়তারকে ঐ আমেরিকান লেখিকা যা বলেছিল তা আরেকবার স্মরণ করুন। যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে প্রতিটি জার্মান এবং ফরাসী নারীও একই কথা বলবে। তোমরা আমাদের শরীয়ত বিষয়ে উচ্চবাচ্য কর, যা তা বল, -আমাদের শরীয়ত নারীকে পুরুষের অর্ধেক মীরাছ দেয়। পুরুষকে একাধিক বিবাহের সুযোগ দেয় ইত্যাদি। তাহলে তোমরা আমেরিকার নারীদের বলে দেখ, তারা পুরুষের অর্ধেক মিরাছ গ্রহণ করবে আর তাদের ভরণ-পোষণের যাবতীয় খরচ বহন করবে পুরুষ। দেখবে তারা প্রস্তাবপাঠ রাজি হয়ে যাবে। তেমনি জার্মানি নারীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পার, বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তারা কি এই প্রত্যাশা করত না যে, তাদের প্রতি দশজনের জন্য একজন স্বামী হবে আর সে তাদের সাথে ইনসাফের মুআমালা করবে এবং তাদের ব্যয়ভার বহন করবে?

আল্লাহ যদি মানবজাতির জন্য এই  সুযোগ না রাখতেন তাহলে কীভাবে জার্মান ও তার মত বিভিন্ন রাষ্ট্রে নারীর আধিক্যের বিষয়টির সমাধান হত? আল্লাহ তো মানুষকে এই স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করেছেন যে, নারী-পুরুষের মিলন অনিবার্য। একের ছাড়া অন্যের চলেই না! তারপর যখন প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৫০ তখন অনিবার্যভাবে কি এই ফলাফল দাঁড়ায় না যে, প্রতি দু’জন নারীর জন্য একজন পুরুষ। বরং প্রতিটি প্রাণীর ক্ষেত্রেই তো আল্লাহর নিয়ম এই যে, মাদীর তুলনায় নর অর্ধেক বা তারও কম। মুরগি ও মৌমাছির কতভাগ নর? আরে পশ্চিমা পুরুষ কি চারজন নারী গ্রহণ করে না? বরং চারের বেশি! কিন্তু হারাম পথে!!

তোমাদের কাছে তো ইবলিসের ‘আকদে’ (চুক্তিতে,বন্ধনে) হারাম পন্থায় চার থেকে চলিস্নশ গার্লফ্রেন্ড আর বান্ধবী গ্রহণ দোষণীয় নয়, আর আল্লাহর ‘আকদে’ হালাল পথে চার বিবাহ দোষের? (অথচ কখনো কখনো তা নারীর জন্য একমাত্র রক্ষাকবচ!)

না হে বোন! একথা ভাববার কোনো কারণ নেই যে, পশ্চিমা নারী বেশি সুখী বা বেশি সম্মানিত! আল্লাহর কসম করে বলছি, এই পৃথিবীতে মুসলিম নারীই সবচেয়ে বেশি সুখী ও সম্মানিত।

মুসলিমসমাজে স্বামী শুধুই তার স্ত্রীর জন্য; তার স্বামীতে কোনো গার্লফ্রেন্ড বা বান্ধবীর কোনো অধিকার নেই। তেমনি স্ত্রীও শুধুই তার স্বামীর জন্য; বয়ফ্রেন্ড বা বন্ধুর কোনো হস্তক্ষেপ সেখানে চলবে না। সে একান্তই তার স্বামীর, তার স্বামী একান্তই তার। সে স্বামী ছাড়া কারো সামনে নিজেকে সঁপে দেবে না। তার হেরেমে স্বামী ছাড়া কেউ প্রবেশ করবে না। তার আদ্যেপান্ত স্বামী ছাড়া কেউ জানবে না। বল হে বোন! এটাই কি পশ্চিমা বা তাদের অন্ধ অনুসারীদের কাছে মুসলিম নারীর দোষ; তার পরাধীনতা, তার বন্দীত্ব!?

বল, কেউ কি এটা মেনে নেবে যে, তার স্ত্রী তার হবে এবং অন্য দশজনেরও!?

বল, পবিত্রতা ও চারিত্রিক শুদ্ধতা কি দোষের?

তাহলে কি যা কিছু ভালো তাকে বলব মন্দ, আর আলোকে বলব অন্ধকার!?

ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে অন্যের মস্তিষ্ক দিয়ে চিন্তা। অন্যের চোখ দিয়ে দেখা। অনেক হয়েছে বানরের মত গলায় অন্ধ অনুকরণের বেড়ি লাগিয়ে নেওয়া।

এখন আমাদের ফিরে আসতে হবে আত্মপরিচয়ের দিকে। ইসলামের দিকে, আরবের ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের দিকে, চারিত্রিক পবিত্রতার দিকে।

পশ্চিমা নারীরা তাদের মত চলুক, তাদের পুরুষরা তাদের জন্য যেটা কল্যাণকর মনে করে সেভাবেই চলুক। ওদের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? (ওদের তো আখেরাত বলে কিছু নেই। যাদের জীবনে আখেরাত-ভাবনা বলে কিছু নেই তাদের লাইফস্টাইল, তাদের জীবন-ভাবনা আমরা গ্রহণ করতে পারি কীভাবে। মুসলিম নারী তো সফল হতে চায় দুনিয়াতে ও আখেরাতে। সুতরাং ওদের জীবন আমাদের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।) আমাদের স্ত্রীরা চলুক আল্লাহ যেভাবে চান সেভাবে। আমরা তাদের জন্য যেভাবে চলা কল্যাণকর মনে করি সেভাবে। যাতে আমরা শুধুই তাদের হই। তাদেরকে নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি। আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাক শুধু তাদের দিকে, অন্য কোনো নারীর দিকে নয়।

হে বোন! শুনে রাখো, পৃথিবীতে আমাদের নারীরাই শ্রেষ্ঠ; যতক্ষণ তারা হেজাবের পাবন্দী করবে, ইসলামের আদাবের প্রতি গুরুত্ব দিবে, আরবের স্বভাব-চরিত্র আর ইসলামের আহকামকে আঁকড়ে ধরে থাকবে এবং ঐ সমাজের রীতি-নীতি আপন করে নিবে, যে সমাজ জন্ম দিয়েছে আয়েশা, আসমা, খানসা ও খাওলার মত অগণিত মহিয়সী নারী। জন্ম দিয়েছে আলেমা, ফকীহা, মুহাদ্দিস ও সাহিত্যিক। উপহার দিয়েছে সতীসাধ্বী দ্বীনদার মা, যাদের থেকে জন্ম নিয়েছে বীর-বাহাদুর; যুদ্ধের ময়দানের বীর, বক্তৃতার মেম্বারের অনলবর্ষী বক্তা, চিন্তার জগতের অগ্রনায়ক। রাজত্ব ও অর্থ যাদের পদচুম্বন করত। আর তারাই ছিল পৃথিবীর কর্তা। তাদের হাতেই ছিল অর্ধ পৃথিবীর রাজত্ব। আর তোমরা ছিলে হে বোন! ঐ সকল বীর-বাহাদুরের জন্মদাতা মা, রত্মগর্ভা মহিয়সী জননী। l

[মা‘আন্নাস থেকে (পৃ. ১৬৯-১৭৬) ভাষান্তর : মুহাম্মাদ ফজলুল বারী]

পূর্ববর্তি সংবাদমুজিবনগরে হাত-পা বেঁধে সার ব্যবসায়ীকে হত্যা
পরবর্তি সংবাদক্ষমতায় আসার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মোদীকে আমন্ত্রণ: আসিফ নজরুল