নীল নদের জলপ্রপাতে এক রোদেলা দুপুর

মুহাম্মদ আবদুস সালাম ।। মিসর থেকে

ঘড়ির কাঁটা তখন আটের ঘর ছুঁই ছুঁই। সকালের স্বচ্ছ কোমল নিস্তব্ধতা ভাঙতে শুরু করেছে। বাইরে ঝিরঝিরে বাতাস। হেমন্তের মাঝামাঝি। তবুও হঠাৎ হঠাৎ শীতের হালকা স্পর্শ শিহরিত করে তুলছিল। আমরা জড়ো হলাম মদিনাতুল বুউসের প্রধান ফটকে। আমাদের গন্তব্য আবেগ, ভালোবাসা, কৌতুহল আর মুগ্ধতার এক স্বপ্নপুরী। যার রহস্য ও মোহনে হারিয়ে গেছেন  যুগে যুগে অসংখ্য কবি সাহিত্যিক আর গল্প ও চিত্রের শিল্পী। বলছি নীলের কথা। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বুরুন্ডি পর্যন্ত ১১ টি দেশের উপর দিয়ে বয়ে চলা পৃথিবীর সুপ্রাচীন ও দীর্ঘতম নদের কথা। সমৃদ্ধ সব ভাষা সাহিত্য ও লোকসাহিত্যে যে নীল মানেই গল্প। উপাখ্যানময় এক জগত। নীল মানেই ডালি ডালি ছড়া কবিতা।

কায়রোতে কয়েক মাস হয়ে গেল ; অথচ তারই মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা নীলের সান্নিধ্যে এখনো যাওয়া হলো না। তাই এবারকার সুযোগটা আর হাতছাড়া করলাম না। পড়াশোনার ব্যস্তময় জীবন আর অধ্যবসায়কে যেন একঘেয়েমি না পেয়ে বসে, সেজন্য ‘আযহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বাংলাদেশ’ এর মদিনাতুল বুউস- আল আযহার ছাত্রাবাস- শাখা এই আনন্দ ভ্রমনের উদ্যোগ নিয়েছে।

সিনিয়র জুনিয়র মিলে আমরা প্রায় জনা বিশেক একত্র হয়েছি। আমাদের প্রথম স্টপেজ নীলের কোল ঘেঁষা তাহরির স্কয়ার। সেখান থেকে কানাতির। যেখানে আছে নীলের অনিন্দ্য সুন্দর জলপ্রপাত। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তাহরিরে পৌঁছে গেলাম। এই জায়গায় আসলে অন্যরকম অনুভূতি জাগে। আরব বসন্ত সহ কত বিপ্লব আর ইতিহাস এখানকার সাথে জড়িত। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম তাহরির স্কয়ারের অদূরে হিলটনের পাশে নীলের দ্বিতীয় সেতুতে।  প্রথম বারের মত নীলের সান্নিধ্য। আবেগ আর উচ্ছলতার শিহরণ অনুভব করলাম।নীলের বুকে একটু পর পর অনেকগুলো সেতুবন্ধনে একুল ওকুলের জোড়া শহর-দৃশ্য বড় সুন্দর লাগছিল। আবহমানকালের এই স্রোতস্বিনী আমাদেরকে যাদুর মত টানছিলো। আমরা সেতুর বেলকনি ধরে দাঁড়িয়ে তার অভাবিত সৌন্দর্যময় রূপে অবগাহন করবার চেষ্টা করছিলাম। দুচোখ ভরে দেখছিলাম নীলের অপরূপ মাধুরী, নীল আভা আর নাব্যতা। দুকুলের কুর্নিশ আর স্থাপত্যশৈলীও মোহিত করে তুলছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল বুর্জ আল কাহেরা। মিশর ও উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভাকৃতির আধুনিক এই টাওয়ার সহ পুরো দৃশ্য কে ছবির মত লাগছিল।

অপেক্ষাকৃত শান্ত এই নীলের বুক চিরে দুঘণ্টার নৌভ্রমণে কানাতির যাওয়ার ইচ্ছে ছিল আমাদের। কিন্তু হলো না। আমরা মাইক্রো রিজার্ভ করে নীলের উপকন্ঠ ধরে রওয়ানা করলাম। শিক্ষার্থীদের সফর মানে হাসি আনন্দ আর রস কৌতুকের ফুলঝুরি। তেমনি এক দৃশ্যের অবতরণ হল আমাদের মাইক্রোতে। নীলের কোল ঘেঁষে চলছিল গাড়ি আর আমরা উপভোগ করছিলাম নীলনদ এবং দেখছিলাম কায়রোর শহরতলীর দৃশ্যপট। এখানকার সাইনবোর্ড গুলোতে এলাকার নাম লেখা থাকে না। তাই বিদেশীদের জন্য একটু মুশকিল হয়ে যায়। এজন্য বিশেষ কোথাও গেলে গুগল ম্যাপ অন করে রাখি। এদেশে গুগল ম্যাপ অন করলে অন্য এক ভালো লাগা কাজ করে। কারণ ভেসে ওঠে অনেক পরিচিত নাম আর মনে পড়ে ইতিহাসের বরেণ্য অনেক ইমাম ও লেখকের কথা। এই যেমন সুয়ূতী, তাহতাভী, ইসকান্দারী, ফাইয়ূমী, কালয়ূবী প্রমুখ। আজকের এই সফরে আমরা যাচ্ছি কালয়ূবের  পথ ধরে। বড় রোমাঞ্চিত হলাম। সেই বহু আগে পড়েছি আল্লামা কালয়ূবীর আরবি সাহিত্য বিষয়ক প্রসিদ্ধ কিতাবটি। আর আজ তারই এলাকার আলো বাতাস আর ধুলোবালির স্পর্শে ধন্য হতে যাচ্ছি। জানিনা এই জেলার কোন জায়গাটিতে ছিল তার বসবাস এবং জানা নেই আজ তিনি কোথায় শায়িত আছেন। মন তার ভালোবাসায় আবেগাপ্লুত হচ্ছিল। কিছু যিকির তেলাওয়াত করে তার দারাজাত বুলন্দির জন্য দোয়া করলাম।

ঘন্টা খানেকের মাথায় আমরা পৌঁছে গেলাম কানাতির। এই প্রথম মিশরের গ্রাম দেখার সুযোগ হল। দীর্ঘদিন পরে কোন গ্রামীণ পরিবেশে শ্বাস নিলাম। কোলাহল মুক্ত সবুজ শ্যামল পরিবেশটি কে আপন আপন লাগছিল। হয়তো গ্রামের ছেলে বলে। মিশরীয় গ্রামীণ সভ্যতা আর জীবনাচার কাছে থেকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করলাম। কায়রোর চেয়ে এখানকার মানুষ কে অনেকটা সহজ সরল এবং কুশল বিনিময়ে অনেক বেশি প্রাণোচ্ছল মনে হলো।

আমরা হাঁটছিলাম নীলের কোল ঘেঁষে সরু এক মেঠো পথ ধরে। ডানে সবুজের মাঠ। বাঁয়ে খেজুর গাছের বিথীকা। তারও বাঁয়ে যুগ যুগান্তরের বহমান প্রাণবন্ত নীল। অনতিদূর থেকে দেখা যাচ্ছিল শাল্লালাত অর্থাৎ জলপ্রপাত। আমাদের কল্পিত সৌন্দর্যকে হার মানালো তার বাস্তব দৃশ্য।

ছোট্ট চিকন সিঁড়ি ভেঙে আমরা নিচে নামলাম। সেখানে বৃদ্ধ বৃদ্ধা আর যুবকের তিনটি তাবু পাতানো। তাবু আর মরু আরবের মাঝে যেন কবিতার ছন্দ মিল। অন্যরকম আনন্দ বোধ করলাম। আমরা একটি তাবু ভাড়া করে ব্যাগ ও কাপড় চোপড় রাখলাম। শুরুতেই আমরা আমির সাহেবের হাতে পাকানো তেহারি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলাম। আরবের মাটিতে সুদূর প্রিয় বাংলাদেশের সুস্বাদু খাবার। অসাধারণ লেগেছিল। তৃপ্তি ভরে খেলাম।

আমাদের উপরে নীল আকাশ, নিচে নীলনদ এবং নীলের জলপ্রপাত। এখন নীল আমাদের একদমই কাছে। হাত বাড়ালেই প্রিয় নীলকে ছোঁয়া যাবে। তার নরম স্পর্শে নিজেকে সিক্ত করা যাবে। দুচোখ ভরে দেখতে থাকলাম নীল এবং নীলের প্রবাহ। যেই প্রবাহ খলিফা ওমরের চিঠির পেয়ে সুদীর্ঘ চৌদ্দশ বছরে একটি বারের জন্যও আর থামেনি। বয়ে চলেছে অবিরাম অসংখ্য দিবস রজনী এবং নীল কন্যা অর্পনের অপসংস্কৃতিরও আর পুনরাবৃত্তি হয়নি।

জলপ্রপাতটি কিংবদন্তি এই নদের সৌন্দর্যকে অসম্ভব মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃত্রিম এই জলপ্রপাতের কৃত্রিমতা চোখে পড়ে না। তার শৈল্পিক নিপুণতা প্রাকৃতিক রূপ ধারণ করেছে। দুফুট পানির গভীরে একূল থেকে ওকূল পর্যন্ত মেঝে বাঁধানো। আর তার কয়েকশো মিটার আগে প্রবাহ-গতি ধীরলয় করবার জন্য নির্মিত হয়েছে বাঁধ। অপরদিকে একটু গভীরে নানারকম দৃশ্যায়িত করে পাথর ও পাথুরে ব্লক বসানো। যার ফলে ধীর গতির পানি মেঝে অতিক্রম করে সজোরে সাজানো ব্লকে নানা মাত্রিকতায় আছড়ে পড়ে মনোমোহিনী দৃশ্যের সৃষ্টি করছে। ব্লক বসানোর শৈল্পিকতায় নদের একেক অংশে জলপ্রপাতের একেক দৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্যের রয়েছে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ও আকর্ষণ। একটু দূরে অকৃত্রিম রূপে দুটি ছোট্ট কৃত্রিম দ্বীপও তৈরি করা হয়েছে।

আমরা নীলের বুকে নিজেদের ছেড়ে দিলাম। আছড়ে পড়া জলের মনমাতানো ছবিতে হারিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে পুবের সূর্য এসে এখন আমাদের মাথার উপরে। সূর্যের খরতাপ নীলের হিমেল বায়ুর মিশ্রণে সহনীয় বোধ হচ্ছিল। রোদেলা দুপুরের শুভ্রতা জলপ্রপাতের প্রতিটি জলকণা কে স্বচ্ছ হিরের টুকরোয় দৃশ্যায়িত করছিল। সূর্যালোক আর স্বচ্ছ জল কণার চিকমিকি এবং জলপতনের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ সুরে অন্যরকম পরিবেশ ধারণ করছিল। হাজার হাজার বছরের বয়ে চলা এই স্রোতে নিজেকে রচনা করবার জন্য তৃপ্তিভরে সাতরালাম এবং সাতরিয়েই অদূরের দ্বীপে চলে গেলাম। সেখানে দেখতে পেলাম নলখাগড়া পাতায় ছাওয়া চাল সর্বস্ব ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। পাশে একটি চুলো, কিছু কয়লা, শুকনো রুটি আর হুক্কা। দেখা হল দুই আরব বেদুইনের সাথে। একজন ঘরটির খুঁটি মেরামত করছেন। আরেকজন নলখাগড়া কেটে বহন করে আনছেন। আধুনিক যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন এই বেদুইনদের সাথে কথা বলতে মন চাইলো। কিন্তু স্বীয় কাজে তাদের নিমগ্নতায় কথা আর দীর্ঘায়িত হল না।

গেলাম অপর দ্বীপে এবং ভেজা বদনে শম্ভুক আর পাথরকুচির মধ্যেই আমরা সালাতুয যোহর আদায় করলাম। ইমাম ছিলেন এক বেদুইন মাঝি। নামাযে তার নিমগ্নতা, স্থিরতা ও দীর্ঘতা আমাদেরকে অসম্ভব রকম মুগ্ধ করেছিল।

আমরা বাঁধানো শান ধরে হাঁটছিলাম নীলের মধ্যখানে। আবার কখনো বসানো পাথর ব্লকে। বারবার নিজেদের আবিষ্কার করছিলাম আছড়ে পড়া জলের নির্ঝরণীতে। মাথার সূর্য কবে যে পশ্চিমাকাশে অনেকদূর এগিয়ে গেছে বোঝাই গেল না। আমির সাহেব আমাদেরকে সময়ের জানান দিলেন। ততক্ষণে আমরা জলপ্রপাতের খরস্রোতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে উঠছিলাম। যদিও তার আকর্ষণ ও মুগ্ধতা তখনো আমাদেরকে ছাড়বার ছিল না। আমরা ধীরে ধীরে উঠে এলাম। কিন্তু নীলের ভালোবাসা আর মোহনে মন বারবার সেদিকে ছুটছিল। গোধূলির বেলাও ঘনিয়ে আসছিল। ফিরতে যে হবে। নীলের বিরহ বেদনা আমাদের পুড়ছিল। আমরা আনমনে ধীর পায়ে ফিরতি পথে এগুচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে দিগন্তে মিশে গেল প্রিয় নীল, ভালোবাসার নীলনদ। তাহরির পর্যন্ত আমরা একত্রে এসে তারপর যে যার বাসার পথে আলাদা হয়ে গেলাম।

পূর্ববর্তি সংবাদতালেবান – যুক্তরাষ্ট্র শান্তিচুক্তির প্রশংসায় ট্রাম্প
পরবর্তি সংবাদমোদীর ঢাকা সফর : সরকার কি চাইলেই আটকানোর সামর্থ্য রাখে?