ইসলামি চিন্তাধারা সংস্কার : স্বরূপ, বিচ্যুতি ও সময়ের দাবি

মুহাম্মদ আবদুস সালাম ।। মিসর থেকে

মিশর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আল আযহারের উদ্যোগে গত ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে “ইসলামি চিন্তাধারা সংস্কার” শীর্ষক আল আযহার আন্তর্জাতিক সেমিনার। এতে আমন্ত্রিত হয়েছেন মোট ৪৬ টি দেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব এবং ওয়াকফ মন্ত্রণালয়, ফতোয়া বোর্ড ও ইসলামি গবেষণা মূলক কাউন্সিলগুলোর প্রতিনিধিগণ। দুদিন ব্যাপী আয়োজিত এই সেমিনারে নির্ধারিত শিরোনামের  বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচনার সাথে কিছু আপত্তিকর আলোচনাও এসে গিয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তার কিছু কিছুর উপর খণ্ডনও করা হয়েছে।

এখানে আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে অতিথিদের দেয়া বক্তব্যের কিছু চুম্বকাংশ নিবন্ধ আকারে তুলে ধরা হলো।

ইসলামি চিন্তাধারা সংস্কারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

তাজদীদ বা সংস্কার ইসলামের একটি শাশ্বত আইন ও বিধান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,  আল্লাহ এই উম্মাহর মাঝে প্রতি শতকের মাথায় এমন লোক পাঠাবেন যারা তাদের দীন বিষয়ে সংস্কারের কাজ করবে।( আবু দাউদ, হাদিস নং , ৪২৯১)

এটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু নয়। বরং ইসলাম ও তাজদীদ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এ দুইয়ের সমন্বয়ে সর্বযুগে উম্মাহর কল্যাণকর পথ ও সমস্যার সমাধান বেরিয়ে এসেছে এবং আসতে থাকবে। এর মাধ্যমেই সকল যুগে সবখানে ইসলামি বিধানের নির্ভরযোগ্যতা, প্রচলন ক্ষমতা ও চিরন্তনতা নিশ্চিত হবে। তাই এটি একটি সর্বজন স্বীকৃত বিষয়।

ইসলামি চিন্তাধারা সংস্কারের স্বরূপ

এ সম্পর্কে সেমিনারে বলা হয়,

ক   “ইসলামি চিন্তাধারা সংস্কার” , এই শিরোনামটি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর রয়েছে অনেক অনেক দিক এবং তা অতি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু বর্তমানে তার মর্ম বড় দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কারণ এখন আলেম জাহেল, যোগ্য অযোগ্য সবাই এ বিষয়ে কলম ধরছে। প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়া সবখানেই চলছে এই দুঃসাহসিকতা। অথচ এই মহান কাজটি সবার জন্য সহজ নয় এবং সবার জন্য তার অবকাশও নেই। তাই প্রত্যেক ইসলামি গবেষকের নিকট তাজদীদ-সংস্কারের মর্ম, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও তার নীতিমালা স্পষ্ট থাকা আবশ্যক। যেন চিন্তা গবেষণায় কোন ধরনের ভুলের শিকার হতে না হয়।

খ   সংস্কার মানে এই নয় যে, দীন শরীয়ত, কোরআন সুন্নাহ এবং ইসলামের অন্যান্য নীতিমালা ও জ্ঞান সম্ভারকে আমূল পরিবর্তন করা, কিংবা তা উপেক্ষা করে নতুন কিছু আবিষ্কার করা। বরং সংস্কার তো হতে হবে যুগ পরম্পরায় চলে আসা ইসলামের সুবিশাল মিরাস ও জ্ঞান সম্ভারের আলোকে, শরীয়তের মাকসাদ ও নীতিমালার সূত্রপথ ধরে এবং সংস্কারের যে নির্ধারিত ক্ষেত্র রয়েছে, সেখানেই কেবল তা হতে হবে।

গ   ইসলামের অকাট্য ভাবে প্রমাণিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে তাজদীদ চলবে না ।চাই তা আকিদা, ইবাদাত, আমল বা অন্য কোন বিধান হোক। এক্ষেত্রে তাজদীদ করতে চাইলে তা তাজদীদ- সংস্কার নয় ; বরং তা হবে তাবদীদ তথা কুসংস্কার অপসংস্কার ও বিচ্ছিন্নবাদিতা।

ঘ   তাজদীদ বা সংস্কারের মূল ক্ষেত্র হচ্ছে, দীনের শাখাগত বিষয়াদি। যা অকাট্য নয় ; বরং প্রবল ধারণা নির্ভর দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং যেসব বিধান স্থান কাল পাত্র ভেদে পরিবর্তনশীল। এর আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গন হচ্ছে, বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তির উন্নয়নে সৃষ্ট আধুনিক জীবন যাপনের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নানান অনুষঙ্গ। যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইত্যাদি।

ঙ   সংস্কারের অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে, এই কাজে একমাত্র তারাই নিয়োজিত হবে যাদের রয়েছে কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানে পূর্ণাঙ্গ পরিপক্কতা। কোরআনের ভাষায় রাসিখ ফিল ইলম এবং তারা কোন ধরনের প্রান্তিক চিন্তা ও রুচির শিকার নন ; বরং মধ্যপন্থার গুনে ভূষিত। অন্যথায় তাজদীদ না হয়ে হবে তাবদীদ।

ইসলামি চিন্তাধারা সংস্কারে কিছু বিচ্যুতি

আক্ষেপের বিষয় হল, অনেকে সংস্কারকর্মের যোগ্য না হয়েও কিংবা সংস্কারের নীতিমালা রেআয়েত না করেই এই মহান কাজে দখলদারি দেয়। যার ফলে গবেষণা ও সংস্কারের নামে সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে নানান কুসংস্কার, বিভ্রান্তি, বিকৃতি ও প্রান্তিকতা। যেমন,

ক   অনেকে অকাট্য ও অকাট্য নয় এমন উভয় প্রকারকে গুলিয়ে ফেলে।

খ   অনেকে পরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তিত বিধানের মধ্যকার ব্যবধান রেখা উঠিয়ে দেয়।

গ   আবার অনেকে আকীদা বিশ্বাস ও ইসলামের মৌলিক নীতিমালাও সংস্কার করতে উঠে পড়ে লাগে।

ঘ   অনেককে দেখা যায় তারা গবেষণা কর্মে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের মুগ্ধতায় ইসলামের জ্ঞান সম্ভারের যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন করতে পারেনা।

ঙ   অনেকে মানুষের মাসলেহাত ও সুবিধা দেখতে গিয়ে শরীয়তের নীতিমালা ভুলে যায়।

চ   অনেকে ব্যক্তিবিশেষ বা চিন্তা বিশেষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেই আদলেই গবেষণা কর্ম করতে বসে।

ছ  আবার অনেকে পশ্চিমা ও প্রাচ্যবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের চশমা পরে তবেই গবেষণায় বসে।

সেমিনারে সংস্কারের নামে অপসংস্কারের কিছু দৃষ্টান্তও তুলে ধরা হয়। যেমন,

ক   বড় ধরনের বিভিন্ন পাপকে কুফর সাব্যস্ত করে তাতে লিপ্তদের কাফের আখ্যা দেওয়া।

খ   বৈধ পর্যায়ের কাজকে ফরয ওয়াজিব সাব্যস্ত করা।

গ   আকিদা ও আমলের মাঝে পার্থক্য না করা।

ঘ   হাকেম বা প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত ও নির্দিষ্ট বিধান ও কাজকে জনসাধারণের হাতে তুলে দেওয়া।

সেমিনারে সংস্কারের ক্ষেত্রে আরো অনেক বিচ্যুতি ও প্রান্তিকতা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। সাথে সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সময়ের দাবির উপরও আলোকপাত করা হয়েছে।

ইসলামি চিন্তাধারা সংস্কার ও সময়ের দাবি

আলোচকবৃন্দ বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের জন্য আবশ্যক হল,

ক   তাজদীদ ও সংস্কারের প্রকৃত অর্থ ও স্বরূপ মানুষের সামনে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা।

খ   তাজদীদকে তার প্রকৃত অর্থ ও স্বরূপে ফিরিয়ে আনা এবং তাকে কেন্দ্র করে যেসব ভুল চিন্তা ও প্রান্তিকতা তৈরি হয়েছে, তার অপনোদন করা।

গ   সংস্কারের মতো এই মহান কাজ বিশেষ কোন একক ব্যক্তির নয় বরং তা বিদগ্ধ আলেমদের যৌথ ইজতিহাদের মাধ্যমে হওয়া।

ঘ   সংস্কারের মতো এই মহান ও আবশ্যক দায়িত্ব পালনে শিক্ষা, সংস্কৃতি , গবেষণা, দাওয়াহ ও নৈতিকতা সংক্রান্ত সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসা।

সময়ের এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে আল আযহার কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, “মারকাযুত তাজদীদ ওয়াত তুরাস” নামে একটি সংস্কারমূলক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার এবং এই সেমিনার থেকে চারটি সবিশেষ করণীয় স্থির করা হয়েছে। যথা,

ক   সংস্কার প্রয়োজন এমন সব সমস্যা ও মাসাআলার একটা তালিকা তৈরি করা।

খ   মিশর ও মিশরের বাইরের ধর্মীয় কাউন্সিলগুলোর যৌথ পর্যালোচনার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত বিষয়গুলোতে সময়ের উপযোগী করে যৌথ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।

গ   আরব ও মুসলিম বিশ্বের সকল ফিকহি ও গবেষণামূলক একাডেমির মাঝে সমন্বয় সাধন করা।

ঘ   শীর্ষ আলেম, গবেষক ও চিন্তাবিদ এবং সংস্কার বিষয়ে যাদের বিশেষ পাণ্ডিত্য রয়েছে তাদের আমন্ত্রণ করে তাদের সাথে পর্যালোচনা করা এবং তাদের জ্ঞান সম্ভার থেকে অধিক পরিমাণে উপকৃত হওয়া।

শাইখুল আযহার ড. আহমাদ আত তায়্যিব তার বক্তব্যে সাম্প্রতিক নানান সমস্যার কথা তুলে ধরেন। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিন সংকট নিয়েও কথা বলেন। তিনি গাম্বিয়া সরকার ও তার বিচার মন্ত্রী কে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান যে, তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা, বাস্তুচ্যুতি ও নিধনযজ্ঞের একটি পূর্ণাঙ্গ ফাইল তৈরি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পেশ করেছে। তিনি আরো বলেন, এসব অন্যায় অপরাধ হিসাব নিকাশ ও বিচার ছাড়া কখনো পার হতে দেয়া যাবে না। এ সমস্ত ক্রাইম দেখেও বিশ্ব নিশ্চুপ নিষ্ক্রিয়। এটা বিশ্বের জন্য বড় লজ্জাকর বিষয়।

শাইখুল আযহার সম্প্রতি ট্রাম্পের ঘোষিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আমি চূড়ান্ত পর্যায়ের লজ্জা ও অপমান বোধ করি যে, দেখি, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মিলে আমাদের সমস্যা সমাধানে পরিকল্পনা করছে এবং সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। অথচ না আছে সেখানে কোন আরব আর না কোন মুসলিম। অতঃপর তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রটিতেই আমাদের লড়াই করতে হবে এবং তা আবশ্যক। -আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরকেই বের করতে হবে।-

পূর্ববর্তি সংবাদগাজীপুরে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মসজিদের জমি দখল
পরবর্তি সংবাদপরীক্ষায় নকল করতে না দেওয়ায় হামলা-ভাঙচুর, অংশ নেন অভিভাবকরাও!