নওমুসলিম আবদুল্লাহ কুয়াইলিম: বৃটেনে উসমানি দাওলার প্রথম শায়খুল ইসলাম

ওলিউর রহমান ।।

উইলিয়াম হেনরি। ইসলাম গ্রহণের পর তার নাম হয় আবদুল্লাহ কুয়াইলিয়াম। উসমানি দাওলার পক্ষ থেকে তাঁকে বৃটেনের প্রথম ‘শায়খুল ইসলাম’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব তিনিই আঞ্জাম দেন। বৃটেনের শিল্প-বিপ্লব উত্তর সময়ে তাঁর হাতে ছয়শতের অধিক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।

আবদুল্লাহ কুয়াইলিয়াম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৬ সালে ইংল্যান্ডের লিভারপুলে। ১৮৭৮ সালে শিক্ষা সমাপ্তির পর লিভারপুলের একটি মানবাধিকার সংস্থায় যোগদান করেন তিনি। কুয়াইলিয়াম আর্থ-মানবতার সেবায় নিজেকে এমন নিয়োজিত করেন যে, পত্রিকায় ‘লিভারপুলের ত্রাণকর্তা’ শিরোনামে হরহামেশায় তাঁকে নিয়ে খবর ছাপা হতো।

তিনি প্রকৃতই ত্রাণকর্তা ছিলেন। লিভারপুলের বহু মানুষের পরকালীন মুক্তির ত্রাণকর্তা।

১৮৮৭ সাল। কোনো এককাজে তাঁকে মরক্কো যেতে হয়। এই সফরই তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সফরের মাঝেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর।
ইসলাম গ্রহণের আগে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ, ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি খ্রিস্টানদের অলীক কল্প-বিশ্বাস, এবং ত্রিত্ববাদের ব্যাপারে প্রচণ্ড রকম সংশয় সন্দেহ ছিল আবদুল্লাহ কুয়াইলিয়ামের। তাঁর কিছু ইয়াহুদি বন্ধুর সাথে সে নিয়ে আলাপও হতো তাঁর। তবে ইয়াহুদিদের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল না। আর বৃটেনের মুসলমানরাও প্রাত্যহিক জীবন যাপনে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে ইসলামের ব্যাপারে আবদুল্লাহ কুয়াইলিয়ামের ভুল ধারণাই ছিল। অবশেষে মরক্কোর মরুভূমির যাযাবররা তাঁকে দেখায় সত্য দ্বীনের পথ।

তাঁর ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী দুইটি বক্তব্য বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। ‘বৃটেনের ইসলাম আমাকে মুসলমান বানাতে পারেনি। সেখানে ইসলাম যথেষ্ট নির্যাতিত। মরক্কোর আরব মুসলিম এবং যাযাবরদের সাথে মিশে আমি ইসলামের স্বরূপ বুঝতে পেরেছি’।

তাঁর অপর বক্তব্যটি হল, ‘আলো যেমন একজনের জন্য ফুটে না তেমনি ইসলামের আলো আমার একার জন্য হবে না। গোটা লিভারপুলেই ছড়িয়ে দিব এ আলো’।

মাতৃভূমি বৃটেনের লিভারপুলে ফিরে এসে কুয়াইলিয়াম আল মুতাকাদুল ইসলামি নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বলা হয়ে থাকে, কুয়াইলিম নির্মিত মসজিদটি লিভারপুলের প্রথম মসজিদ। মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি তখন একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আর ব্যক্তিগতভাবে চালিয়ে যান ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসা তিন জায়গা থেকে একযোগে চলতে থাতে দ্বীন প্রচারের কাজ। কেবল তাঁর হাতেই ৬০০-এর বেশি সম্ভ্রান্ত বৃটিশ নাগরিক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ১৮৯৩ সালে মালয়েশিয়া এবং হিন্দুস্তানেও তাঁর গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শাখা খোলা হয়। ১৮৯৩ সালে সে প্রতিষ্ঠান থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হতো। আশিটির অধিক দেশে সে পত্রিকার কপি পৌঁছতো।

১৮৯১ সাল। আর্থ-মানবতার সেবায় নিয়োজিত কুয়াইলিয়ামের পরিচিতি ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই ছিল দিগ্বিদিকে। ইসলাম গ্রহণের পর বৃটেনের বৈরি পরিবেশেও তাঁর কাজের প্রসরতা দেখে তৎকালীন উসমানি সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ তাঁকে তুরস্কে তলব করেন। বেশ ক’বছর তুরস্কে থাকার পর ১৮৯৪ সালে উসমানি দাওলার পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ কুয়াইলিয়ামকে বৃটেনের প্রথম ‘শায়খুল ইসলাম’ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।

শায়খুল ইসলামের দায়িত্ব পেয়ে আবদুল্লাহ তুয়াইলিয়ামের কাজের গতি আরও বেড়ে যায়। দাওয়াতের কাজে তখন ইংল্যান্ডের সব শহরেই তিনি ছুটতে থাকেন। বৃটেনের পুরোনো মুসলমানদের মাঝে দ্বীনী চেতনা পূনর্জারণেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

আর্থ-মানবতার সেবার কারণে তাঁর বিচরণক্ষেত্র ছিল সারা পৃথিবীই। যেখানে মানুষের দুর্দশা তিনি চেষ্টা করতেন সেখানেই পৌঁছুতে।

উসমানি সুলতান আবদুল হামিদের (দ্বিতীয়) ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ কুয়াইলিয়ামকে প্রচণ্ড আকর্ষণ করেছিল। ১৮৯৪ সালের দিকে কিছু সময় নাইজেরিয়ার লাগুস শহরে অবস্থান করলে সেখানে সুলতানের নামে তিনি একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করেন।

১৮৯৬ সালের দিকে ইংল্যান্ডের শায়খুল ইসলাম হিসেবে আবদুল্লাহ কয়াইলিয়ামের একটি ফতোয়া বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সুদানী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৃটেনের পক্ষ হয়ে মিসরের যুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়ার বিরুদ্ধে তিনি বলিষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন। বৃটেনের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে তাঁর কঠোর ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছিল। তার ফতোয়ার কারণে অনেক মিসরি যুবক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে। বৃটেনের বিরুদ্ধে এসবই করেছিলেন তিনি বৃটেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর লিভারপুলে বসবাসরত অবস্থায়। সেজন্য তাঁকে বৃটিশ রাজের অনেক রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল। তবে তিনি দমে থাকেননি কখনো। তাঁকে ছয় বছরের জন্য নির্বাসনও দেওয়া হয়।

অবশেষে ১৯৩২ সালে ৪৫ বছর ইসলামের ওপর জীবন অতিবাহিত করার পর ইন্তিকাল করেন আবদুল্লাহ কুয়ায়লিয়াম। লন্ডনের পাশেই একটি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তুরক প্রেস অবলম্বনে

পূর্ববর্তি সংবাদ‘লেখালেখিও দীনি খেদমতের বড় মাধ্যম’
পরবর্তি সংবাদটান টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে শুরু সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ