আমার দুঃখী মামা

মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব।।

রহস্যঘেরা এই পৃথিবীর অতিদুঃখী একজন মানুষ আমার ছোটমামা। মাঝে মধ্যে খুব কৌতূহল জাগে মামার শেষ সময়টা দেখার। কী হয়? কিভাবে কাটে মামার সমাপ্তিদিবস? হাদীস শরীফে তো আছে, চলতি পথে বান্দার সামান্য হোঁচট খাওয়া কষ্টের বিনিময়েও তার গোনাহ মাফ হয়। মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সে হিসেবে মামার একজীবন কষ্টের বিনিময়ে না জানি কী পুরস্কার অপেক্ষা করছে তার জন্য!

আম্মার কাছে শুনেছি, নানুর ইন্তেকালের সময় ছোটমামা ছিলেন অবুঝ বয়সী। বড় দুই খালারই তখন বিয়ে হয়ে গেছে। ফলে খালাদের আদরযত্নই ছিল মামার বড় সম্বল। তাই বলে তো দিনের পর দিন অন্যের বাড়িতে থাকা যায় না। নিজের বাড়িই মানুষের প্রধান আশ্রয়। কিন্তু মামার জন্যে সেই আশ্রয়টি ছিলো কেন্দ্রহীন। ঘরে মা নেই, এরচে বড় অসহায়ত্ব আর কী আছে ঐ বয়সে?!

নানাজীর অর্থসম্পদ কম ছিল না। দ্বিতীয় নানুর যত্ন-পরিচর্যাও মোটামুটি ছিল। এরপরও ছোটমামার খুব একটা পড়াশোনা হলো না। অথচ বড় মামা সে সময়েই পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার হলেন। কারণ, তিনি কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়তেন। আর ছোটমামা থাকতেন বাড়িতে। ফলে সংসারের প্রায় যাবতীয় টুকরো কাজই তাকে করতে হতো। তখন পড়াশোনাটা হয়ে যেত কেবলই আনুষ্ঠানিকতা।

আমি যদ্দুর বুঝি, অসম্ভব অনুভূতিশক্তি ছিল মামার। মেধা প্রতিভা ছিলো। স্বপ্ন সাহস ছিল। ত্যাগের মানসিকতাও ছিল। কিন্তু কী যেন ছিল না। আর সেই না থাকার অনুভূতি মামাকে ভারাক্রান্ত এবং হীনমন্য করে তুলেছিল। মামা তখন বিজন মাঠে গিয়ে বাঁশি বাজাতেন। বাঁশের বাঁশি। বড় করুণ সুর বাজতো নাকি সেই বাঁশিতে।

এভাবেই অনেকটা জীবন পার হয়ে গেল মামার। নানাজী তাকে বিয়ে করালেন। কিন্তু তার উপার্জনের কোন ব্যবস্থা নেই। যেটুকু পড়াশোনা করেছেন তা দিয়ে চাকুরী পাওয়াও মুশকিল। তাই ছোটখাট একটা কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলেন। গ্রামের হাটে হাটে সাইকেলে করে নিয়ে যেতেন কাপড়ের গাট্টি। দুপুরে হাট বসতো। সন্ধ্যা হবার পরই ভেঙ্গে যেতো। এই সময়টুকুই মামার বেচাকেনা।

একদিন হাট থেকে ফেরার পথে ডাকাতের কবলে পড়ল মামার দোকান। তখন শুধু প্রাণ ভিক্ষা পেয়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন। এরপর আবার কিছু টাকা জোগাড় করে মুদি দোকান দিলেন তিনি। সেই বর্ণনা আরো দীর্ঘ।

এক পর্যায়ে মামা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই দেশে তিনি থাকবেন না। কতজন কত সান্ত্বনা দিলো। কতকিছু বোঝাল! কিন্তু মামা তার সিদ্ধান্তে অটল। হঠাৎ করে আমরা শুনলাম, ছোটমামা সৌদি চলে যাচ্ছেন। নবীজির দেশে। একটু শান্তি বুঝি ওখানেই মিলবে। কিন্তু সে দেশে যাবার খরচ বিমানভাড়া ভিসামূল্য কিছুই নেই মামার কাছে। তিনি ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে রাজি হয়ে গেলেন। এবং এ ব্যাপারে কারো কোন কথাই শুনলেন না। মামার বক্তব্য—এই দেশ আমাকে আপন করে নিচ্ছে না। এদেশে থাকার ইচ্ছা আমার আর নেই।

মামা তার বাবার ভিটা বিক্রি করে বিদেশে গেলেন। এক বছর দুই বছর অনেক বছর। ভালো কোন ব্যবস্থা মামার হলো না। সে সময় আত্মীয়স্বজনের সাথে তিনি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। তৃপ্তি মিটত না। মোবাইল ফোনের ব্যবহার তখনো সাধারণ মানুষের নাগালে আসেনি। তাই তিনি তার দুঃখের কথা অডিও ক্যাসেটে রেকর্ড করে পাঠাতেন। আত্মীয়স্বজন তার সেই কথা শুনতেন আর কাঁদতেন। শোনতে থাকতেন আর কাঁদতে থাকতেন। আমরা তখনো ছোট। তবু অল্প অল্প বুঝতাম সেই দুঃখ। আবেগময় সেই উপাখ্যান।

একবার দুইটা ক্যাসেট ভর্তি করে মামা কথা পাঠালেন। বড় করুণ দুইটা গান ছিল তার ভেতর। একটা গান আমি মুখস্থ করেছিলাম। আরেকটা করেছিল আমার বড় বোন। গানদু’টি এখনো মনে পড়লে চোখে জল এসে যায়।

ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী # জীবন খেলায় হারাইলাম সবি,

বুকে জমাট বাধা অভিমান # কী নিঠুর এই নিয়তির বিধান।

মামা এই দেশের মাটি ছেড়ে চলে গেছেন। জীবনের রণে ভঙ্গ দিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে সবকিছু হারিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যদেশে। দূরের দেশ। যেন ভিন্ন জগত। কেউ তার জন্যে কিছুই করেনি। কিংবা করতে পারেনি। কী নিঠুর মামার নিয়তি। বুকটা হু হু করে উঠে। মামা! সান্ত্বনা দেওয়ার কোন শব্দ বাক্য আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

একদিন সংবাদ এল। কাজ করতে গিয়ে একটা উঁচু দালান থেকে পড়ে মামার মরণাপন্ন অবস্থা। আমরা শুধু শোনলাম আর দোয়া করতে থাকলাম। দূরদেশ থেকে এরচে বেশি কিছু করার সাধ্য আমাদের আছে বলে মনে হলো না। চিকিৎসাধীন মামা হঠাৎ দেশে ফিরে এলেন কিংবা ফিরিয়ে দেয়া হলো। একটা হাত ভাঙ্গা। এছাড়া বাকি শরীর মোটামুটি সুস্থ। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন। কিছুদিন মামা নিজের দেশে থাকলেন। এরপর আবার চলে গেলেন। এবার গেলেন সম্ভবত মালয়েশিয়া। কয়েকবছর সেখানেও কাটল। কিন্তু সেই যে নিষ্ঠুর নিয়তি! মামার সুযোগসুবিধা ওখানেও হলো না। এদিকে দেশের মাটি প্রায় সোনার দামে বিক্রি হচ্ছে। চারপাশে শত শত মিল কারখানা গড়ে ওঠছে। মামার দেশে কোন ভিটে নেই। সস্তাদামে সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন অনেক আগে। বাবার ভিটের দরদে মামা আবার দেশে ফিরলেন। অনেক কষ্টে অর্জিত অর্থ দিয়ে স্ত্রী-সন্তানের দিকে তাকিয়ে একখণ্ড জমি কিনলেন চাচাত ভাইদের কাছ থেকে। তবুও তো দাদার ভিটে! এরপর মামা তার মতো করে আবার চলে গেলেন। অনেক কষ্টের কাজ ওখানে। কিন্তু মামা ধরে নিচ্ছেন তার জীবনটা এমনই। কষ্টই তার স্বাভাবিকতা। ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কিসের?’ এবার সাততলা থেকে পড়ে মামার একটা পা ভেঙে  গেল। ভাঙ্গা পা নিয়ে মামা দেশে এসেছিলেন কয়েকবছর আগে। এরপর আবার সেই ভাঙ্গা পা নিয়েই চলে গেছেন। এখন পা সেরেছে। কোম্পানি নাকি তাকে অনেক সুবিধাও দিয়েছে। বসে বসে কাজ করেন। বেতনও ভালো। আদর্শ মানুষ হিসেবে তিনি অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন সাথীদের মাঝে। এবারের রমজানে নাকি সবাই তার পেছনে তারাবি পড়তে চেয়েছে। তিনি রাজি হয়েছেন। ফোনে আমাকে মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। মামার মন ভালো বুঝতে পেরে আমার অনেক খুশি লাগলো। তাকে বললাম, আপনি দেশে আসুন। আপনাকে আমি ভালো কিছু দীনি বই পড়তে দেব। আপনার কুরআন তেলাওয়াতের বিশুদ্ধতা নিয়েও কথা হবে। এর কয়েকমাসের মধ্যেই শোনলাম, মামা দেশে আসছেন। অবাক কাণ্ড! সত্যি সত্যিই মামা দেশে এলেন। আমাদের বাড়িতে গেলেন। আমি তখন ভীষণ অসুস্থ। তবুও প্রায় পুরো এক রাত গল্প হলো। ওয়াদামতো কুরআন তেলাওয়াতের মশক হলো। মামার পছন্দমত কয়েকটা বই হাদিয়া দিলাম। মামা অসম্ভব খুশি হলেন। প্রত্যেকটা বইয়ের শুরুতে টুকরো টুকরো কিছু বাক্য লেখলাম। বাক্যগুলো পড়ে মামা যেন কী অব্যক্ত কথা আমাকে বোঝাতে চাইলেন! আমি বুঝে নিলাম, তিনি এখন নতুন করে জীবনের প্রস্তুতি নিতে চাচ্ছেন।

মামা, আপনার প্রস্তুতি কি সমাপ্ত হয়েছিল? আপনি কি আবারও চলে যেতে চেয়েছিলেন বিদেশে? এখন যে দেশে আছেন কেমন লাগছে সে দেশে? মাত্র সারে তিন হাত একটা ঘর। তাই না মামা? পছন্দ হয়েছে আপনার নতুন ঘরটা? বিশ্বাস করুন মামা, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।

নোট: শেষ প্যারাটা পড়লে যে কেউ ভাববেন, আমার মামা ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু এখনো সেই বাস্তবতায় তিনি পৌঁছতে পারেননি। তবুও আমি এভাবে লেখলাম। কারণ আমার বিশ্বাস, এ লেখাটি মামার চোখে পড়বে। লেখাটা পড়ে তার ভাবনায় হয়তো নতুন কোন মাত্রা যোগ হবে। তাছাড়া জীবিত অবস্থায় নিজের মৃত্যুসংবাদ শোনতে কেমন লাগে সেই অনুভূতিও অর্জন হবে মামার। এটুকু কি কম? তাছাড়া মামার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

পূর্ববর্তি সংবাদলালদীঘি মাঠে ২৪ জনকে গুলি করে হত্যা: ৫ পুলিশের মৃত্যুদণ্ড
পরবর্তি সংবাদআবারও ময়মনসিংহে ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত