আহ! উস্তাযে মুহতারাম বুরহানুদ্দীন সাম্ভলী রহ.

মুহাম্মদ সাবের হুসাইন নদভী ।।

১৬-০ ১- ২০২০ জুমাবার দিবাগত রাত ৪টার দিকে বজ্রপাতের মতই খবর এল, আমার মুহতারাম উস্তায, বিশিষ্ট মুহাক্কিক আলেম মাওলানা বুরহানুদ্দীন সম্ভলী দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। ইন্ন লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

খবরটি শোনার সাথে আমার ছাত্র যামানার কথা এবং  উস্তাযে মুহতারামের  স্মৃতিগুলো একে একে মনে পড়ে গেল। কেমন দরিয়া দিল মানুষ, ঠান্ডা মেযাজ, সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল চেহারার অধিকারী, কুরআনের আশেক, ফিকহ ফতোয়ার মাহের উস্তায, উপযোগী পুরোনো ইলম এবং উপকারী নতুন ইলমের সমন্বয়কারী, মাথায় পুরোনো দু পাল্লার টুপি, পরনে পুরোনো ধাচের শেলোয়ার-কোর্তা-শেরোয়ানি, ফর্সা গোলগাল চেহারার অধিকারী, হুইল চেয়ারে করে নদওয়ার গেট দিয়ে আসছেন যাচ্ছেন। ছাত্ররা এগিয়ে গিয়ে সালাম দিচ্ছেন আর তিনি ছাত্রদের সালামের জবাব দিচ্ছেন।

উস্তাযে মুহতারাম বুরহানুদ্দীন সাম্ভলী সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. এর অনেক প্রিয়ভাজন ছিলেন। ১৯৭০ সনে আবুল হাসান আলী নদভী রহ.- এর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা লক্ষনৌয় উস্তায হিসাবে যোগ দান করেন। এবং আমৃত্যু সেখানে হাদিসের মসদনে ইলমে নববীর দ্যুতি ছড়াতে থাকেন।

উস্তাযে মুহতারাম নদওয়াতুল উলামার শায়েখে তাফসীর এবং মজলিসে তাহকীকাতে শারইয়্যার সদর ছিলেন। তিনি  ইসলামী ফিকাহ্ একাডেমীরও নায়েবে সদর ছিলেন। তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা ও গ্রন্থ রয়েছে। “معاشرتی مسائل اور ان کا حل” তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।

২০১১-১২ সনের দিকে  আমি তার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করি। কিন্তু আফসোস এই সময়ই তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। এবং তারপর থেকে তাকে হুইল চেয়ারে চলা ফেরা করতে হত। মুখের আওয়াজ অনেক ছোট হয়ে গিয়ে ছিল। তারপরও তিনি দরস করাতেন এবং বিভিন্ন ইলমী বিষয়ে আলোচনা করতেন।

হযরত উস্তাযে মুহতারাম প্রায় বার বছর ধরে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ছিলেন। তখন অনেক কষ্টকর অবস্থাতে থাকতেন। কিন্তু শারীরিক এই কষ্টের আছর কখনোই তার চেহারায় পড়েনি। দেখলে তাকে সব সময় হাসিখুশীই মনে হত। মুখে কোনোদিন অভিযোগের টু উব্দটিও উচ্চারণ করেননি। এই অবস্থাতেও সবসময় সাহস ও উচ্চাকাঙ্খার কথা বলতেন। বিভিন্ন ইলমী সূক্ষ্মজটিল বিষয়েও আলোচনা করতেন।

এই শয্যাশায়ী অসুস্থতার মধ্যে তার পরিচ্ছন্ন মেযাজের অবস্থা ছিল এমন যে, বিশ্বাস করার মত নয়। কোনো নওজোয়ানও হয়তো তার যৌবন কালে এত পরিচ্ছন্ন থাকে না যে পরিচ্ছন্ন তিনি এই বার্ধক্যে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন।

ছাত্ররা কেউ তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি তাদের সাথে এমনভাবে সাক্ষাত করতেন যেন মনে হত সে তার কোনো আত্মীয়।

তার অনেক বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি ছিলেন সত্যভাষী এবং সত্য বলার ক্ষেত্রে তিনি কাউকে ছাড় দিতেন না ।

তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ব্যস্ততা ছিল ইলমী ব্যস্ততা এবং দরস তাদরীস। অসুস্থতার কারণে নদওয়া থেকে রিটায়ার্ড হওয়ার পরেও তিনি নিয়মিত নদওয়ায় দরস তাদরীসে লেগে ছিলেন। বিভিন্ন ইলমী সেমিনার সেম্পোজিয়ামেও অংশ নিতেন। ইসলামিক ফিকহ একাডেমির সেমিনারে অংশ গ্রহণের জন্যে  দূরদূরান্তের সফর করতেন। হযরতের শারীরিক অসুস্থতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময়ই ওযর পেশ করার চিন্তা হত কিন্তু হযরতের মানসিক দৃঢ়তা ও উচ্চমনোবলের সামনে তার অসুস্থতা সব সময়ই পরাজিত হয়েছে।

মনে পড়ে, এক সাক্ষাতে হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা নোমান ছাহেব নদভী  বলেছিলেন, তার বাবা জামাতের নামাজের বেশ পাবন্দ। এবং সেজদায় তিনি সীমাহীন আনন্দ পান। … প্যারালাইসিসের পর হুইল চেয়ারে চলাফেরার সময় তার সব চেয়ে কষ্ট যে, তিনি মাটিতে সেজদা দিতে পারছেন না।

হযরত এখন আমাদের মাঝে নেই। তার ইন্তিকালে একদিকে তার জন্যে মন থেকে দোয়াও আসে। আরেকদিকে মনে হয়, তার ইন্তিকালে আমরা এক মহান পিতা, মহান অভিভাবক হারিয়ে এতীম হয়ে গেলাম। আল্লাহ হযরতকে ভরপুর মাগফিরাত করুন। এবং তার কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন। আমীন।

অনুবাদ : এনাম হাসান জুনাইদ।।

পূর্ববর্তি সংবাদইয়ামেনে সেনা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে হুতি বাহিনীর হামলা, নিহত ৬০
পরবর্তি সংবাদইজতেমায়‌ মাদরাসাছাত্রদের হয়রানি : এতাতিদের আলেম বিদ্বেষের আরেক প্রমাণ