ওয়ায মাহফিল : কী করণীয়, কী বর্জনীয়

মুফতি মনসুরুল হক ।।

দৈনন্দিন জীবনে মহান আল্লাহ পাকের বিধি-বিধান সঠিকভাবে পালনার্থে দ্বীনের সুস্থ জযবা ও চেতনা ধারণ করা এবং এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কুরআন-হাদীসের ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের জন্য ফরযে আইন। আর দীনী মাহফিলের দ্বারা আসল উদ্দেশ্য হলো দ্বীনের জযবা তৈরি করা এবং ইলমে দীন শিক্ষা করা। সুতরাং প্রত্যেক এলাকায় সচেতন দ্বীনদার ভাইদের উদ্যোগে বৎসরে একাধিক বার দীনী মাহফিলের আয়োজন করা উচিত।

তবে মাহফিল দ্বারা উদ্দিষ্ট লক্ষ্য যেন অর্জিত হয়- সে জন্য দ্বীনী মাহফিল করার সঠিক পদ্ধতি জানা আবশ্যক।

বক্তা ও মেহমান নির্বাচন প্রসঙ্গ

১. হাকীমুল উম্মাত থানভী রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা হযরত ডাক্তার আব্দুল হাই আরেফী রহ. হযরত হাকীমুল উম্মাতের বয়ানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন- তাঁর বয়ান শুনার দ্বারা শ্রোতাদের অন্তঃকরণ আলোকিত হতো, দৃষ্টিভঙ্গির পরিশুদ্ধি এবং দ্বীনের সমঝ পয়দা হতো। হযরতের বয়ানের বিশেষ দিক এই ছিলো যে, তাতে হক-বাতিলের পার্থক্য, আকীদা-বিশ্বাসের দৃঢ়তা, দ্বীনের সঠিক ও সুস্থ চেতনা এমনভাবে সৃষ্টি হতো যে, নাস্তিকতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তির অন্তরও সত্যের আলোয় আলোকিত হতো, দ্বিধা- দ্বন্দ্ব এবং কল্পনা ও সন্দেহ থেকে মন মস্তিষ্ক নিস্কলুষ হয়ে যেতো। শয়তানের প্ররোচনার জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। বর্ণনাশৈলিতে এতটাই মুগ্ধতা ছিলো যে, শ্রোতাদের অন্তর আল্লাহর মুহাব্বাতের সাগরে অবগাহন করে সিক্ত এবং তৃপ্ত হতো। কবির এ বক্তব্যের যথার্থতা পুরোপুরি দৃষ্টিগোচর হতো- از دل خیزدبر دل ریزد ‘অন্তর থেকে নিঃসৃত হয়ে অন্তরে গিয়ে আঘাত করতো!’ কাজেই দ্বীনী মাহফিলের বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এমন হক্কানী আল্লাহওয়ালা উলামায়ে কিরামকে দাওয়াত দেয়া উচিত, যাদের বয়ানে উল্লিখিত গুনাবলী বিদ্যমান থাকে।

২. এমন বক্তাকে দাওয়াত দেয়ার ব্যাপারে প্রাধান্য দেওয়া উচিত যারা ওয়াজের বিনিময় গ্রহণ করেন না । কারণ ওয়ায করা আম্বিয়ায়ে কেরাম আ.-এর কাজ। আর এ কাজ দ্বারা তখনই উম্মতের ফায়দা হয় যখন তা নবীগণ আ.-এর তরীকায় করা হয়। আর কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে আছে যে, নবীগণ আ. ওয়াজের বিনিময় গ্রহণ করতেন না। তাঁরা একমাত্র আল্লাহ থেকে বিনিময় পাওয়ার আশায় ওয়ায করতেন। (সূরায়ে ইয়াসীন:২১ শু‘আরা: ১২৭)

৩. কোন জাহেলকে বক্তা বানানো জায়িয নয়। চাই সে যত সুন্দর বয়ানই করুক না কেন। কারণ এটা ক্বিয়ামতের আলামত। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৫৯, ১০০)

৪. অপরিচিত/অজ্ঞাত কোনো বক্তা-যার ইলম ও আমল সম্পর্কে হক্কানী আলেম সমাজ অবগত নয়-এমন কাউকে দাওয়াত না দেওয়া।

৫. বে-আমল আলেম কোন আলেমকে বক্তা করে দাওয়াত দেওয়া ঠিক না। কারণ এ ধরণের বক্তার বয়ানের দ্বারা জনগণের মধ্যে দীনের পরিবর্তে বদ দীনী সৃষ্টি হয়। (সূরায়ে বাকারা: ৪৪, মুসলিম শরীফ ১/৮৪, শু‘আবুল ঈমান-বাইহাকী হাঃ নং ৯০১৬, ৯০১৮)

৬. এমন বক্তাদেরকে দাওয়াত না করা যারা ওয়াজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। একজন আলিম যখন ওয়াজকে তার জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে তখন স্বাভাবিক ভাবে ও পেশাগত স্বার্থে তাকে এমন কিছু উপায় ও কৌশল গ্রহণ করতে হয় যা ওয়াজের প্রভাব ও সুফল নষ্ট করে দেয়। যেমন: এ ধরণের বক্তা সাধারণত চুক্তি করে টাকা নিয়ে থাকে। যা আম্বিয়া আ.-এর সুন্নাত পরিপন্থি। তাছাড়া এ সকল বক্তাগণ শ্রোতাদের মুগ্ধ করার ও আকৃষ্ট করার জন্য কথায়, সুরে ও বচন ভঙ্গীতে লৌকিকতা ও কৃত্রিমতার বেশি বাড়াবাড়ি করে থাকে। অথচ হাদীসে এসেছে যে, ‘‘যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্যে আসমানী জ্ঞান শিক্ষা করবে যে, তা দ্বারা বিতর্কে আলিমদের পরাজিত করবে অথবা তা দ্বারা মূর্খদের অবদমিত করবে অথবা তা দ্বারা জনসাধারণকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে আল্লাহ তাআলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন”। (তিরমিযী: ২৬৫৪)

৭. যে সকল বক্তা মাজার-ওরসকেন্দ্রিক সুন্নাহ বিরোধি বিভিন্ন বিদআতের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করে এবং হক্কানী উলামায়ে কেরামের প্রতি জনসাধারণকে ‘আস্থাহীন’ করার লক্ষ্যে তাদেরকে গালমন্দ করে-তাদেরকে দাওয়াত না দেওয়া।

৮. হক্কানী উলামায়ে কেরামের মত ও পথ ‘দেওবন্দি আকীদা-বিশ্বাস’ হতে বিচ্যুত মাযহাব বিরোধি কোনো বাতিল ফেরকা বা মতবাদের অনুসারীদের দাওয়াত না দেয়া।

৯. প্রকাশ্য ফাসেক বে-আমল কোন লোককে মাহফিলের সভাপতি বা পরিচালক কিংবা বিশেষ অতিথি ইত্যাদি না বানানো। এতে খোদাদ্রোহীদের সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এতে আল্লাহর আরশ কম্পিত হয়। এটা হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৫৯)

১০. টাকা-পয়সা কালেকশনের জন্য কোনো বক্তাকে দাওয়াত না দেওয়া। কেননা, মাহফিলের নাম দিয়ে টাকা কালেশন করা জাতির সাথে প্রতারণার শামিল।

বয়ানের বিষয়বস্তু

১. হযরত ডাক্তার আব্দুল হাই আরেফী রহ. হযরত থানভী রহ. এর বয়ানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন- হযরতের বয়ান অধ্যয়নের দ্বারা এ বিষয়ের সুস্পষ্ট অবগতি হবে যে, কুরআনের কারীমে আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার জন্য কী আদেশ-নিষেধ রয়েছে? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ও কর্ম কেমন ছিলো? সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত কী ছিলো? মুফাস্ধিসঢ়;রীন, মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা এবং সুফিয়ায়ে কেরাম কারা ছিলেন? এবং তাদের বৈশিষ্ট্যই বা কী ছিলো? মাযহাবের ইমামগণের মতভেদ কী কারণে? ইসলামী দর্শন বলতে কী বুঝায়? নফস এবং শয়তান মানুষের জীবনের উপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়? মুসলমানদের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির সঠিক কর্মপন্থা কী? দুনিয়াবী ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বিনোদন-ভ্রমনের ক্ষেত্রে ইসলামী রীতি-নীতি কী? জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে মুসলমানদের আবিস্কার কী ছিলো? মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং খানকাহগুলো কীভাবে মুসলমানদের জন্য হিদায়াত ও পথনির্দেশকে পরিণত হয়েছিলো? পারিবারিক ও সামাজিকভাবে একজন মুসলমানের জীবনধারা কেমন হওয়া উচিত? সামাজিক প্রথা এবং বিদাআত মুসলমানদের কতটা দ্বীনী ক্ষতি সাধন করেছে? ইংরেজি শিক্ষা ও কৃষ্টি-কালচারের দ্বারা মুসলমানদের স্বভাব-চরিত্র কতটা বিষাক্ত হয়েছে..? [মাআসিরে হাকীমুল উম্মাত-পৃষ্ঠা নং ৩৩৪]

কাজেই হক্কানী এবং বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের উচিত দ্বীনের জরুরী সকল বিষয়ে প্রামাণ্য আলোচনা করা। অপ্রয়োজনীয় আলোচনা থেকে বিরত থাকা। ওয়াজের মধ্যে ভিত্তিহীন কিসসা-কাহিনী বলে শ্রোতাদের হাসানো বা কাঁদানোর বদ রসম থেকে বিরত থাকা উচিত। (মুসলিম শরীফ হাদীস নং ৫০৫)

২. বয়ানের মধ্যে তারগীবী কথার সাথে যে পাঁচটি বিষয়ের ইলম অর্জন করা ফরযে আইন তথা: আক্কাইদ, ইবাদাত, মু‘আমালাত (লেন-দেন), মু‘আশারাত (সামাজিকতা) এবং আখলাক (আত্মশুদ্ধি) তার উপর আলোচনা করা উচিত। এরজন্য ওয়ায়েজীনদের মধ্যে ওয়াজের বিষয়বস্তু বণ্টন করে দেয়া ভাল। (সূরায়ে বাকারা:১৭৭, বুখারী শরীফ হাঃ নং ৫০, মুসলিম শরীফ হাঃ নং ৯)

৩. মাহফিলের মধ্যে সুন্নাতের আলোচনা করা এবং নামাযসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আমলের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেওয়া। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বরং এটা মাহফিলের মূল উদ্দেশ্যও হওয়া উচিত। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৭৭)

৪. মাহফিলের মধ্যে কোন হক্কানী পীর শ্রোতাদের যিকিরের মশক করাতে চাইলে মাইক ছাড়াই করানো উচিত। মাইকে যিকির করা শরী‘আতের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয়। এতে আশপাশের মসজিদে এবং লোকদের অনেক সমস্যা হয়। তাছাড়া আজকাল হক্বানী পীর নয় এমন বক্তাও নিজের খেয়াল-খুশী মত যিকির করাতে আরম্ভ করে। এটাও ঠিক নয়। (সুরায়ে আ‘রাফ: ২০৫, মুসনাদে আহমাদ হাদীস নং ১৯৪৯৫)

প্রচলিত ওয়ায মাহফিলের বর্জনীয় বিষয়

১. যেহেতু দীর্ঘ সময়ব্যাপী ওয়ায সাধারণ মানুষ মনে রাখতে পারে না। এজন্য রাত ১০/১১টার মধ্যেই আলোচনা করে মাহফিল শেষ করা উচিত। আজকাল অনেক স্থানে সারা রাত ওয়ায করার নিয়ম চালু হয়ে গেছে। এটা বন্ধ করা উচিত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ততক্ষণ ওয়ায করতে বলেছেন যতক্ষণ লোকদের আগ্রহ থাকে। আর সাধারণত মানুষের কমজোরীর কারণে সারা রাত আগ্রহ থাকে না। উপরন্তু এ দীর্ঘ রাতজাগা ওয়ায প্রত্যুষে অধিকাংশ শ্রোতারই মনে থাকে না। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭)

২. দুর-দুরান্ত পর্যন্ত না দিয়ে মাহফিলের মাইক ব্যবস্থা প্যান্ডেলের সীমার মধ্যে রাখা আবশ্যক। যেন আগ্রহীরা ময়দানে চলে আসে এবং ব্যস্ত, অসুস্থ, ইবাদাতে মগ্ন ব্যক্তিদের কাজে, বিশ্রামে কিংবা ইবাদাতে বিঘ্ন না ঘটে। কেননা, কথা কিংবা কাজে ব্যস্ত লোকাদেরকে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় দ্বীনী নসীহত করতে হাদীসে পাকে নিষেধ করা হয়েছে। যেহেতু এর দ্বারা সে বিরক্ত হবে এবং তার কাজে বিঘ্নতা সৃষ্টি হবে। (বুখারী, হাদীস নং ৬৩৩৭)

৩. ওয়াজের মাঝে স্থানীয় মসজিদসমূহের সময়সূচী অনুযায়ী ইশার নামায জামা‘আত করে নেওয়া কর্তব্য।কেননা, আগে-পরে ইশার নামায আদায় করলে মাহফিলের মাইকের দ্বারা পার্শ্ববর্তী এলাকার মসজিদের জামা‘আতের সমস্যা হয় এবং মাহফিলে উপস্থিত মুসল্লীগণ ইশার জামা‘আতের ব্যাপারে পেরেশান হয়। অনেক স্থানে দীর্ঘ রাতব্যাপী ওয়ায হওয়ার পর ইশার নামায মাকরুহ ওয়াক্তে পড়া হয়। যা অবশ্য পরিত্যাজ্য। (সুরায়ে নিসা: ১০৩, বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬২৪৫)

৪. লোকদের ওয়ায মাহফিলের দাওয়াত দিয়ে তাদের থেকে চাঁদা কালেকশন করা অনুচিত। কারণ প্রচারপত্রে ওয়ায শুনানোর ঘোষনা বা ওয়াদা করা হয়। চাঁদার প্রয়োজন হলে জনসাধারণদের ডেকে পরামর্শ সভা করবে। এবং সাহায্যের আবেদন করবে। (সূরায়ে বাকারা: ৪০)

৫. ওয়াজের শেষে আম দাওয়াত ও শিরনী তাবরকের নামে কোন কিছু বিতরণের ব্যবস্থা না করাই ভাল। এতে লোকদের তাওয়াজ্জুহ ওয়াজের দিকে না থেকে খানার দিকে থাকে। সেক্ষেত্রে বয়ানের দ্বারা কোন উপকার হয় না। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ২৬৯৭, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১৭১৮, রদ্দুল মুহতার: ২/১৪০)

৬. ওয়ায মাহফিল জমানোর জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা নিন্দনীয়। কারণ এ কাজের জন্য কুরআন নাযিল হয়নি। এর পরিবর্তে গজল ইত্যাদি বা মাদরাসার মাহফিল হলে ছাত্রদের বিভিন্ন প্রদর্শনী পেশ করা যেতে পারে। নিয়মিত বয়ান- ওয়ায শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে খায়ের ও বরকতের জন্য তিলাওয়াতের দ্বারা শুরু করা। তিলাওয়াতের সময় সকলেই কুরআন তিলাওয়াতে মনযোগ দিয়ে ও তিলাওয়াতের আদবের দিকে লক্ষ্য রেখে শুনবে (আলমগীরী:৫/৩১৫, রদ্দুল মুহতার: ১/৫১৮)

৭. চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে মাহফিল করো অপছন্দনীয়। এতে লোকদের কষ্ট দেয়া হয়, যা শরী‘আত বিরোধী কাজ। সুতরাং মসজিদ বা কোন মাঠ-ময়দানের মধ্যে মাহফিলের ব্যবস্থা করা উচিত। (যিকর ও ফিকর: ১৪৩)

৮. মাহফিলের রাস্তার মধ্যে কোন গেইট বা তোরণ বানাবে না। রঙ বেরঙের পতাকা লাগাবে না। নিছক বিলাসিতা ও শৌখিনতার জন্য রঙবেরঙের বাহারি বাতি জ্বালানো বা তোরণ নির্মাণ করার দ্বারা ধর্মীয় গাম্ভীর্যতা এবং আধ্যাত্মিকতা নষ্ট হয়। এ ধরণের আয়োজন অগ্নীপূজক ও মূর্তিপূজকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। উপরন্তু তা অপচয়ের শামিল। বিজাতীয় অনুকরণ আর অপচয় সম্পূর্ণ হারাম! (সূরায়ে বনী ইসরাইল: ২৭, ইবনে মাজা হাদীস নং ৪২৫, যিকর ও ফিকর: ২৫)

৯. অনেক বক্তা চা পানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষে লোকদেরকে মীলাদ-দুরূদে লাগিয়ে সে সুযোগে চা পান করেন । এটা দৃষ্টিকটু কাজ। দীনী উদ্দেশ্যবিহীন এ ধরণের দরূদ পড়াও নিষেধ। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী: ১১/১৬৭)

১০. মাহফিলের পোস্টার, লিফলেট বা প্রচারপত্রে দিন, তারিখ ও স্থান উল্লেখ করলেই চলে। বক্তাদের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। মানুষদেরকে ব্যক্তির আকর্ষণে জমা করা ঠিক নয়। কারণ ব্যক্তি চিরকাল থাকে না। এমনকি (আল্লাহ না করুক) অনেক ব্যক্তি হকের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির অনুসারীরাও বিভ্রান্ত হয়ে যাবে! [আল্লাহ হিফাযত করেন। আমীন!] (মিশকাতুল মাসাবীহ হাদীস নং ১৯৩)

১১. কোন বক্তার আগমনে না‘রায়ে তাকবীর বা অন্য কোন শ্লোগান দেওয়া সুন্নাতের খেলাফ। বিশেষ করে ওয়াজের মধ্যে কোন বক্তার আগমনে বক্তার বয়ান বন্ধ করে কোন কথার শ্লোগান দেওয়া গর্হিত কাজ। কুরআন-সুন্নাহ এর আলোচনা অনেক উচু কাজ। কারো আগমনে তা বন্ধ করার অবকাশ নাই। কোন বক্তার ব্যাপারে “প্রধান আকর্ষণ”, “জলসার মধ্যমনি” ইত্যদি বলে অন্যান্য উলামাদের হেয় করবে না। কারণ সকল হক্বানী আলেমই সম্মানিত। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী: ১১/১৬৭)

১২. সিএনজি অটোরিকশার মতো যানবাহন যেসব রাস্তায় চলে, এর আশপাশে যদি কোনো মাহফিল হয়, তবে কখনো দেখা যায়, ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে এমন প্রতিটি যানবাহনকে মাহফিলের আয়োজকরা আটকিয়ে দিয়ে মাহফিলের জন্যে টাকা আদায় করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাত্রীদের কেউ টাকা না দেয়া পর্যন্ত ওই গাড়িটিকেও ছাড়া হচ্ছে না। অথচ কেউ যদি স্বেচ্ছায় টাকা দিয়ে অংশগ্রহণ না করে, তার কাছ থেকে যদি চাপাচাপি করে টাকা আদায় করা হয়, এ টাকা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম হবে! (মুসনাদে আহমাদ; হাদীস নং ২০৬৯৫)

১৩. অনেক মাহফিলে মহিলাদের প্যান্ডেলে প্রজেক্টর স্থাপন করে মহিলা শ্রোতাদের জন্য বক্তাকে সরাসরি দেখার ব্যবস্থা করা হয়। এটা খুবই আপত্তিকর একটি ত্রুটি। অথচ মহানবী (স.) এর প্রিয় স্ত্রী হজরত উম্মে সালামা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমি এবং মাইমুনা (রা.) রসূলের (স.) কাছে ছিলাম। তখন সেখানে আগমন করলেন অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)। রসূল (স.) আমাদের বললেন, “তোমরা তার থেকে আড়ালে চলে যাও।” আমরা নিবেদন করলাম, সে তো অন্ধ। আমাদের দেখবে না, চিনবে না। তাহলে আমরা আড়ালে যাব কেন? তিনি উত্তরে বললেন, “তোমরা তো অন্ধ না। তোমরা তো তাকে দেখবে।” (আবু দাউদ ঃ ৪১১৪)

এ হাদীস প্রমাণ করছে পুরুষদের জন্য যেমন অনুমতি নেই বিনা প্রয়োজনে পরনারী দেখার তেমনি নারীদের জন্যও অনুমতি নেই বিনা প্রয়োজনে পর-পুরুষকে দেখার।

 ওয়ায মাহফিলে মহিলাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গ

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দ্বীনের জরুরী ইলম শিক্ষা করা নারীদের উপরও ফরয। তবে এর শরীআতসম্মত পদ্ধতি হলো ঘরের পুরুষরা দ্বীন শিখে তাদের নারীদেরকে শেখাবে। নারীরা শিখে ঘরের মেয়েদেরকে অনুরূপভাবে আশপাশের মেয়েদেরকে সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন মাজীদ শেখাবে, প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল শেখাবে, হক্কানী উলামায়ে কেরামের রচিত কিতাব থেকে ওয়ায-নসীহত শুনাবে। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মাহরাম পুরুষের তত্ত্বাবধানে হক্কানী আলেম ও বুযুর্গদের ঘরোয়া পরিবেশে এনে পর্দা-পুশিদার সাথে ওয়ায -নসীহত শুনবে। সহীহ বুখারী ও সহীহ ইবনে হিব্বানে বর্ণিত হয়েছে, একবার কিছু সংখ্যক নারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার মজলিসে পুরুষদের সাথে বসতে পারি না। আমাদের জন্য একটি দিন ধার্য করুন, যাতে সেদিনটিতে আমরা আপনার থেকে নসীহত শুনতে পারি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন موعدكن بيت فلانة অর্থাৎ নির্ধারিত দিন অমুক মহিলার ঘরে জমায়েত হও। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাদেরকে ওয়ায-নসীহত করলেন। -(সহীহ বুখারী, হাদীস ১০১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯৪১)

ইসলামের প্রাথমিক যুগে যদিও নারীরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মত

ইমামের পেছনে নামায পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার  কারণে মসজিদে নববীর জামাতে অংশগ্রহণ করত। তথাপি তার জন্য বেশ কিছু শর্ত ছিল। যেমন, ১. পূর্ণ পর্দার সাথে আসতে হবে। ২. সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবে না। ৩. সাজসজ্জা পরিত্যাগ করতে হবে। ৪. রাতে আসবে, দিনে আসবে না। ৫. মহিলারা সবার পরে আসবে এবং নামায শেষে পুরুষদের আগে বের হয়ে যাবে। ৬. কোনো অবস্থাতেই পুরুষদের সাথে মেলা-মেশার আশঙ্কা না থাকতে হবে। উপরন্তু, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হায়াতেই মহিলাদের মসজিদে নববীতে না এসে নিজের ঘরের অন্দরমহলে নামায পড়ার জন্য তাকীদ করতেন।

একদা হযরত উম্মে হুমাইদ রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে নামায নামায পড়তে ভালবাসি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে নামায পড়তে ভালবাস। কিন্তু তোমার ঘরে নামায তোমার বাইরের হুজরায় নামায অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার হুজরায় নামায তোমার বাড়ীতে নামায অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার বাড়ীতে নামায তোমার মহল্লার মসজিদে নামায অপেক্ষ উত্তম। আর তোমার মহল্লার মসজিদে নামায আমার মসজিদে নামায অপেক্ষা উত্তাম। অত:পর উক্ত মহিলা নিজ ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নামাযের স্থান নির্ধারণ করে নিল এবং আমরণ তাতেই নামায আদায় করল। (মুসনাদে আহমাদ (হাদিস নং ১৭০৯০), সহীহ ইবনে খুযাইমা (হাদিস নং ১৬৮৯) ও সহীহ ইবনে হিব্বান (হাদিস নং ২২১৭)

অতঃপর নবীজীর ইন্তিকালের পর সামাজিক পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনের কারণে সাহাবায়ে কেরাম মহিলাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করে দেন এবং মহিলারাও মসজিদে আসা বন্ধ করে দেয়। উম্মাহাতুল মুমিনীন এবং অন্যান্য মহিলা সাহাবীদের তাকওয়া- তহারাত, খোদাভীতি যা প্রবাদতুল্য, এবং পরবর্তীযুগের নারীদের জন্য যারা হলেন আদর্শ তাঁদের ব্যাপারে যদি এমন নিষেধাজ্ঞা হয়, তাহলে এমন ফেতনা-ফাসাদের ব্যাপকতার যুগে প্রকাশ্যে দিবালোকে বেপর্দার সাথে দুর-দুরান্ত থেকে মহিলাদের উক্ত সম্মেলনে যাতায়াত কীভাবে অনুমোদিত হতে পারে?

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীনী মাহফিল করার তাওফীক দান করুন এবং এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন ॥ ইয়া রাব্বাল আলামীন।

লেখক: শাইখুল হাদিস ও প্রধান মুফতি, জামিয়া রাহমানিয়া (আবরার)

পূর্ববর্তি সংবাদবিমানে যাত্রীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়: প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদসোমালিয়ায় গাড়িবোমা হামলা : নিহত ৬১, আহত ৯০