মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ ।।
আমাদের দেশে সূর্যগ্রহণ কেন্দ্র করে দেখা যায় ব্যাপক আয়োজন। গ্রহণের আগে ও পরে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক রিপোর্টিং হয় এবং অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ লেখার বিষয়বস্তু থাকে পূর্বের যুগের মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার এবং বর্তমান যুগের মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞানগরিমা।
আমরা বিজ্ঞান চর্চার পক্ষে। প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে পদ্ধতিগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত মৌলিক মতপার্থক্য থাকলেও বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করি অত্যন্ত গভীরভাবে এবং বহুমাত্রিক লক্ষ্যভিসারীরূপে। জ্ঞানচর্চার নামে আত্ম বিস্মৃতি আমরা কখনো সমর্থন করি না।
অতীতের সকল মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল, আর বর্তমানের সকল মানুষ কুসংস্কার থেকে মুক্ত-এই সরল সমীকরণে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা মনে করি, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা অতীতেও যেমন ছিল বর্তমানেও আছে। আর জ্ঞানের আলো বর্তমানে যেমন আছে অতীতেও ছিল।
জ্ঞানের দুই সূত্র : ‘ওহী’ ও অভিজ্ঞতা’ থেকে সময়ের কোনো অংশকেই আল্লাহ তাআলা শূন্য রাখেননি। সময়ের উপযোগিতা অনুযায়ী দুই ধরনের জ্ঞানই মানুষকে দান করেছেন। যে জাতি এই দুই জ্ঞানসূত্রের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করতে পেরেছে তারাই সর্বোচ্চ কল্যাণ লাভ করেছে আর যারা কোনো একটিকে অস্বীকার করেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ওহীর আলো থেকে বঞ্চিত মানুষই নানা ধরনের কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল এবং প্রকৃতির মাঝে নানা অলিক শক্তি কল্পনা করে তার পূজা-অর্চনায় লিপ্ত হত।
ইতিহাস আরো বলে যে, ‘অহী’ ও ‘অভিজ্ঞতা’র মাঝে কোনো সংঘর্ষ ছিল না। এটা মানুষ নিজেই সৃষ্টি করেছে। আর তা সৃষ্টি করেছে দুইভাবে : এক শ্রেণী ইলমে ওহীকে হাতছাড়া করে অবাস্তব চিন্তা-ভাবনা ও বিভিন্ন মনগড়া অভিমতকে তাদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছে, ফলে মানুষের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ধর্ম’ ও ‘জ্ঞানে’র মাঝে সংঘর্ষ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের খৃষ্টসমাজ এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
বলাবাহুল্য যে, এর জন্য ধর্ম দায়ী নয়, দায়ী ওইসব আহবার ও রোহবান, যারা ধর্মের বিকৃতি ঘটিয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে যারা পর্যবেক্ষণভিত্তিক আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গর্বে এতটাই আত্মহারা হয়ে গিয়েছে যে, প্রমাণিত বাস্তবতাকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ইলমে ওহীকেই অস্বীকার করতে আরম্ভ করেছে। আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি যে ওহী নাযিল হয়েছে এবং উম্মাহর পূর্বসূরীগণ যা অক্ষরে অক্ষরে সংরক্ষণ করেছেন, তাকে জানার ও বোঝার চেষ্টাও তারা ‘পশ্চাৎপদতা’ বলে ভাবতে শুরু করেছে। অথচ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ সর্বদা কুরআন ও সুন্নাহর সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করেছে।
সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে অতীতে অনেক কুসংস্কার ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল এবং বর্তমানেও আছে, কিন্তু প্রায় দেড় হাজার বছর আগে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে তাৎপর্য উল্লেখ করেছিলেন তার সঙ্গে অধুনা পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের কোনোই সংঘর্ষ নেই; বরং আমরা বিশ্বাস করি, এই জ্ঞান যত অগ্রসর হবে তাঁর বাণীর সত্যতা ততই উদ্ভাসিত হবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘… সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হল আল্লাহ তাআলার (কুদরতের) দুটি নিদর্শন।’ বলাবাহুল্য, এটাই হচ্ছে এ বিষয়ে সর্বশেষ কথা। সূর্য ও চন্দ্রের গতি, দূরত্ব, কক্ষপথ ইত্যাদি সম্পর্কে যে পরিমাণ তথ্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আহরিত হয়েছে তার দ্বারা কি প্রমাণ হয় না যে, আমাদের এই সৌর-জগত এক সুসংহত নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে? যার কারণে আজ আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি যে, আগামী শত বছর পর আবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা দিবে! বলাবাহুল্য, এই সুসংহত পরিচালনা তার পরিচালকের সীমাহীন কুদরতকেই প্রমাণ করে।
ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত