শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. : আত্মিক ও রাষ্ট্রিক বিজয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা

ওলিউর রহমান ।।

খ্রিস্টীয় আঠার শতক ছিল ভারতীয় মুসলমানদের জন্য চরম দুর্যোগের কাল। ভারতের মুসলমানদের আজকের যে চরম দুর্দশা তার সূচনা হয়েছিল সেই আঠার শতকেই। ১১৯৩ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করার মাধ্যমে সুলতান মুহাম্মদ ঘুরী দিল্লীতে যে মুসলিম কেন্দ্রীয় শাসনের ভিত গড়েছিলেন আঠার শতকে এসে তা চরম নড়েবড়ে হয়ে পড়ে।

সেসময় ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মারাঠা শক্তি। পাঞ্জাব, লাহোর দখল করে দিল্লীর অদূরে আমরোহা পর্যন্ত তারা ক্ষমতা বিস্তার করে। দিল্লীর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জাঠ শক্তি ছিল সম্রাট আলমগীরের দুর্বল উত্তারধিকারীদের জন্য মুর্তিমান আতঙ্কের নাম। এদিকে ইংরেজদের সহায়তায় শিখ ধর্মীয় গোষ্ঠীও রাজনীতির ময়দানে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ভারতবর্ষের আঞ্চলিক অন্য রাজন্যবর্গ দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনকে অস্বীকার করে স্বাধীনতার ঘোষণা করতে থাকে। বাংলা অঞ্চলের শাসনক্ষমতা দখল করে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাটদের হুমকির মধ্যেই রেখেছিল। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল মুসলমানদের জনজীবনে ব্যবসা করতে আসা পশ্চিমা বেণিয়াদের সাংস্কৃতিক প্রভাব।

মুসলিম জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা এসব দুর্যোগের ভয়াবহতা শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.কে গভীর মর্মাহত করে।  শাহ ওলিউল্লাহর জন্ম আঠার শতকের গোড়ার দিকে। রক্তে-বংশে তিনি উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর উত্তরপুরুষ। অল্পবয়সেই নিজ পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে রহিমিয়্যাতে তিনি তাফসির, ফিকহ, দর্শনে বুৎপত্তি অর্জন করেন। আইনশাস্ত্রেও তার অসামান্য দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক এবং আধুনিক ইসলামি চিন্তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

সাধারণ মুসলমানদের জীবনে ধর্মীয় প্রভাবের জাগরণ এবং দিল্লীতে কেন্দ্রীয় মুসলিম শাসনের ভিতকে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি ছিলেন সদা চিন্তিত। তৃণমূল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায় পর্যন্ত ইসলাহের প্রয়োজনীতা শাহ ওলিউল্লাহ উপলব্ধি করেন প্রবলভাবে।

তবে সংস্কারকাজ সাধনের পূর্বে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিধিকে আরও সমৃদ্ধ করে নিজেকে পূর্ণরূপে যোগ্য করে গড়ে তোলতে শাহ সাহেব হেজায সফর করেন। হেজায সফরে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের সংস্পর্শ এসে তিনি আরবীয় সংস্কৃতি, তুর্কি সালতানাতের নানা কার্যাদি ও সীমাবদ্ধতা এবং পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করেন। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ফলে সমগ্র বিশ্বের উপর আছড়ে পড়া পুঁজিবাদের সয়লাব এবং সমাজবাদীদের সামন্তবাদের মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপের ব্যাপারে সঠিক ধারণা নেন।

দু’বছর হেজাযে অবস্থান করে বহু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভের পর তিনি এ মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন যে, ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপর ঘনায়মান সর্বগ্রাসী আগ্রাসন মোকাবেলা করতে হলে সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে হবে।

পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মোকাবেলায় অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলামের উদারনৈতিক ব্যাখ্যা ও অবস্থান জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।

ধর্মীয় সমাজে শিয়াবাদের প্রভাব এবং তাসাউফের নামে দ্বীন নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার মূলৎপাঠন করতে হলে গোড়া থেকে ইসলাহের কাজ করতে হবে।

মারাঠা, জাঠ, শিখ, স্থানীয় রাজন্যবর্গ এবং উপনিবেশী শক্তিগুলোর মোকাবেলা করে কেন্দ্রীয়ভাবে ভারতে ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে হল প্রয়োজন পরিকল্পনা মাফিক একটি দক্ষ, দৃঢ় মনোবল কর্মীবাহিনী গঠন।

সর্বোপরি শাহ সাহেবে মূল লক্ষ্য ছিল কুরআন ও হাদীসে জ্ঞানকে সুবিস্তৃত ও সহজবোধ্য করে জনগণের মাঝে ইসলামের পুনঃর্জাগরণ তৈরি করা।

মোটকথা রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক চারটি বিষয়েই তথা-রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কার- ছিল শাহ সাহেবের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

রাজনৈতিক প্রতিরোধ

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার দুর্বল উত্তরাধীকারীদের মধ্যে ক্ষমতার অর্ন্তদ্বন্ধের সুযোগে মারাঠা শক্তি দিল্লীর অদূরে আমরোহা পর্যন্ত দখল করে নিল। এদিকে ইরানের নাদের শাহও দিল্লী আক্রমণ করে মূল্যবান বহু সামগ্রী লুট করে নিয়ে গেল। সাথে ছিল হাজার হাজার মানুষ খুন। কিন্তু ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্ধে জড়িয়ে দুর্বল মুঘল শাসকরা ছিল নির্বিকার। শাহ সাহেব তাদেরকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে বারবার অবহিত করেন। নিরুপায় হয়ে তিনি আফগানিস্তানের নজিবুদ দাওলাহ এবং আহমদ শাহ আবদালীকে আমন্ত্রণ জানালেন দিল্লীকে রক্ষা করতে। দুই আফগান বীরের সহায়তায় সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও শাহ সাহেব ভাবলেন এভাবে আর কত! নিজেদেরই কিছু করা দরকার! গড়ে তুললেন নিজের সন্তান এবং একান্ত ভক্তদের নিয়ে প্রতিরোধকারী দল। তারই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হল ইংরেজ বিরোধী সাড়ে তিনশত পৃষ্ঠার ফতোয়া। সংগঠিত হল বালাকোট, শামেলি, রেশমি রুমাল, বাঁশের কেল্লা ও ফরায়েজী আন্দোলন।

ইসলামের উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার ব্যাখ্যা

শিল্পবিল্পের ফলে ইউরোপ তখন বিশ্বজুড়েই উপনিবেশ কায়েম করে রেখেছে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের উপনিবেশিত অঞ্চলে প্রয়োগ করছে পুঁজিবাদের ভোগবাদী থিওরি। যুলুম-নিপীড়ন, বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের স্বেচ্ছচারিতা। একই সময়ে পুঁজিবাদের মোকাবেলায় সাম্যবাদের নামে আগমন হল সমাজতন্ত্রের। যা ছিল মানুষ স্বভাব প্রকৃতির বিরোধী। এ উভয় প্রকার দৃষ্টিভঙ্গিই শুধু মুসলিম কেন মানবতার জন্যই ছিল চরম আত্মঘাতী। শাহ সাহেব তখন অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে ইসলামের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা করা শুরু করলেন। মৌলিক কিছু শর্তের কথা উল্লেখ করে ব্যবসার ক্ষেত্রে ইসলাম যে প্রত্যেকেকই স্বাধীনতা দিয়েছে; বিভিন্ন মাহফিলে মঞ্চে তিনি তা সাধারণ মানুষদের বুঝাতে লাগলেন।

ধর্মীয় সংস্কার

দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ূন পুনরায় দিল্লীর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ভারতে ইরানি শিয়াদের প্রভাব বাড়তে থাকে। দ্বীনে ইলাহির প্রবর্তক সম্রাট আকবরের মুর্খতা ও দুর্বলতার সুযোগে ইরানিরা ক্রমেই নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। পরস্থিতি ক্রমেই এত জটিলতর হয়ে উঠল যে, মাঝেমাঝেই দেখা যেত ‘শিয়া-সুন্নী’ দ্বন্ধ লেগে আছে। তাছাড়া স্থানীয় কথিত তাসাউফপন্থীদের মাঝে পড়তে লাগল শিয়াদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব। শাহ সাহেব ‘কঠোর হস্তে’ তা দমনে ব্রত ছিলেন। নিজের লিখিত কিতাবাদীতে এ সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা করেছেন। নিজ পুত্র তদীয় আদর্শের অনুসারী শাহ আবদুল আযীয দেহলভিকে দিয়ে লেখালেন অনবদ্য গ্রন্থ ‘তোহফায়ে ইসনা আশারিয়া’।

শিক্ষা সংস্কার

শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে এক কথায় বলতে গেলে শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীকে উপমহাদেশের ধর্মীয় শিক্ষাধারা আধ্যত্মিক গুরু বলা হয়। আজকে দরসে নিযামীতে পাঠদানের যে প্রক্রিয়া তার জনক হলেন শাহ সাহেব। ধর্মীয় শিক্ষাধারার উপর পুরোনো যে আস্তরন পড়ে রয়েছিল শাহ সাহেব তা ধুঁয়ে মুছে সাফ করেছেন। দরসে নিযামীতে পাঠ্য তার রচিত কিতাব আল ফাউযুল কাবীর এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

শাহ সাহেবের জীবনের যুগান্তকারী অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল কুরআন চর্চার ব্যাপকতা। তিনি বলতেন, কুরআন খ্রিস্টানদের ফাদারের কাছে থাকা বাইবেল এবং হিন্দুদের পুরোহিতের কাছে সংরক্ষিত থাকা কোনো গ্রন্থের মতো নয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত। কুরআনের মর্ম উদঘাটন দুর্গম্য কোনো বিষয় নয়। যে কেউ ইচ্ছে করলেই কুরআনের তরজমা করতে পারে। তিনিই সর্বপ্রথম ফারসীতে কুরআনের তরজমা করেছিলোন বলে জানা যায়।

হাদীস পাঠদানের ধারায় শাহ সাহেব এনেছিলেন যুগান্তকারী পরিবর্তন। ভারতবর্ষে হাদিসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহের যে ‘সিলসিলায়ে সনদ’ তথা ক্রম সূত্র তাঁর অধিকাংশই মিলিত হয় শাহ সাহেবের সাথে।

দরসে নিযামীর পাঠ্য তালিকায় মানতিক, ফালসাফা, কালামের যে আধিক্যতা ছিল শাহ সাহেব খুব কৌশলে তা তাফসীর, উসুলুত তাফসী, হাদীস, উসুলে হাদীস, ফিকহ, উসুলে ফিকহে রূপান্তর করে নেনে।

গ্রন্থাবলী

শাহ সাহেব ছিলেন বহু কালজয়ী, যুগান্তকারী গ্রন্থের রচয়িতা। শাহ সাহেব রচিত ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ উচ্চতর জ্ঞানের উপর এ যাবত কালের রচিত অন্যতম কিতাব। খেলাফতে রাশেদার প্রামাণিকতা নিয়ে তার কিতাব ‘ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতিল খুলাফা’ পড়ে তার বিরুদ্ধবাদীদেরও আশ্চর্যের সীমা থাকেনি।

‘আল ইয়ানিউল জানি’ গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা মুহসিন বিন ইয়াহইয়া বলেন, আমি আমার উস্তায মাওলানা ফজলুল হক খায়রাবাদীকে দেখতাম, অবসর সময়ে ‘ইযালাতুল খাফা’ কিতাব পড়ছেন এবং তিনি আশ্চর্য হয়ে বলতেন, এমন কিতাব কীভাবে লেখা সম্ভব?

অবশেষে চূড়ান্ত বিজয়ের মহানায়ক, আমাদের চেতনার বাতিঘর শাহ ওলিউল্লাহ রহ. ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে ৬২ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন।

পূর্ববর্তি সংবাদহজ বিষয়ে ইরান ও সৌদি আরবের মাঝে সমঝোতা স্বাক্ষর
পরবর্তি সংবাদঅর্থ আত্মসাত মামলায় এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল