মক্কা বিজয় : বিজিতের প্রতি সদাচারের অনুপম দৃষ্টান্ত

ওলিউর রহমান ।।

বিজয়ী বেশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন- বিনয়বশত তাঁর মাথা এই পরিমাণ ঝুঁকে ছিল যে থুঁতনি উটের কাজোয়ার সাথে মিলে যাচ্ছিল। এসময় তাঁর যবানে ছিল সূরা ফাতহের তিলাওয়াত।

মক্কা বিজয়ের দিন এক ব্যক্তি কোনো একটা বিষয় নিয়ে রাসূলের সাথে কথা বলতে এসে ভয়ে কাঁপছিল দেখে রাসূল বললেন, কী হলো তোমার! ভয় কিসের? আমি কি কোনো বাদশাহ? আমি তো কুরায়শের এক সাধারণ মায়েরই সন্তান!

এটা ছিল সেই ব্যক্তির উত্তর; নানামুখী অত্যাচারের শিকার হয়ে যিনি একদিন প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ইসলামে বিজয়ের ধারণা কখনোই যুলুমের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার উত্তানের পেছনের পর্বে থাকে যুলম নির্যাতন খুন ও ধর্ষণের দীর্ঘ উপাখ্যান। কিন্তু ইসলাম কোনো নগর বিজয়কে কখনো সে অঞ্চলের মানুষদের উপর কর্তৃত্ব প্রাতিষ্ঠার দৃষ্টিতে দেখে না। ইসলামে বিজয়ের ধারণা ‘ই’লায়ে কালিমাতুল্লা’ তথা দ্বীনের মর্যাদার বুলন্দি এবং ‘ই’যাযুদ্দীন’ তথা দ্বীনের সম্মান উচ্চকিত করার উপর প্রতিষ্ঠিত। বিজিতের সাথে মুসলিমদের ব্যবহার এবং যুদ্ধবন্ধীদের সাথে মুসলিমদের করা ইনসাফ ছিল পৃথিবীর জন্য নতুন নজির।

মক্কা বিজয়ের দিন আনছারী সাহাবিদের আমীর সা’দ বিন উবাদাহ রা. নও মুসলিম আবু সুফিয়ান রা. কে অতিক্রম করার সময় বলছিলেন, اليوم يوم الملحمة، اليوم تستحل الكعبة، اليوم اذل الله قريشا “আজ চূড়ান্তু যুদ্ধের দিন। আজ শত্রুদের দখল থেকে কা’বাকে অবমুক্ত করার দিন। আজকের দিনে আল্লাহ কুরায়শদের অপদস্থ করবেন।

প্রিয় সাহাবির এ কঠোর বাণী দয়ার নবী পছন্দ করতে পারেন নি। তিনি ছোট্ট একটি সংশোধন এনে বললেন, اليوم يوم المرحمة، اليوم يعز الله قريشا و يعظم الله الكعبة “আজ দয়া ও ভালবাসার দিন। আজ কুরায়শের সম্মানিত হওয়ার দিন।

বাইতুল্লাহর যিয়ারত শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’বা ঘরের চাবি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ডাকলেন উসমান ইবনে তলহাকে। (পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবি হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন। রাযিয়াল্লাহু আনহু) উসমানের হাতে চাবি দিয়ে রাসূল বললেন, আজ সদাচারের দিন। রাখ এই চাবি তুমি। যালিম ছাড়া কেউ এই চাবি তোমাদের থেকে কেড়ে নিবে না।

এই সেই উসমান যে হিজরতের আগে একদিন রাসূল তার কাছে কা’বা ঘরের চাবি চাইলে রাসূলের সাথে সে চূড়ান্ত অমর্যাদাকর আচরণ করেছিল।

কা’বার দরজা খুলে রাসূল দেখলেন, কুরায়শ সব চত্বরে দাঁড়িয়ে। রাসূলেরই অপেক্ষা করছিল তারা। মানবতার মুক্তি-দূত কা’বার দরজায় দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতাকে মধুর সম্ভাষণ করে বললেন,

হে কুরায়শ, তোমাদের কী আশা, আজকের দিনে তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে?

উপস্থিত জনতা মধুবর্ষণে বিমুগ্ধ হয়ে উত্তরে জানালো- আমরা তো ভালো কিছুরই আশা করি। আপনার ব্যক্তিত্ব সম্ভ্রান্ত। আপনি তো সম্মানিত ভাই এবং কূলীন ঘরের সন্তান।

অতঃপর রহমাতুল লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আজ আমি তাই বলব, ইউসুফ আলাইহিস সালাম যা তার ভাইদের বলেছিলেন- لا تثريب عليكم اليوم ، اذهبوا ،انتم الطلقاء “আজকের দিনে তোমাদের প্রতি কোনো অনুযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত।

এর আগেই, মক্কায় প্রবেশের সময়ই ঘোষণা করা হয়েছিল, আবু সুফিয়ানের ঘরে যে আশ্রয় নিবে সে নিরাপদ। যে নিজ ঘরে আশ্রয় নিবে তাকেও কিছু করা হবে। হারামে আশ্রয়গহণকারীদেরও দেওয়া হবে পূর্ণ নিরাপত্তা।

এছাড়াও ইকরিমা, হিনদা, ওয়াহশি সহ অল্প যে কয়জনের ব্যাপারে ঘোষণা করা হয়েছিল- তাদের ক্ষমা নাই- তাদেরও সবাই প্রায় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করেছিলেন।

সবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল রাযি. কে বললেন আযান দিতে। ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়ল রবের বড়ত্বের বাণী।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবাদের নিয়ে আদায় করলেন আট রাকাত ‘সালাতুল ফাতহ’, বিজয়ের নামায।

পূর্ববর্তি সংবাদচেতনাধারী একটি মহল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করছে : ফখরুল
পরবর্তি সংবাদফিলিস্তিনে আবারও বিমানহামলা চালাল ইসরাইলি বাহিনী