রাসূলের জন্ম ও ওফাতের তারিখ : একটি পর্যালোচনা

মুফতি মনসুরুল হক ।।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ:

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের নিকট মতানৈক্য রয়েছে। তবে নবীজী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবার হয়েছে, এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সকল ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরাম একমত। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)

জন্ম তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। এসব বর্ণনার মধ্য থেকে হাফেজ ইবনে কাছির রহ. ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এর মধ্যে ‘দুই’ ‘আট’ ও ‘বার’ তারিখের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২) আর মুহাম্মাদ বিন সাআদ রহ. ‘তবাকাতুল কুবরা’ (১/৮০) নামক গ্রন্থে দুই ও দশ তারিখের মতকে গ্রহণ করেছেন। বার তারিখের মতটি প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এ মতটির আলোচনা তাঁর কিতাবে স্থান পায়নি। দুই ও দশ তারিখের পক্ষে তার পেশকৃত বর্ণনাসূত্রে ‘ওয়াকিদী’ রয়েছেন। রিজাল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকলানী রহ. ওয়াকেদী সম্পর্কে বলেনঃ متروك مع سعة علمه প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরিত্যাজ্য।’ (তাকরীবুত তাহযীব পৃ.৪৯৮)

অতএব দুই তারিখ ও দশ তারিখের বর্ণনাটির সূত্রে ‘মাতরুক’ বর্ণনাকারী থাকায় এমতটি গ্রহণ করা সঠিক নয়।

 

আট তারিখের দলীল:

আল্লামা আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল কসতাল্লানী ৮ তারিখের মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বলেনঃ ‘কারো কারো মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। শায়েখ কুতুবউদ্দিন (আবূ বকর মুহাম্মদ বিন আহমাদ) বলেছেন, এ মতটিই অধিকাংশ

মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেছেন এবং এ মতটিই হযরত ইবনে আব্বাস এবং জুবাইর বিন মুতইম রা. থেকে বর্ণিত আছে। তাছাড়া ইতিহাস সম্পর্কে যার নূন্যতম ধারণা আছে সেও এমতটিই গ্রহণ করবে। (আল

মাওয়াহেবুল লাদুনিয়্যাহ ১/৮৫) তাছাড়া ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে প্রসিদ্ধ ইতিহাসবেত্তা

হাফেজ ইবনে কাছীর রহ.-এর বর্ণনাভঙ্গি দ্বারাও আট তারিখের মতটি অগ্রগণ্য বলে বোঝা যায়। (দেখুন আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)

 

বার তারিখের দলীল:

হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. বার তারিখের দলীল সম্পর্কে বলেনঃ‘ইবনে ইসহাক রহ. বার তারিখের মতটি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আর ইবনে আবী শাইবা তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে আফফান ইবনে মুসলিম এর সূত্রে সাঈদ ইবনে মীনা থেকে বর্ণনা করেন যে, জাবের (রাযি.)ও ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেছেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তি বাহিনীর মক্কায় আক্রমণের বছর রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন। আর রবিউল আউয়াল মাসে তাকে নবুওয়াত দেয়া হয় এবং এ মাসে তাঁর মে‘রাজ হয় এবং এ মাসেই তিনি হিজরত করেন আর এ মাসেই তিনি ইন্তিকাল করেন। (আল-বিদায়া

ওয়ান নিহায়া ২/২৮৩) এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলোঃ এ হাদীসের বর্ণনাসূত্রে আফফান বিন মুসলিম এবং সাঈদ বিন মীনা উভয়ের মাঝে একজন রাবী আছে যার নাম এই সনদে উল্লেখ করা হয় নি। তাই এই হাদীসটি মুনকাতে হয়ে গেল। আর মুনকাতে হাদীস দলির হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

যাই হোক উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা একথা সাব্যস্ত হল যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম তারিখ হিসেবে ৮ তারিখের মতটিই অগ্রগণ্য। ঐতিহাসিক বিবেচনায়ও এটাই বিশুদ্ধ অভিমত।

 

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ:

নিকট অতীতের ভারত উপ-মহাদেশের কয়েকজন বরণীয় আলেমের মতামত হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার জন্ম গ্রহণ করেছেন। আল্লামা শিবলী নু‘মানী ও শায়খ সুলাইমান নদভী কর্তৃক যৌথভাবে উর্দূ ভাষায় রচিত ‘সীরাতুন নবী’ নামক গ্রন্থে এবং শায়খ সফীউর রহমান কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত ‘আররাহীকুল মাখতূম’ নামক গ্রন্থে এই মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। এই মতের পক্ষে দলীল বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সীরাতুন নবীর’ গ্রন্থকার বলেছেন, বিগত শতাব্দীর মিশরের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলেম মাহমূদ পাশা ফালাকী রহ. তার রচিত ‘নাতায়েজুল ইফহাম ফী তাকবীমিল আরব কাবলাল ইসলাম ওয়া ফী তাহকীকে মাউলিদিন নাবিয়্যি আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম’ নামক গ্রন্থে গাণিতিক প্রমাণাদির মাধ্যমে সাব্যস্ত করেছেন যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম মূলত রবিউল আউয়াল এর নয় তারিখ হয়েছে।

 

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের তারিখ:

ইন্তেকালের তারিখ সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। অগ্রগণ্য মতানুসারে নবীজী রবিউল আওয়াল মাসের ১ তারিখে ইন্তিকাল করেন। এক তারিখ সম্পর্কীয় দলীল নিম্নে পেশ করা হলো:

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে ইমামগণ একমত তা নিম্নরূপ:

 

১. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করেন ১১ হিজরীতে।

২. রবিউল আউয়াল মাসে।

৩. সোমবার।

৪. এক তারিখ থেকে বার তারিখের মধ্যে মুত্যুর তারিখ সম্পর্কে হাদীসের মৌলিক গ্রন্থসমূহে স্পষ্ট কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। সীরাতাজ্ঞ ও ইতিহাসবিদগণ এ সম্পর্কে তিনটি মত উল্লেখ করে

থাকেন: এক, দুই ও বার রবিউল আউয়াল।

এই তিনটি মতকে সবরকম যাচাই বাছাইয়ের পর ১ম রবিউল আউয়াল এর মতটিই যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কেননা সহীহ বুখারীর হাদীসের মাধ্যমে একথা সাব্যস্ত যে, اليوم اكملت لكم دين শীর্ষক আয়াতটি দশম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ শুক্রবার আরাফার ময়দানে নাযিল হয়েছিল। (বুখারী, কিতাবুত তাফসীর) এই হিসাব ঠিক রেখে চান্দ্রমাসের সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করলে রবিউল আউয়াল এর এক তারিখ সোমবার সাব্যস্ত হয়।

মূসা আলখাওয়ারেযমী প্রমুখ ইমামগণের উক্তি এক তারিখের মতকে সমর্থন করায় আমরা এক তারিখের মতটি গ্রহণ করছি। (সীরাতুন নবী ২/৪৭৭)

তাছাড়া তাফসীরে তবারী ও তাফসীরে ইবনে কাছীরে ইমাম ইবনে জুরাইজ তবারী থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হল’ শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হওয়ার দিন থেকে নিয়ে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মোট একাশি দিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত ছিলেন।’ (তাফসীরে তবারী ৬/৯৬)

ইমাম ইবনে জুরাইজ এর এই উক্তি অনুযায়ীও উল্লেখিত আয়াত নাযিল হওয়ার দিন থেকে নিয়ে একাশিতম দিন রবিউল আউয়াল এর এক তারিখ সোমবার হয়, যদি জিলহজ্জ, মুহাররাম ও সফর এই তিন মাসের যেকোনো দুইটিকে উনত্রিশা ধরা হয়। অতএব, রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখ সোমবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকাল হয়েছে। এটিই বিশুদ্ধ ও যুক্তিযুক্ত মত। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন: (‘সীরাতুন নবী’ ২/৪৭৭)

পূর্ববর্তি সংবাদবাবরি মসজিদের রায় ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়: ওবায়দুল কাদের
পরবর্তি সংবাদসামাজিক মাধ্যমে বাবরি মসজিদ রায়ের বিরুদ্ধে লেখায় উত্তরপ্রদেশে ধরপাকড়